• ফুটবল

আমার ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগ বেলা

পোস্টটি ২০৩৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

-"দোস্ত, রবার্টসন ইনজুরড হয়ে তো বিপাকে ফেলে দিলো। এখন ট্রেন্ট রে টিমে নিতে হইলে তো এক্সট্রা ০.৫ লাগবে। ওইটা কেমনে ম্যানেজ করি?"

বন্ধুর উত্তর, "তোর ফরোয়ার্ডে ইংস আছে না? পালটায়ে আন্তোনিও রে নে। তাহলেই হয়ে যাবে।"

-"হুম, দেখি।"

-"অথবা আরেকটা কাজ কর। রবার্টসন ব্যাক না করা পর্যন্ত সিমিকাস কনফার্ম। তুই ওরে নিয়ে যে ৩ মিলিয়ন বাঁচে ওইটা দিয়ে একটা প্রাইম মিড নিয়ে ফেল।"

এই যে দিলো তো কনফিউশনে ফেলে। দুই সপ্তাহ ধরে এই এফপিএল টিম রেডি করতেসি। প্রি-সিজন ম্যাচ, এক্সপার্ট অ্যানালাইসিস কিছুই দেখা বাকি রাখতেসি না। গুছায়ে আনসিলাম দলটা মোটামুটি। এর মধ্যে রবার্টসন ইনজুরি তে পড়ে ভেজালটা করলো। বন্ধুর সাজেশন নিতে নক দিলাম, তার পরামর্শ শুনে আরো কনফিউজড। সিমিকাস রে নিবো, কিন্তু মিলনার যদি লেফটব্যাকে স্টার্ট করে? আবার রবার্টসন ব্যাক করলে তো সিমিকাস রে বাদ দিতে গেলে একটা এক্সট্রা ট্রান্সফার করা লাগবে। মাইনাস হিট এর ঝামেলা তখন। এর মধ্যে আবার পেপ কারে না কারে স্টার্ট করায় সেই চিন্তায় ম্যানচেস্টার সিটির কোনো প্লেয়ারও নিতে ভরসা পাইতেসি না। এইদিকে ফার্স্ট গেমউইকের ডেডলাইনের বাকি আর মাত্র ৫ ঘন্টা।

এই ঘটনা মনে হয় কেবল আমার না। যারা ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগ খেলেন, সবারই শেষ মুহুর্তে কমবেশী একই অবস্থা থাকে। বিশেষ করে মাত্র ০.৫ মিলিয়ন এর জন্যে পুরো টিম ওলোট পালোট করে দেওয়ার ঘটনাও খুবই সাধারণ ব্যাপার।

আমার নিজের প্রথম সিজনের কথা এখনো মনে আছে। অফিসিয়াল ফ্যান্টাসি ওয়েবসাইটের খোঁজ তখনো পাই নি। গোলডটকমে ফুটবলের খোঁজখবর রাখতে নিয়মিত ঢুঁ মারি। এই সময় একদিন দেখলাম গোলডটকম তাদের নিজস্ব ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগ চালু করবে ২০১৩-১৪ মৌসুমে। ব্যাপারটা দেখে, নিয়ম কানুন পড়ে মজাই লাগলো। বানিয়ে ফেললাম একটা টিম। দুই গেমউইক পরে এটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আরেকজন থেকে অফিসিয়াল ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগের খোঁজ পেলাম। এরপর ওখানে রেজিস্ট্রেশন করে শুরু। একে একে ৮ সিজন শেষ আমার এফপিএল এ। যদিও এখন পর্যন্ত সেরা অর্জন একবার ওয়ার্ল্ডে টপ ১০০কে তে থাকা। তবে যারা নিয়মিত খেলেন, তারা বুঝতে পারবেন, এই নেশা অন্যরকম। দিনের পর দিন রীতিমত গবেষণা করে এক এক গেমউইকের জন্যে দল রেডি করা, মাইনাস হিট নেবো কি নেবো না, ডিফারেন্সিয়াল হিসেবে কাকে পিক করবো, মিড স্ট্রং করবো না ফরোয়ার্ড এসব চিন্তা করতে করতে মাথার চুল যায় যায় অবস্থা।

প্রথম দিকে অনেক কিছুই বুঝতাম না। মনে আছে, প্রথমবার ক্যাপ্টেন দিয়েছিলাম লেইটন বেইনসকে। ক্লিনশিটসহ ৬ পয়েন্ট দেওয়াতেই খুশী। পরদিন সেটা ৮ পয়েন্ট হয়ে গেলো দেখে তো মহাখুশী। বোনাস পয়েন্ট সম্পর্কে আইডিয়া তখনই হলো। ওইসময় ভাবতাম প্রতিপক্ষ সোজা হলে ক্লিনশিট তো পাবোই। এসব ভেবে ডিফেন্ডার এমনকি একবার লিভারপুলের তখনকার কিপার সিমন মিনিওলেটকেও ক্যাপ্টেন দিয়েছিলাম। আবার প্লেয়িং টাইম পাবে কিনা এসবও চিন্তা করতাম না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর প্লেয়ার তাই রায়ান গিগসকেও দলে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে পরিপক্ব হলাম, খোঁজ পেলাম এই সংক্রান্ত বাংলাদেশের গ্রুপ ফ্যান্টাসি ফুটবল প্লেয়ার অব বাংলাদেশ এর। ওখানে সবার সাজেশন, আলোচনা, টিম দেখতাম। এরপর প্রতি গেমউইকের আগে নিজের মত করে ট্রান্সফার করতাম, স্টার্টিং ইলেভেন ঠিক করতাম। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন্স পিক এর ব্যাপারে ওখান থেকেই আপডেট নিতাম রেগুলার। মাঝে মাঝে কেউ স্টার্ট না করলে মেজাজ হয়ে যেতো চরম খারাপ। তবে খোঁজাখুঁজি করে ফ্যান্টাসি ফুটবল স্কাউটের মত কিছু ওয়েবসাইট পাওয়া গেলো। যারা সম্ভাব্য স্টার্টিং ইলেভেন সম্পর্কে আগেই আপডেট দেয়।

তখনো ভার্সিটিতে পড়ি। একেকটা ট্রান্সফার এর আগে কত গবেষণা! যাকে আউট করতেসি তার ফর্ম কিংবা ইনজুরি থেকে ব্যাক করার সম্ভাবনা কেমন? যাকে দলে নেবো সে কেমন ফর্মে আছে কিংবা তার ফিক্সচার কেমন? আবার নতুন কেউ ট্রান্সফার হয়ে আসলে তার দাম কত হতে পারে, বেশী দিলে কেন এত বেশী দিলো সেই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। ক্যাপ্টেন ক্লিক না করলে যে হতাশা, কিংবা যারে দল থেকে আউট করবো সেই পরের গেমউইকে বেশী পয়েন্ট দিবে, আর যেই ইনফর্ম প্লেয়ারকে ট্রান্সফার ইন করবো, সেই ফর্ম হারিয়ে দুই এর নামতা গুণে পয়েন্ট দেওয়া শুরু করবে কিংবা ইনজুরিতে পড়বে এই ব্যাপারগুলো ফেইস করেননি এমন ফ্যান্টাসি ম্যানেজার এই জগতে থাকার কথা না। ডিসেম্বরে জ্যাম প্যাকড শিডিউলের কারণে কে কখন রোটেশন রিস্কে পড়ে যায় সেটা নিয়ে ভাবনা কিংবা গার্দিওলার রোটেশন নীতির কারণে প্রাইম ডিফেন্ডার বা মিডফিল্ডার বেঞ্চড হওয়াতে মুখ খারাপ করেননি এমন ম্যানেজারও পাওয়া যাবে না। এর সাথে ডাবল গেমউইকের ফাঁদে পড়ে মাইনাস হিট দিয়ে নেওয়া প্লেয়ারকে বেঞ্চড হতে দেখা কিংবা এক্সপার্ট অ্যানালাইসিস শুনে বা ফেসবুকে বিভিন্নজনের মতামত দেখে শেষ মুহুর্তে নিজের ক্যাপ্টেন চেঞ্জ করে যখন দেখবেন, আপনার ক্যাপ্টেন একটা ইয়েলো খেয়ে এক পয়েন্ট দিয়েছে আর যাকে প্রথমে দিয়েছিলেন সেই ডাবল ডিজিট দিয়েছে তখনকার কথা ভাবুন। সেই অনুভূতিটা সবার জন্যেই একই রকম। এত চিন্তাভাবনা করে টিম বানিয়ে যখন আশানুরূপ পয়েন্ট মেলে না, সেই পুরানো আপ্ত বাক্য, "ফ্যান্টাসি লিগ কোনো স্প্রিন্ট না, এটা ম্যারাথন।" মনে করে আবার পরের গেমউইকের জন্যে টিম বানাতে অ্যানালাইসিস শুরু হয়ে যায়।

আগে কেবল বড় দলগুলোর খেলাই দেখা হতো। ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগের জন্যে ওয়াটফোর্ড বনাম বার্নলি টাইপ ম্যাচগুলোও দেখা শুরু করলাম। ফুল ম্যাচ দেখতে না পারলেও হাইলাইটস হলেও দেখে নিতাম। এর মধ্যে আবার চলে আসতো কাপ। কাপে কোয়ালিফাই করতে পারবো কিনা, কোয়ালিফাই করলে অপোনেন্ট এর টিম নিয়ে আরো এক্সট্রা একদিন গবেষণা। মনে আছে একবার কাপ কোয়ালিফায়ার এর গেমউইকে সিগুর্ডসনকে স্টার্ট না করানোয় সোয়ানসি সিটির তখনকার কোচ গ্যারি মংক কে গালি দিয়ে তার গুষ্টি উদ্ধার করতে ছাড়িনি। মজার ব্যাপার, ওইবার কাপ তো কোয়ালিফাই করেছিলামই, ২৮ গেমউইক পর্যন্ত কাপে টিকে ছিলাম। অথচ এর আগে পরে সর্বোচ্চ তিন চার গেমউইকের বেশী কখনো টিকতে পারি নি।

এর মধ্যে নানান চিপ্স এর ব্যবহার শুরু হলো। ট্রিপল ক্যাপ, বেঞ্চ বুস্ট, অলআউট অ্যাটাক খেলায় নতুন মাত্রা নিয়ে আসলো। কখন চিপস খেলবো, ওয়াইল্ড কার্ড কখন ইউজ করবো এসব নিয়ে আলোচনা, গবেষণাও বাড়তে থাকলো। এফপিএল কিং আগুয়েরো, নো সালাহ নো পার্টি, নেভার ব্যাক আর্লি কিক অফ, ভার্ডি পার্টি এরকম অসংখ্য টার্মের সাথে পরিচিত হওয়া। সালাহ এর লিভারপুলের হয়ে প্রথম সিজন, মাহরেজ-ভার্ডির সেই জুটি, হ্যারি কেইনের ধারাবাহিকতা, অ্যারন র‍্যামসের সেই অবিশ্বাস্য সিজন সবকিছুই এফপিএল এর কারণে মনে হয় আরো পূর্ণতা পেয়েছে। এখনতো গ্রুপ আর পেইজগুলোতে প্রচুর প্রাইজমানি থাকে। পেইড অনেক লিগও চালু হয়েছে। লোন সারভাইভাল চ্যালেঞ্জ, ব্যাটল অব রয়্যাল, ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশিপ, বিট দ্যা প্যানেলস টিম, ওয়াকিং ডেড এরকম বিভিন্ন ইন্টারনাল লিগ চালু হয়েছে। সব মিলিয়ে এফপিএল এর মজা বাড়ছে বৈ কমছে না। গত সিজনে সম্ভবত ৮ মিলিয়ন রেজিস্টার্ড ছিলো শেষ পর্যন্ত।

ছাত্রজীবন শেষ করে প্রফেশনাল জীবনে প্রবেশ করেছি অনেক দিন হচ্ছে। এখন আগের মত দিনের পর দিন গবেষণা করে টিম বানানো হয় না। দাম বেড়ে যাওয়ার আগেই প্লেয়ার কিনবো বা কমে যাওয়ার আগেই ছেড়ে দিবো এসব কাজ করে না মাথায়। মাঝে মাঝে কাজের চাপে ডেডলাইনটাও মিস করে ফেলার দশা হয়। তবুও যখন যেখানেই থাকি না কেন, এখনো প্রথম গেমউইকের আগে ঠিকই টিম বানানো হয়। প্রতি গেমউইকের আগে চেষ্টা থাকে প্রয়োজনীয় ট্রান্সফার করে নেওয়ার। ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগের জন্যে এই ভালোবাসাটা হয়তো আজীবনই থাকবে।