• ক্রিকেট

শচীন সাম্রাজ্যের নেপথ্যে

পোস্টটি ১০৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৬ই নভেম্বর ২০১৩, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে চলছে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ২য় টেস্টের ৩য় দিন; ম্যাচটা শেষ হয়ে যাবে সেদিনই এটা অনেকটাই নিশ্চিত ছিলো। তাই তো, স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরে গণমানুষের জটলা। না, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ভারতের ম্যাচে সেদিন বিশেষ কোনো রেকর্ড হচ্ছিলো না, যার কারণে এতো ক্রিকেট সমর্থক ভিড় করতে থাকবে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের ভেতরে-বাহিরে। কারণটা অন্য, কারণটা ক্রিকেট রাজ্যের রাজার বিদায়, কারণটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের বিদায়, কারণটা একশোটি আন্তর্জাতিক শতকের মালিকের বিদায়ের দিন হতে যাচ্ছে ১৬ই নভেম্বর ২০১৩।

 

শুধু স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাহিরেই সমর্থকের ভিড় না, স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকে মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের জায়গা করে দেয়াতেও। স্টেডিয়ামের মূল ফটকের বাইরে সেদিন ছিলো বিশাল সব ব্যানার। যার একটিতে “বিএস: বিফোর শচীন” এবং “এএস: আফটার শচীন” নামে ক্রিকেট ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলো কিছু সমর্থক। এই শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের পুরো ক্যারিয়ারতো দূরে থাক, শুধু তার বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে লিখতে বসলেও বিশাল এক বই লিখে ফেলা যাবে অনায়াসে। যে সাধ্য আমার নেই; তাই আমার চেষ্টা এই শচীন নামক সাম্রাজ্যের নেপথ্যের কিছু গল্প। সেটা অবশ্যই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুর আগের গল্প, ছোট্ট শচীনের গল্প।

 

ক্রিকেটের প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা, একাগ্রতা না থাকলে শচীনের মতো ক্যারিয়ার গড়া যায় না। এই ভালোবাসার শুরু-একাগ্রতার শুরুটা শচীনের ছোটবেলা থেকেই। যা ভালো লাগবে তা অর্জন করে তবেই ছাড়বে। এই মনোভাবের শুরুটা বাচ্চা শচীনের থেকেই। “বাইসাইকেল আর শচীন” নামক গল্প দিয়েই শুরু করা যাক তবে।

 

ছোট শচীনের বাইসাইকেল চাই। মুম্বাই শহরে ৪ সন্তানের পরিবারের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতেই যে হিমসিম খেতে হয় সেটা বুঝার ক্ষমতা তো তার তখনো হয়নি, তাই তার বাইসাইকেল চাই-ই চাই। বাইসাইকেল না পেলে বাসার বাইরে বেরোবে না। যেই কথা সেই কাজ, পুরো এক সপ্তাহ বাইরে বের হয়ে খেলার মতো অবশ্য পালনীয়-অতীব লোভনীয় ব্যাপারটিকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবস্থান বাসাতেই। একদিন তো বারান্দার গ্রিলের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে মাথাটাই ঢুকিয়ে দিয়েছিলো; বের করতে পারেনি। প্রায় আধাঘন্টা ওভাবেই আটকে থাকতে হয়েছে শচীনকে।

 

কি আর করা? বাইসাইকেল তো দিতেই হবে, সাংসারিক হিসেব-নিকেশ নতুন করে কষে বাইসাইকেলের টাকাটা আলাদা করে নতুন একটা সাইকেল কিনে এনে দিলো আদরের ছোট ছেলেকে। যদিও প্রথমদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েই একটা এক্সিডেন্ট করে বসে শচীন রমেশ। ডান চোখের উপরে দিতে হয়েছিলো ৮ টি সেলাই। চাওয়াকে পাওয়াতে পরিণত করার শচীনের এই নেশাটা শিফট করে ক্রিকেটের উপর। ক্রিকেটই ধ্যান, ক্রিকেটই জ্ঞান, ক্রিকেটই সব বনে যায় শচীনের জীবনে তখন থেকেই।

 

একটু এগিয়ে গিয়ে শুরু করা যাক। ১২ বছর বয়সী শচীন শিবাজী পার্কে চলমান এক ম্যাচে তার দলের অধিনায়ক। দলের নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইনজুরড হয়ে মাঠ ছেড়েছে। দলপতি শচীন টিমের অন্য সবাইকে জিজ্ঞেস করলো কেউ উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে চায় কি না? কেউ কোনো উত্তর দিলো না। অধিনায়ক হিসেবে অন্য কাউকে জোড়পূর্বক সেখানে পাঠানোর চেষ্টাও করেনি সে, গ্লাভস হাতে নিয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে গেলো উইকেটের পেছনে। উইকেটরক্ষক হিসেবে এটাই শচীনের প্রথম, শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে সেখানে দাঁড়ানো মোটেও সহজ না। স্বাভাবিকভাবেই আঘাত পেলেন; চোখের নিচে, রক্তে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা।

 

ট্যাক্সিতে আসার টাকা নেই, বাসে এই রক্তাক্ত মুখ আর জামা নিয়ে উঠতে ভয়, বন্ধুর সাইকেলের উপর ভরসা করলেও ব্যস্ততম মুম্বাইয়ের রাস্তায় সেটাও অসম্ভব প্রায়। হেটেই ফেরে বাড়িতে।

 images7

ইনজুরড হওয়ার কারণ শুধু শূন্য অভিজ্ঞতা নয়। যে পিচে তাদের খেলানো হতো সেটাও কারণ। আর উইকেটের পেছনে না দাঁড়িয়েও বহুবার আঘাত পেয়েছেন, কারণটা ছিলো, “হেলমেট নিষিদ্ধ” যাতে করে বল ছেড়ে দেয়ার আর্টটাতে অনেক বেশি দক্ষ হতে পারে ক্ষুদে এই ক্রিকেটাররা।

 

শচীনের স্কুলে যাওয়া যাক। স্কুলের ছুটির দিনগুলো দিয়েই শুরু করি। ৬০ দিনের লম্বা এক গ্রীষ্মের ছুটিতে শচীন প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিলো ৫৫ টি। এটুকুতেই অবাক? তাহলে তার সেই ছুটির দিনগুলোর রুটিনটাতে চোখ বুলানোর আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিন।

 

সকাল সাড়ে ৭ টার আগেই মাঠে উপস্থিত থাকা, সাড়ে ৭ টা থেকে ২ ঘন্টার অনুশীলন শুরু। ২ ঘন্টায় মোট ৫ টি নেট সেশন। ২ ঘন্টার প্র্যাকটিস সেশন শেষ করে শচীনের গন্তব্য ছিলো সোজা প্র্যাকটিস ম্যাচে। বিকেল সাড়ে ৪ টায় যখন ম্যাচ শেষ হয়, ততক্ষণে শক্তি, উদ্দম, ইচ্ছা সবই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শচীন যে ভালোবাসতো ক্রিকেটকে। ৩০ মিনিটের ছোট একটা বিরতির পর শচীন আবার শুরু করতো তার সন্ধ্যার সেশন। সকালের মতোই ২ ঘন্টায় ৫ নেট সেশন শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ৭ টা। এখানে শেষ হলেও মানা যেত। কিন্তু এখানেই যে শেষ না… …

 

ফাইনাল সেশন নামে ১৫ মিনিটের আরেক সেশন। স্ট্যাম্পের উপর ১ রূপির এক কয়েন রাখতো শচীনের কোচ রমাকান্ত আর্চেকার, প্রত্যেক বোলার বল ছুড়তো, ফিল্ডিং করতো ১৬-১৭ জন। এর মধ্যে শর্ত থাকতো, “একবারও যদি আউট না হয়ে ১৫ মিনিট শেষ করতে পারে শচীন, তবেই শচীন পাবে স্ট্যাম্পের উপর রাখা সেই ১ রুপির কয়েন খানা” । এই কঠিন চ্যালেঞ্জের ভেতর থেকেও ১৩ টি কয়েন নিজের করে নিয়েছিলো সেদিনের সেই ছোট্ট শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।

 

ফাইনাল সেশন নাম দেখে ভেবেছিলেন এখানেই শেষ? মোটেও না! প্যাড আর গ্লাভস পরেই পুরো শিবাজী পার্কের চারপাশ দিয়ে দৌড়াতে হতো দুইবার। বুঝুন তবে, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা কতটা ছিলো শচীনের!

 

স্কুলের গল্পে যখন আছি তখন স্কুল নিয়েই ছোট করে আরেকটু বলে ইতি টানা যাক। শচীনের স্কুল আর শিবাজি পার্কের মাঝে দূরত্বটা ছিলো প্রায় দেড় ঘন্টার বাসের রাস্তা। এর উপর আবার প্র্যাকটিস শেষ করেই বাসের জন্য ছুটতো হতো শচীনকে, মিস করে গেলেই স্কুলে পৌঁছাতে দেড়ি হতো।

 19059931_1557123714311822_6223170341171008435_n

গল্প আরও অনেক আছে, করলে করা যাবে অনেক্ষণ। তবে আর করতে চাচ্ছি না। সেই শচীন বিনোদ কাম্বলির সাথে গড়েছিলো ৬৬৪ রানের জুটি, রঞ্জি ট্রফি-দিলীপ ট্রফি-ইরানী ট্রফি; ৩ টুর্নামেন্টেই অভিষেক ম্যাচে করেছিলেন শতক। জাতীয় দলের শচীনের গল্পটা তোলা থাকুক অন্য কোনো দিনের জন্য, ছোট শচীনের গল্পটার সমাপ্তি আপাতত টানতে হচ্ছে এখানেই। প্রতিজ্ঞা, ভালোবাসা, ভালোলাগা, স্বপ্ন সবই যার ছিলো ক্রিকেটকে ঘিরে- ক্রিকেট নামক খেলাটার সর্বকালের সেরা সে হবে না তো কে হবে?

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: Playing it My Way: My Autobiography এবং শচীন টেন্ডুলকারের ফেসবুক পেজ।