শের-ই-বাংলায় বদ্ধ ক্রিকেট মুক্তি পাবে কবে?
পোস্টটি ২৫১৯ বার পঠিত হয়েছে
এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত মোট ক্রিকেট ভেন্যুর সংখ্যা ২৬০ টি। এদের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেট আয়োজনের মর্যাদা আছে ১২১ টির, একদিনের ক্রিকেট আর টি-টুয়েন্টি ফরমেটের আন্তর্জাতিক ভেন্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ২০৯ আর ১৪৭ টি। সবথেকে পুরোনো অস্ট্রেলিয়ার “মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড” যেখানে প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭৭ সালের ১৫ই মার্চ। টেস্ট ক্রিকেটের সবথেকে নতুন সদস্য ভারতের “ভারত রত্ন শ্রী অতল বিহারী বাজপেয়ী ইকানা স্টেডিয়াম”। এই ভেন্যুগুলোর মতোই একটির ভেন্যু “শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম”।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ গড়িয়েছে এমন স্টেডিয়ামের সংখ্যা ৮ টি। এর মধ্যে যে “বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম” দিয়ে বাংলাদেশ তার টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রা শুরু করে সেটি এখন ফুটবলের জন্য বরাদ্দ। ২ টেস্ট, ১০ ওডিআই আর ৪ টি২০ আয়োজিত হওয়া ফতুল্লার “খান সাহেব উসমান আলী স্টেডিয়াম”-ও অকার্যকর অবস্থায় পরে আছে অনেকদিন যাবত। বগুড়ার “শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম” আরও অনেক আগে থেকেই পরে আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে। চট্টগ্রামের “এম এ আজিজ স্টেডিয়াম”-কেও বাদ দিলে বাকি থাকে ৪ টি স্টেডিয়াম।
১. শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর।
২. শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, খুলনা।
৩. সিলেট স্টেডিয়াম, সিলেট।
৪. জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম।
এখনো চলমান এই চারটি স্টেডিয়াম থাকলেও জাতীয় দলের প্রায় সব ক্রিকেট ম্যাচই কেন্দ্রীভূত থাকে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে। ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা শের-ই-বাংলায় এখন অব্দি টেস্ট হয়েছে ২১ টি, ওডিআই ১১০ টি আর টি-টুয়েন্টি ৪৪ টি। চলমান স্টেডিয়ামসমূহের মধ্যে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম আছে পরের অবস্থানে। তবে সংখ্যার পার্থক্য দেখলে যে কেউ অবাক হবেই। জহুর আহমেদে এখন পর্যন্ত টেস্ট, ওডিআই আর টি২০ ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে সমান ২০ টি করে।
মূল সমস্যাটা শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্ভরশীলতা না, বরং ঢাকামুখীতা। শেরে বাংলার যাত্রা শুরুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৯ টি টেস্ট খেলেছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই। পাশাপাশি এখানে আয়োজিত হয়েছে ৫৮ টি একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ। বাকি ভেন্যুগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ ওডিআই আর ৮ টেস্ট হয়েছে এম এ আজিজে। ৮ টি টি-টুয়েন্টি সিলেটে। সিলেট নতুন স্টেডিয়াম; এর হিসাব বাদ দিলেও বাকি থাকা খুলনার শেখ আবু নাসেরে ম্যাচ হয়েছে ৩ টেস্ট, ৪ ওডিআই আর ৫ টি টি২০।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মোট টেস্ট আয়োজিত হয়েছে ১৭ টি, যার মধ্যে ৭ টি পাকিস্তানের হোম ভেন্যু হিসেবে দেশ স্বাধীনের আগে আর একটি পাকিস্তান-শ্রীলংকা ম্যাচ ১৯৯৯ তে।
শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যে দেশের অন্য যেকোনো স্টেডিয়ামের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচ আয়োজিত হয় সেটা তো বুঝা গেলো; দেশ বিদেশের অন্য সকল স্টেডিয়ামের তুলনায় ম্যাচ কেমন আয়োজিত হয় সেদিকে এবার আলোকপাত করা যাক।
শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম ক্রিকেট বিশ্বের সবথেকে পুরোনো স্টেডিয়াম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। এই গ্রাউন্ডে একদিনের ক্রিকেট প্রথমবার খেলা হয় ১৯৭১ সালে। ৫০ বছরে সেখানে ক্রিকেটের এই সংস্করণের ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছে ১৪৯ বার যেখানে মাত্র ১৫ বছরেই মিরপুরের মাটিতে ওডিআই ম্যাচ হয়েছে ১১০ টি। সর্বোচ্চ সংখ্যক ওডিআই ম্যাচ আয়োজন করা শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের যাত্রার শুরুও হয়েছে মিরপুরের থেকে প্রায় ২২ বছর আগে। ১৯৮৪ এর এশিয়া কাপ দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই ভেন্যুতে ওডিআই হয়েছে ২৪০ টি। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের হোম ভেন্যু হিসেবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়ে আসা এই স্টেডিয়ামকে বাদ দিলে পরের অবস্থানে থাকা “সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে” ম্যাচ হয়েছে ১৫৯ টি। মানে আর ৫০ টি ম্যাচ আয়োজিত হলেই সিডনিকে ছাড়িয়ে যাবে আমাদের শের-ই-বাংলা। ততদিনে হয়তো সেখানে আর ১০-১২ টি ম্যাচ হবে; সে হিসেবে এভাবে চলতে থাকলে ২য় অবস্থানে একদিন পৌঁছাবেই এই স্টেডিয়াম সেটি অনুমেয়ই। আর সেটাও হবে সব থেকে কম সময়েই।
শুরুর ১৫ বছর পরই মিরপুর আছে সর্বোচ্চ সংখ্যক একদিনের ম্যাচ আয়োজনের তালিকার ৬ নম্বরে। মিরপুরের আগে থাকা স্টেডিয়ামগুলোর এই ফরমেটে যাত্রা শুরু অন্তত ১৯৯২ সালের আগে আর মিরপুরের পরে থাকা পরবর্তী ১৪ টি স্টেডিয়ামের সবারই যাত্রা শুরু অন্তত ১৯৯৭ সালের আগে। ২০০১ থেকে যাত্রা শুরু করে শ্রীলংকার ডাম্বুলায় ম্যাচ হয়েছে ৫৫ টি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবথেকে ছোট সংস্করণ টুয়েন্টি-টুয়েন্টি আয়োজনের ক্ষেত্রে শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম আরও উপরে। পুরো ক্রিকেট বিশ্বের মোট ১৪৭ টি টি-টুয়েন্টি ভেন্যুর মধ্যে ম্যাচ আয়োজনের দিক থেকে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটের অবস্থান ৩য়। ২ এ থাকা “শেখ আবু জায়েদ স্টেডিয়াম”-এর থেকে মিরপুর পিছিয়ে মাত্র ১ টি ম্যাচ আয়োজনে। শের-ই-বাংলায় হওয়া ম্যাচগুলোর মধ্যে অবশ্য বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলোও আছে, তবে সেরকম টুর্নামেন্টতো অন্যান্য দেশেও হয়; তাই আপাতত শুধু সংখ্যাটাকেই আমলে নেয়া হলো।
শুধু টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বিসিবি সমতা করে চলে। শের-ই-বাংলা আর জহুর আহমেদে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচ সংখ্যা ২১ আর ২০; সর্বোচ্চ ম্যাচ হওয়া স্টেডিয়ামের তালিকায় অবস্থান ৪১ আর ৪৩। ঘরোয়া ক্রিকেটের সবথেকে জাকজমকপূর্ণ আসর বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগকে। সেই বিপিএলেরও অধিকাংশ ম্যাচ এই মিরপুরেই আয়োজিত হয়ে থাকে বছরের পর বছর ধরে। এবছর আয়োজিত বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ আর বঙ্গবন্ধু টি২০ কাপ দুটোও আয়োজিত হয়েছে ওই মিরপুরেই।
ঢাকার বাইরে খেলা না হওয়ার মূল অজুহাত থাকে যাতায়াত আর হোটেল ব্যবস্থা। তবে যাদের নিয়ে সেই অভিযোগ করার সুযোগ নেই সেই ভেন্যুগুলোতেও তো নিয়মিত আয়োজিত হয় না ক্রিকেট। নতুন যাত্রা শুরু করা সিলেট স্টেডিয়ামে খুব ঘটা করে প্রথম টেস্ট খেলার পর সেখানে গড়ায়নি আর কোনো টেস্ট ম্যাচ।
স্টেডিয়ামের সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়ছেই। শহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়াম, শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামের সাথে জেলা স্টেডিয়ামগুলো আগে থেকেই আছে, সাথে নতুনের মধ্যে কক্সবাজারের শেখ কামাল স্টেডিয়াম। কিন্তু খেলা যদি ঘুরেফিরে ওই মিরপুরেই হয়, সাথে ঢাকার বাইরেও ক্রিকেট নেয়া হয় এটা বুঝাতে ওই জহুর আহমেদেই আটকে থাকে তবে লাভটা কতটুকু? একেক ভেন্যুর উইকেট একেকরকম তৈরি করে ক্রিকেটারদের তৈরি করা যেত, যা না করে পরে থাকা হয় শুধু মিরপুরের রহস্যময়ী স্পিন পিচেই। নতুন স্টেডিয়াম তৈরিতে হাত দিয়েছে বিসিবি। কে জানে, হয়তো ওটা চালু হওয়ার পর মিরপুরেও হবে শুধু জাতীয় লিগ।
দিনের পর দিন একই স্টেডিয়ামে খেলার ফলে আমাদের ক্রিকেটাররাও করছেন একই ভেন্যুতে সর্বোচ্চ রান, উইকেটের রেকর্ড। একদিনের ক্রিকেটে একই ভেন্যুতে সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, তার পরেই আছেন সাকিব আর ৫ম অবস্থানে মুশফিকুর রহিম। সবধরনের টি২০ তে হিসাব করলে তালিকার ২য়, ৩য় আর ৪র্থ ব্যাটসমান আমাদের মুশফিক, তামিম আর মাহমুদুল্লাহ। শুধু আন্তর্জাতিক টেস্ট, টি২০, ওডিআই ম্যাচের রান একসাথে করলে প্রথম ৩ জনই আমাদের দেশের।
একই ভেন্যুতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের দিক দিয়েও বাংলাদেশিরাই এগিয়ে। আন্তর্জাতিক টি২০ তে একই ভেন্যুতে ২৭ উইকেট নিয়ে তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশের পেসার আল আমিন হোসাইন, পরের অবস্থান সাকিব আল হাসানের, ৪ নাম্বারে মুস্তাফিজুর। আর একদিনের ক্রিকেটে ২য় সাকিব, ৪র্থ মাশরাফি আর মুরালিধরনের সমান ৭৫ উইকেট নিয়ে ৬ষ্ঠ আব্দুর রাজ্জাক। ৬৫ উইকেট নিয়ে ৮ম অবস্থানটা রুবেল হোসেনের।
এই রেকর্ডগুলো দেশের ক্রিকেটের জন্য কতটাই বা উন্নয়ন বয়ে আনে বা আনতে পারে? বিসিবি কি আদৌ পারবে এক স্টেডিয়ামের মোহ থেকে বের হয়ে দেশের ক্রিকেটকে পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিতে? নাকি এমনটা চেয়ে চেয়ে নিজেদের হতাশাই বাড়িয়ে যাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সমর্থকেরা। টিভি পর্দাতেই কি তাদের ক্রিকেট দেখে যেতে হবে দিনের পর দিন, নাকি নিজ জেলার স্টেডিয়ামে গিয়ে গ্যালারিতে বসে একসাথে চিৎকার করে গলা ফাটাতে পারবে টাইগারদের জন্য? উত্তরের আশায় এখনো চাতক পাখির মতোই অপেক্ষায় থাকে অসংখ্য দর্শক। উত্তরটা কবে পাবে তা জানেনা; মনে প্রশ্ন জাগে “আদৌ কি পাবো উত্তর?” ।
- 0 মন্তব্য