• ফুটবল

দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপ ২০০২ঃ রূপকথার গল্পে অমানিশার ছায়া

পোস্টটি ৯৫২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

ফিফা বিশ্বকাপ ২০০২- নকআউট পর্বের দক্ষিণ কোরিয়া বনাম ইতালির অতিরিক্ত সময়ের ১৩ মিনিটের খেলা চলছে। খেলায় তখন ১-১ গোলে সমতা। মিডফিল্ড থেকে লম্বা করে বাড়ানো বল ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার ডিবক্সে ঢুকে পরলেন তোত্তি। ডিফেন্ডারের ট্যাকল এড়িয়ে একটু ডানপাশে সরে গিয়ে গোলমুখে শট নিতে যাবেন-ঠিক সেই মূহুর্তে কোরিয় ডিফেন্ডারের স্লাইডিং চার্জে পড়ে গেলেন তিনি। হাত উচিয়ে রেফারির কাছে পেনাল্টির দাবী জানালেন। কিন্তু একি! ইকুয়েডরের রেফারি বায়রন মোরেনো যে তোত্তিকেই হলুদ কার্ড দেখালেন। আগেই একটা হলুদ কার্ড দেখা তোত্তি যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ডাইভিংয়ের দায় নিয়েই মাঠ ত্যাগ করলেন ইতালিয়ান ফুটবলের মহানায়ক।

কি ভাবছেন? বিচ্ছিন্ন ঘটনা?? ফুটবলে তো এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। একদমই না। এশিয়ায় প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ আয়োজনের গর্বের জায়গায় দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপ কলঙ্কিত হয়ে আছে এমন অসংখ্য বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। বিস্তারিত বলার আগে দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবল ইতিহাস থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। ১৯৫৪ সাল থেকে মোটামুটি নিয়মিতভাবে বিশ্বকাপ খেলে আসা কোরিয়ানদের বিশ্বকাপে বলার মত কোন পারফরম্যান্স নেই। ২০০২ বিশ্বকাপের আয়োজন হওয়ার সিদ্ধান্তের পরই তারা বিশ্বকে কিছু করে দেখানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। এরই ধারাবাহিকতায় নিজেদের ঐতিহ্যগত দেশী কোচের পরিবর্তে তারা নেদারল্যান্ডসের গাস হিডিংককে কোচ হিসেবে মনোনীত করে। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে একমাত্র বিদেশী কোচ ছিলেন রাশান আনাতোলি বিশোভেতজ(১৯৯৪)। গাস হিডিংক নিজের স্বভাবত পাসিং ফুটবলের ট্যাকটিকস বদলে ফেলে শক্তি ও সামর্থ্য বিবেচনায় দলকে দ্রুতগতির কাউন্টার এটাকিং ফুটবলে অভ্যস্ত করে তোলেন। বিশ্বকাপের আগে এশীয় দলগুলোর বিপক্ষে বরাবরই ভালো পারফর্ম করা কোরিয়া কিন্তু ইউরোপের বড় দলগুলোর বিপক্ষে প্রায়শই হোচট খেতো। তাই, বিশ্বকাপে ডি গ্রুপে পর্তুগাল-পোল্যান্ড-ইউএসএ দের সাথে খেলে দক্ষিণ কোরিয়ার নকআউট পর্বে ওঠার আশা বোধহয় স্বাগতিকরা ছাড়া কেউই করেনি।

প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ পোল্যান্ডের সাথে অপেক্ষাকৃত ভালো ফুটবল উপহার দিয়ে ২-০ গোলে সহজেই ম্যাচ জিতে নেয় তারা। অবশ্য, পোল্যান্ডের গোলরক্ষকও এ হারের দায় এড়াতে পারেন না। তার ব্যর্থতায়ই দুর্বল শটেও দ্বিতীয় গোল তুলে নেয় কোরিয়া। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেও ইউএসএর বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে সঠিক পথেই ছিল তারা। যদিও, নকআউট পর্বে ওঠার জন্য ইউরোপীয় জায়ান্ট পর্তুগালের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে তাদের প্রয়োজন ছিল ১ পয়েন্ট। অন্যদিকে, নিজের প্রথম ম্যাচে চোক করে বসা পর্তুগালের জন্য শেষ ম্যাচে জয়ের(নিদেনপক্ষে ড্র) বিকল্প ছিল না। জায়ান্টদের হারিয়ে নকআউট পর্বে উঠবে দক্ষিণ কোরিয়া- এমন বিশ্বাস করা লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ম্যাচের শুরু থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে থাকে পর্তুগাল। খেলার প্রথমার্ধেই কোরিয়ান ফরোয়ার্ডকে পিছন থেকে মারাত্মক ফাউল করে বসা পর্তুগীজ মিডফিল্ডার হোয়াও পিন্টোকে সরাসরি লালকার্ড দিয়ে বের করে দেন রেফারি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত যতটা সঠিক, ততটাই ভুল ছিল দ্বিতীয়ার্ধে একটি সাধারণ ফাউলের জন্য পর্তুগীজ ডিফেন্ডার বেতোকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দিয়ে বসা। ৯ জনের দল নিয়ে ১১ জনের দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে আর পেরে ওঠেনি পর্তুগাল। ১-০ গোলের জয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মত নকআউট পর্বে উঠে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।

নকআউট পর্বে উঠেই জাদুর বাক্স খুলে হাজির হয় দক্ষিণ কোরিয়া। শেষ ষোলোর ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ইউরোপিয়ান জায়ান্ট ইতালি। খেলার শুরু থেকেই খেলোয়াড়দের বদলে রেফারি দেখাতে থাকেন তার কারিশমা। চতুর্থ মিনিটেই সেটপিসে মৃদু ধাক্কায় প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে পড়ে গিয়ে পেনাল্টি আদায় করে নেন কোরিয় ফরোয়ার্ড। বুফনের অসাধারণ সেইভে সেযাত্রা বেচে যায় ইতালি। খেলার ১৮ মিনিটে দেল পিয়েরোর কর্নার থেকে হেড করে ইতালিকে এগিয়ে নেন ভিয়েরী। এরপরে প্রাধান্য বিস্তার করে খেললেও পুরো ম্যাচজুড়ে আর গোলের দেখা পায়নি ইতালি। কোরিয়ান খেলোয়াড়দের আক্রমণাত্মক সব ট্যাকলের মুখে ইতালির খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হন রেফারি। কোরিয়ান ডিফেন্ডারদের প্রধান টার্গেট ছিলেন তোত্তি আর দেল পিয়েরো- সেটা খেলা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। মারাত্মক এক ট্যাকলে রাইট ব্যাক কোকোর মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়। ব্যান্ডেজ নিয়েই ম্যাচ খেলেন তিনি। গোল প্রতিরোধে সময়মত দারুণ ট্যাকল করেও হলুদ কার্ড দেখতে হয় তাকে। খেলার ৮৮ মিনিটে পানুচ্চির অমার্জনীয় ভুলের সুযোগ নিয়ে দলকে সমতায় ফেরান কোরিয়ান ফরোয়ার্ড কে. সিওল। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই তোত্তির পাস ধরে দলকে এগিয়ে নেন ইতালিয়ান মিডফিল্ডার তমাসি; যেটি অফসাইডের দোহাই দিয়ে বাতিল ঘোষণা করেন রেফারি। কোরিয়ান খেলোয়াড়দের আক্রমণাত্মক সব ট্যাকল আর অপেশাদারসুলভ আচরণের মুখেও মাথা ঠান্ডা রাখে ইতালিয়ানরা। তবে, ক্রোধ বাধ ভাঙে তোত্তির অযাচিত লাল কার্ডের পর। একাধিক খেলোয়াড়দের হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করতে বাধ্য হন রেফারি। খেলার ১১৭ মিনিটে সেটপিস থেকে হতোদ্যম হয়ে পড়া ইতালির বিপক্ষে গোল করে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলেন কোরিয়ান ফরোয়ার্ড জে. আন। খেলার পর ইতালিয়ান ফেডারেশন ফিফার কাছে নালিশ করলেও তা ধোপে টিকেনি। যদিও, খেলার রেফারি বায়রন মোরেনো পরবর্তীতে পাতানো খেলার অভিযোগে রেফারিং থেকে বহিষ্কৃত হন। মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েন তিনি।

কোয়ার্টার ফাইনালে পরিবর্তন হয় রেফারি, কিন্তু পরিবর্তন হয় না দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিপক্ষের ভাগ্য। স্পেনের সাথেও বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকে রেফারি। খেলার শুরুতেই প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের ভিতর ফাউলের শিকার হন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড মরিয়েন্তেস। কিন্তু, ফাউলের বাঁশি না বাকিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন রেফারি। খেলার ২১ মিনিটে সিটপিস থেকে হেডে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বারাহার করা গোলটিও রেফারি ফাউলের অজুহাতে বাতিল করে দেন। জোয়াকিনকে বেশ কয়েকবার বাজেভাবে ফাউল করা হলেও তাতে টনক নড়েনি রেফারির। বরং, খেলার অতিরিক্ত সময়ে জোয়াকিনের ক্রস থেকে মরিয়েন্তেসের হেডে করা গোলটিও বাতিল হয় বল আগেই গোললাইন ক্রস করেছে বলে। টিভি রিপ্লেতে অবশ্য পরিষ্কার দেখা যায়, বল গোললাইন অতিক্রমের আগেই জোয়াকিন ক্রস করেছিলেন। রেফারির বেশ কিছু ভুল অফসাইড ডিসিশন খেলার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করেছে। অতিরিক্ত সময়েও গোলশূন্য থাকা খেলাটি টাইব্রেকারে গেলে পুরো ম্যাচজুড়ে অতিমানবীয় সব সেইভ করা স্প্যানিশ গোলরক্ষক ক্যাসিয়াস টাইব্রেকারে কোন শট ফেরাতে ব্যর্থ হন। সেমিফাইনালে উঠে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। সেমিফাইনালের স্বাভাবিক রেফারিংয়ে অবশ্য জার্মানদের সাথে তেমন পাত্তা পায়নি কোরিয়ানরা। মিখায়েল বালাকের একমাত্র গোলে সেমিফাইনালেই শেষ হয় কোরিয়ানদের স্বপ্নযাত্রা।

এ টুর্নামেন্টের রেফারিং নিয়ে পরে তদন্ত হয়েছে বিস্তর। তবে, পাতানো খেলার পক্ষে কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পায়নি ফিফা। ১৯৩৪ সালের ইতালি এবং ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন। স্বৈরশাসকের অধীনে বিশ্বকাপ হলে Manipulation টা একদম অলীক কল্পনা নয়। কিন্তু, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যে ফুটবল বিশ্বকাপে এমন Result manipulation দেখতে হবে, তা বোধহয় কারো কল্পনাতেও ছিল না। আর তাই জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপ ২০০২ তে এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র বিশ্বকাপ আয়োজনের সাফল্যের পাশাপাশি লেগে আছে ম্যাচ পাতানোর কালীমার ছাপ।