বাংলার ফুটবল মুক্তির ৬-দফা (৭ম ও শেষ পর্ব); ফুটবলের ক্লাবে জুয়া নয়, জুয়ার ক্লাবে লোক দেখানো ফুটবল সরিয়ে ফেরাতে হবে সত্যিকারের ফুটবল
পোস্টটি ১০১০ বার পঠিত হয়েছে
দুই যুগ আগের ফুটবলারদের দলবদলকে কেন্দ্র করে থার্মোমিটার ভাঙ্গা উত্তেজনার পারদের ছিটেফোঁটাও আজ অবশিষ্ট নেই। ম্যাচের দিনগুলোতে ক্লাব সংশ্লিষ্টদের উত্তেজনার চোরা শিহরণ ছুঁয়ে যেত শহরের ফুটবলানুরাগীদের। লীগের হলে তো কথাই নেই, মৌসুমের প্রাক টূর্ণামেন্টগুলোর শিরোপা বিজয়ের রাতেও শহরের প্রত্যেকটি অলি-গলি, রাজপথের আকাশ ঝিকমিক করত সাদা-কালো অথবা আকাশী-হলুদ আনন্দে। স্টেডিয়াম থেকে ফিরে যাওয়ার পথগুলো প্রকম্পিত হত বিজয় কেতন ওড়ানো উৎযাপনে।
চিত্রঃ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। আশির দশকে চিরপ্রতিদ্বন্দী আবাহনীর সাথে ম্যাচের আগে; Image Source: The Business Standard
পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিং, প্রতিপক্ষ ক্লাবগুলোর ম্যাচ পাতানো, পরবর্তী মৌসুমের জন্য গোপনে খেলোয়ারদের দলে টানার নীল নকসার মত অসংখ্য ষড়যন্ত্রে ক্লাব পাড়াগুলোর আকাশ বাতাস গরম থাকতো পুরো মৌসুম জুড়ে। ক্লাবের চারপাশের অধিকাংশ আলোচনার বিষয়গুলো সত্য-মিথ্যায় মেশানো, সন্দেহর বীজে পরিপুষ্ট হতো, তবে ফুটবলের প্রতি ভালবাসা থাকতো টান টান। ফুটবল ক্লাবে নেতিবাচক হলেও ফুটবলকে ঘিরে থাকা গরম বাতাস, মন্দ কি? যুগ বদলালো। ফুটবল অন্তঃপ্রাণ সেই ক্লাব সংগঠকদের পেছনের আসনে বসিয়ে চালকের আসন দখলে নিলেন রাজনীতিক আর ব্যবসায়ীরা। দলীয় ফর্মেশন আর প্রতিপক্ষের চুল চেরা বিশ্লেষণ করে ম্যাচের ফর্মেশন আর দলীয় পরিকল্পনায় বুদ থাকা ক্লাব টেবিলগুলো কালের বিবর্তনে হয়ে উঠলো চকচকে জুয়ার টেবিল।
প্রতি সন্ধ্যায় চাঁদের কোমল আলোয়, ঝিরিঝিরি বাতাসে ক্লাব প্রাঙ্গণগুলোতে ক্লাব কর্তারা আজও বসেন চেয়ার বিছিয়ে। ধুম্রশলাকার ধোঁয়ায় ঢাকা আড্ডায় কি করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায়, ব্যবসায় রোজগার বাড়াতে কি করে কলকাঠি নাড়ানো যায়, এসব নিয়ে আলোচনাও হয় প্রচুর। শুধু ফুটবলের আলোচনাটাই হয়না। ফুটবল ক্লাব ঘিরে মধ্যরাত পর্যন্ত চলা সেই আড্ডায় ফুটবলের নিঃশব্দ কান্না শোনার জন্য কোথাও কেউ নেই। এভাবে হয়না। কখনো হবেনা। ক্লাব ভিত্তিক খেলা ফুটবলে সবার আগে ফেরাতে হবে ফুটবলের আলোচনা। চালকের আসনে ফেরাতে হবে সত্যিকারের ফুটবল সংগঠকদের যারা মৃতপ্রায় ফুটবলকে ব্যবহার করে ব্যবসা খুজবেননা, ব্যবসাকে ব্যবহার করে ফুটবল বাঁচানোর পথ খুজবেন। আর সমূলে তাড়াতে হবে রাজনীতি। খেলার মাঠে রাজনীতির স্থান নেই। পাকিস্তানের ফুটবলে আছে, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটেও। দুটোই ধবংশের দ্বারাপ্রান্ত। ক্লাব ফুটবলের বাৎসরিক সূচী বছরের শুরুতে দিতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অভ্যস্ত বাফুফেকে ঢেকুর তোলা বন্ধ করে কিছু আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা মধ্যবয়স্ক ফুটবলারদের স্কিল শেখানোর সুযোগ নেই। এর অনেক আগেই মাসেল মেমরি রপ্ত হয়ে যাওয়ায় ফুটবলের অধিকাংশ স্কিলই মধ্যবয়সে নতুন করে শেখা যায়না। আধাপুরান ব্যাটারিতে হৃতপিন্ড ঘড়ির দম বাড়ানো যায়না। তাই ফুটবল আর পরিশ্রম দুটোই রপ্ত করার আদর্শ জায়গা হচ্ছে বয়সভিত্তিক দলগুলো। একথা বললে বাফুফের সাথে ক্লাব কর্তারাও গলা মিলিয়ে বলবে, “কথা সত্য”। তবে বলা পর্যন্তই। বয়সভিত্তিক দল গড়ার ব্যপারে ক্লাবগুলোর ইচ্ছা নেই। কারণ ঐ একটাই। ফুটবলের উন্নতি নয়, তাদের উদ্দেশ্য ব্যবসার উন্নতি। প্রিমিয়ার ডিভিশনের ক্লাবগুলোর বাধ্যতামূলক দুইটি বয়সভিত্তিক দল থাকার চিন্তাটা মোটেই বাড়াবাড়ি বা বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। পুর্নাংগ কোচিং স্টাফসহ অনুর্ধ্ব ১৬ ও ১৯ দলকে গড়ে তোলার আর্থিক সক্ষমতা ক্লাবগুলোর যথেষ্টই আছে। প্রিমিয়ার লীগে খেলাতে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আফ্রিকান ফুটবলারদের ধরে আনা হয় তার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ বাজেট রাখলেই অনুর্ধ্ব ১৬ ও ১৯ দলের বছরের সব কার্যক্রম চালানো সম্ভব। প্রিমিয়ারের প্রত্যেক ক্লাবের বাধ্যতামূলক অনুর্ধ্ব ১৬ ও ১৯ দল থাকার বিধান রেখে লীগের পাশাপাশি ক্লাবভিত্তিক অনুর্ধ্ব ১৬ ও ১৯ টূর্ণামেন্টের আয়োজন করতে হবে বাফুফেকেই। এই টূর্ণামেন্ট ঘিরেই তরুণ দলগুলো সারা বছর নিজেদের শাণিত করবে। ব্যপারটাকে আরও উৎসাহিত করতে প্রিমিয়ার ডিভিশনে প্রত্যেকটি ক্লাব দলের ম্যাচ একাদশে তাদের বয়সভিত্তিক দল থেকে কমপক্ষে এক জনের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তির বিধান রাখা যেতে পারে। শুভংকরের ফাঁকি ঠেকাতে বিজ্ঞানসম্মত বয়স নির্ণয়ের সুবিধাও রাখতে হবে অত্যাবশ্যকীয় ভাবে। জন্মকাগজ মতে যে দেশের অর্ধেক মানুষের জন্ম জানুয়ারির ১ তারিখে, সেই দেশের মানুষের জন্মকাগজ দিয়ে সব হতে পারে, বয়সভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ছাড়া, এ কথার যথার্থতা তুলে ধরতে আলাদা যুক্তি প্রদর্শনের বোধ করি প্রয়োজন নেই।
যে দেশে ১৪-১৬ বছর বয়সী কিশোরদের ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখার জন্য কোন বাস্তব রাস্তা খোলা নেই, সেই দেশের ফুটবল এগোবেনা। ক্লাবগুলো তাদের দায় এড়ালে ফুটবলের মুক্তি নেই। ফুটবলকে মুক্ত করতে ক্লাবগুলোকে আগে মুক্ত করতে হবে। কাজটা সহজ নয়। ভীষণ কঠিন। তবে মুক্তির সংগ্রাম সবসময়ই কঠিন। এ সংগ্রাম, আমাদের ফুটবলের মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রাম, আমাদের ফুটবলের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় হোক বাংলার ফুটবলের।
Special thanks to Freeflagicons.com for allowing me to use the wonderful thumbnail in this blog article
- 0 মন্তব্য