• দাবা

দ্যা কুইন’স গ্যাম্বিটঃ ৬৪ বর্গক্ষেত্রের এক প্রডিজির গল্প

পোস্টটি ২৩৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

স্পয়লার অ্যালার্টঃ আপনি যদি সিরিজটি দেখে না থাকেন এবং ভবিষ্যতে দেখার ইচ্ছে থাকে, তাহলে লেখাটি আর না পড়াই ভালো হবে।

 

 

সিরিজটার ট্রেলার প্রথম যখন বের হলো, খুব বেশী মানুষ যে আগ্রহী হয়েছিলো তা বলা যাবে না। ওয়াল্টার টেভিস এর লেখা "দ্যা কুইন'স গ্যাম্বিট" উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ১৯৮৩ সালে। উপন্যাসটাও খুব একটা সাড়া জাগানো কিছু ছিলো না। কাজেই এই উপন্যাস থেকে অ্যাডাপ্ট করে স্কট ফ্র্যাংক এবং অ্যালান স্কট যখন সাত পর্বের মিনি সিরিজ নির্মাণ করলেন, সেটার ট্রেলার দেখে রিলিজের আগে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার বিষয়টা ঠিক ছিলো না। অথচ গত অক্টোবর মাসে নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর ২০২০ সালের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিজে পরিণত হয়েছে এটি। প্রথম মাসেই ৬২ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে নেটফ্লিক্সে।

তাহলে কি আছে এই সিরিজে যার কারণে তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে? দাবার মত ক্লাসিক একটা গেমকে একইসাথে সুন্দরভাবে পোর্ট্রে করা, সাধারণ মানুষের মধ্যে খেলাটার প্রতি আগ্রহ তৈরী করা, স্টোরিটেলিং, ড্রামা সব মিলিয়ে প্যাকেজ বলা যায় কুইন'স গ্যাম্বিট। আপনি দাবা খেলা না বুঝলেও সিরিজটা এনজয় করতে পারবেন। আর দাবার প্রতি আগ্রহ থাকলে তো কথাই নেই। সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলার যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নির্মাতাদ্বয়, তাতেই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে সিরিজটি।

1

গল্পের শুরুটা হয় কার ক্র্যাশে মাত্র নয় বছর বয়সে মা কে হারিয়ে এলিজাবেথ হারমন এর কেনটাকির ব্যারেন মেথুয়েন হোম ফর গার্লস এ আসা দিয়ে। প্রায় জেল সুলভ এই হোমে জোলিন এর সাথে পরিচয় হয়। তার সাহচর্যেই "গ্রিন পিল" তথা ট্রাংকুলাইজারে আসক্ত হয়ে ওঠে বেথ হারমন। এক সময় জ্যানিটর মিঃ শাইবেল কে দাবা খেলতে দেখে আগ্রহী হয়ে উঠে বেথ। রাতে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কল্পনায় দাবার বোর্ডে ঘুঁটি সাজিয়ে খেলতে থাকে সে। মিঃ শাইবেল আবিষ্কার করে এক চেস প্রডিজিকে। অসম এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।

2

দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে বেথ হারমনকে অ্যাডাপ্ট করে লেক্সিংটন এর এক অসুখী দম্পতি। এই পর্ব থেকেই মূল চরিত্রে নিজের কারিশমা দেখানো শুরু করেন "দ্যা উইচ" খ্যাত অভিনেত্রী অ্যানা টেলর-জয়। তাকে দত্তক নেওয়া মা অ্যালমা এর প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ট্রাংকুলাইজার নেওয়া শুরু করে বেথ। এর মধ্যে দাবার নেশা যায় নি। চেস ম্যাগাজিনে কেনটাকি ওপেনের কথা পড়ে রেজিস্ট্রেশন করতে চায়। অ্যালমা থেকে সাহায্য না পেয়ে অসম বন্ধু শাইবেলকে চিঠি দিয়ে সাহায্য চায়। আনরেটেড প্লেয়ার হিসাবে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হ্যারি বেল্টিক (হ্যারি পটার এ হ্যারির কাজিন ডাডলির চরিত্রে অভিনয় করা হ্যারি মেলিং) কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় বেথ হারমন। এরপর থেকেই দাবার জগতে উত্থান শুরু। সিনসিনাত্তি ওপেন, লাস ভেগাস ওপেন, একে একে বড় বড় সব টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ শুরু এবং বিজয়ী হওয়া। তার অসুখী মা, অ্যালমা তার এজেন্ট হিসাবে সঙ্গী সবখানে। লাস ভেগাসে ইউএস চ্যাম্পিয়ন বেনি ওয়াটস এর কাছে প্রথমবারের মত প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে হারের স্বাদ পায় বেথ।

3

এর মধ্যে মাথায় ঢুকে গেছে বিশ্বসেরা হতে হলে রাশিয়ানদের সাথে টক্করে জিততে হবে। হারাতে হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভাসিলি বোরগভকে। মেক্সিকো তে এক টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে বোরগভের সাথে প্রথম দেখা হয় বেথ এর। হেরে যায় সেই ম্যাচ। ওখানেই বেথ এর জীবনে আসে নতুন ধাক্কা, মেক্সিকোতেই মা অ্যালমা মারা যায়।

মা কে হারিয়ে কিছুটা বিপর্যস্ত বেথকে ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে হ্যারি বেল্টিক। ওহায়ো তে হওয়া ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে বেনি ওয়াটস কে হারিয়ে অবশেষে এককভাবে ইউএস চেস চ্যাম্পিয়ন হয় বেথ হারমন। সামনে আর তার শুধু একটাই পরীক্ষা। রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার ভাসিলি বোরগভকে হারিয়ে বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় পরা, যেটাকে আপনি বলতে পারেন বেথ হারমনের "ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার"।

প্যারিস ইনভাইটেশনালে যাওয়ার আগে বেনি ওয়াটস এর সাথে থেকে প্রস্তুতি নেয় বেথ। প্রস্তুতিতে হয়তো ঘাটতি ছিলো না, কিন্তু বোরগভের সাথে ম্যাচের আগের রাতে ফোকাস হারিয়ে সারা রাত পার্টি করা, পরদিন অমনোযোগী খেলা, রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারের সামনে রীতিমত বিপর্যস্ত বেথ হারমন। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে একঘরে করে ফেলা বেথ হারমনকে উদ্ধারে এবার এগিয়ে আসে তার মেথুয়েন এর বন্ধু জোলিন। তার কাছেই শাইবেল এর মৃত্যু সংবাদ পায় বেথ। মেথুয়েন হোমের সেই পুরানো বেসমেন্ট, যেখানে তার দাবায় হাতেখড়ি শাইবেল এর কাছে, সেখানে যায়। দেখে তার কেনটাকি ওপেনে অংশগ্রহণের জন্যে সাহায্য চেয়ে পাঠানো চিঠি, তাকে নিয়ে পেপার কাটিং সব সযতনে রেখে দিয়েছিলো তার অসম বন্ধু মিঃ শাইবেল।

তার প্রতি শাইবেল এর এই ভালোবাসাটাই আবার বেথকে ফোকাসে ফিরিয়ে আনে। মস্কো ইনভাইটেশনালে গিয়ে বাঘা বাঘা সব রুশ দাবাড়ুকে হারিয়ে ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হয় বোরগভের। প্রথমদিন অসমাপ্ত থাকে খেলা। রাতে বেনি ওয়াটস আর হ্যারি বেল্টিক সহ আরো দাবাড়ু বন্ধুরা মিলে সুদূর আমেরিকা বসে পরদিনের সম্ভাব্য খেলার অ্যানালাইসিস করে দেয়। পরদিন কিছুটা সেই অ্যানালাইসিস, কিছুটা নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বোরগভকে হারায় এলিজাবেথ হারমন, হয়ে উঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

4

এই সিরিজের সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, দাবা ম্যাচগুলোর স্ক্রিনপ্লে লেখার জন্যে কনসালটেন্ট হিসাবে ছিলেন সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও দাবা কিংবদন্তি গ্যারি কাসপারভ এবং নিউ ইয়র্ক সিটি দাবা কোচ ব্রুস প্যান্ডোলফিনি। ফলে ম্যাচগুলো ছিলো জমজমাট এবং বাস্তবসম্মত। যারা দাবা ভালোবাসেন, নিয়মিত খেলে থাকেন, তাদের জন্যে ম্যাচগুলো ছিলো তাই অত্যন্ত উপভোগ্য। বোরগভের সাথে বেথ এর ফাইনাল ম্যাচটাই যেমন ছিলো খ্যাতিমান দাবাড়ু ভ্যাসিলি ইভানচুক ও প্যাট্রিক উলফ এর মধ্যকার ১৯৯৩ সালে বিয়েলস ইন্টারজোনাল এর ম্যাচের আপডেটেড ভার্সন।

অভিনয়ের কথা বলতে গেলে বেথ হারমনের চরিত্রে টেলর-জয় ছিলেন অনবদ্য। সাধারণ এক বালিকা থেকে স্টাইলিশ আইকন এক তরুণীতে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তবে নজর কেড়েছেন জোলিন চরিত্রে নবাগতা মোসেস ইনগ্রাহাম। দাবার জগতের বেশীরভাগ মানুষও প্রশংসায় ভাসিয়েছেন সিরিজটিকে। যদিও বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন ৬ এ ৫ স্টার দিয়েছেন দাবায় বেথ এর এত দ্রুত অ্যাডাপ্ট করার ক্ষমতা দেখে। তার মতে বিষয়টা বাস্তবসম্মত হয়নি। তবে দ্রুত কাহিনী আগানোর স্বার্থে ওইটুকু মনে হয় ক্ষমা করাই যায়।

পুরো কাহিনীতে কিছুটা অপূর্ণতাও আছে। মিঃ শাইবেলের সাথে যে অসম বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো বেথ এর, সেটা অসম্পূর্ণই রয়ে গেলো। বেথ কেন কখনো আর শাইবেল এর সাথে দেখা করেনি কিংবা বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে কেন তাকে দাবা শেখানোর জন্যে, এমনকি তার বিগ ব্রেক কেনটাকি ওপেনে অংশগ্রহণে সাহায্যের জন্যে শাইবেল এর অবদান ওভাবে তুলে ধরে নি, সেটা জানা গেলো না। তাছাড়া টাউন্স এর সাথে তার রোমান্টিসিজমটাও কেমন যেন খাপছাড়া মনে হলো।

সিরিজটির সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা এটাই যে, সাধারণত যে দাবাকে আনগ্ল্যামারাস হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের বহুগুণে। দাবা বোর্ড ম্যানুফ্যাকচারারদের তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিক্রী ২১৫% থেকে ১০০০% পর্যন্ত বেড়ে গেছে। চেস ডট কমে শুধু গত নভেম্বর মাসেই ২.৮ মিলিয়ন নতুন খেলোয়াড় রেজিস্ট্রেশন করেছেন।

new member

আরো ইন্টারেস্টিং তথ্য হচ্ছে মহিলা দাবাড়ুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

female member

আমি নিজেই প্রায় ১৮ বছর পরে আবার নতুন করে দাবা খেলা শুরু করেছি নিয়মিতভাবে।

সব মিলিয়ে খুব বেশী টুইস্ট আর ড্রামা নির্ভর না হলেও সাত পর্বের এই মিনি সিরিজটি আপনাকে ৬৪ বর্গক্ষেত্রের বোর্ডটায় আকৃষ্ট করবে, তা বোধহয় বলাই যায়।

 

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ উইকিপিডিয়া, চেস২৪.কম, নেটফ্লিক্স, ব্লুমবার্গ