ইউনাইটেড,এমইউএফসি অথবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিন্তু কখনোই ম্যান ইউ নয়।
পোস্টটি ১৬৬১ বার পঠিত হয়েছেএইতো ক্যালেন্ডারে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ মানেই ২০২১-২২ সিজনের ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের ট্রান্সফারের সামার উইন্ডো শেষ।
তর্কাতীত ভাবে এবারের উইন্ডোকে এই শতাব্দীর কিংবা ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে পাগলাটে ট্রান্সফার উইন্ডো বললে বোধ করি বিশেষ অত্যুক্তি হবে না। কি হয়নি এই সিজনে বার্সেলোনার সমার্থক শব্দ মেসি, রিয়ালের ক্লাব লিজেন্ড এবং অধিনায়ক রামোসের দল পরিবর্তন এছাড়া ইউরোর সেরা খেলোয়াড়ের ফ্রিতে দলবদল আবার পুরা সিজন জুড়ে তো এমবাপ্পে সাগা তিক-তাক চলমানই ছিলো আর এই উইন্ডোর শেষ পেরেক বোধহয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ফের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আকস্মিক প্রত্যাবর্তন..!
সংগত কারণেই রোনালদোর বিশাল ফ্যানবেজ রয়েছে এবং তাঁর এই বিশাল ফ্যানবেজটি যে রনকে সবুজ গালিচায় দৌড়াতে দেখতে যারপরনাই মরিয়া হয়ে উঠবে তা একদম সহজেই অনুমেয় যার কারণে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলাও দেখবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু ক্লাবটার নাম যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং যে ক্লাবটির সুন্দর একটি ঐতিহ্য রয়েছে তাই এর কিছু ইতিহাস না জানলেই নয় পৃথিবীর ২০০টি দেশে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন সমর্থক রয়েছে এই ক্লাবটির। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আসলে সমর্থকদের আলাদা করার একটি স্পষ্ট মানদণ্ড রয়েছে আর সেটি হচ্ছে আপনি ক্লাবের শর্ট ফর্ম ম্যানইউ ব্যবহার করছেন কিনা।
সময়টা ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৩।টার আশেপাশে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হোম ম্যাচে ২-১ গোলে জয়ের পর যুগোস্লাভিয়ার দল রেড স্টার ব্রেলগ্রেডেের সাথে তাদের মাটিতে ৩-৩ ড্র করেন যার ফলাফল দুই লেগে ৫-৪ এগ্রিগেটে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেন তৎকালীন ইউনাইটেড কোচ 'ম্যাট বাসবি' এর নামের সাথে মিলিয়ে সমর্থকদের ভালোবাসার ডাকনাম ''বাসবি বেইবস'' নামক জেনারেশনটি।
১৯৫৫ সালে শুরু হওয়া ইউরোপিয়ান কাপে(বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ) ইংলিশ লিগ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় প্রথম দুই আসরে কোন দল পাঠায়নি কর্তৃপক্ষ। যেহেতু এফএ কাপের ম্যাচ পড়তো মঙ্গলবার আর লিগম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো শনিবার। বিপত্তি এড়াতেই লীগ কতৃপক্ষ দল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে ম্যাট বাসবির অনুরোধে ক্লাবের কর্ণধারগণ লীগ কতৃপক্ষ থেকে 'বাসবি বেইবস' কে ইউরোপীয়ান শ্রেষ্ঠত্বে আসরে নামিয়েই দেন এবং ফলাফলও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ছিলো তৎকালিন ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদের সাথে সেমিফাইনালে হেরে বাদ গেলেও দলটি আশার আলো দেখিয়ে যান যা পরবর্তী আসরে তাদের মধ্যে নতুন উদ্যমে শুরু করার স্পৃহা জাগায়। সবকিছু ঠিকই ছিলো আশানুরূপ জয় নিয়ে যখন সমর্থকদের কাছে ফিরে আসতে গেলো বিপত্তি বাঁধে তখনই। তৎকালীন সময়ে
বিমান যাত্রা নিরাপদ ছিলো না কিন্তু লীগ কতৃপক্ষের রোষানলে না পড়তে চেয়ে বিমান পথেই বেলগ্রেড থেকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন যে বিমানটি পরিচালনা করেন ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজে একটি "এলিজাবেথীয়" শ্রেণীর এয়ারস্পীড অ্যাম্বাসেডর চার্টার বিমান জি-এএলজেডইউ (G-ALZU) লর্ড বার্ঘলি। বেলগ্রেড থেকে ফেরার পথে ফরোয়ার্ড জনি বেরি খুইয়ে বসেন তাঁর পাসপোর্ট যার কারণে বেলগ্রেড থেকে বিমানটি ছাড়তে দেরী হয় যেহেতু ক্লাবের ভাড়া করা বিমানটি বেলগ্রেড থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত জ্বালানি বহনের সক্ষমতা ছিলো না তাই পাইলট মিউনিখের রেইম বিমান বন্দর থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে নামে এবং জ্বালানি সংগ্রহ করে বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন জেমস থেইন টেক অফ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে দুইবারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিকাল ৩:০৪ টায় তৃতীয়বারের মত চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এবারে বিমান টেক অফের সময় তুষারের বাঁধায় নির্দিষ্ট গতি না পেয়ে যথেষ্ট উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি ফলে বিমানটি এয়ারপোর্টের সীমানা প্রাচীরে আঘাত হানে সাথে সাথে বিমানটি রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে পাশের একটা খালি বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে বাম ডানা ভেঙে ফেলে আরেকটু সামনে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় বিমানটি আর তখনই অন্ধকারে ছেয়ে যায় মিউনিখের রেইম বিমানবন্দর আর বিমানের ৪৪ জন যাত্রীর মধ্যে বিধাতার ডাকে সাড়া দেন ইউনাইটেডের ফুটবলার, ক্লাব কর্মকর্তা, সাংবাদিক সহমোট ২৩ জন।
দুর্ঘটনায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাতজন খেলোয়াড়
জিওফ বেন্ট,রজার বার্ন,এডি কোলম্যান,মার্ক জোনস,ডেভিড পেগ,টমি টেইলর এবং লিয়াম হোয়েলান ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন এবং দুর্ঘটনায় আহত ডানকান এডওয়ার্ডস কিছুদিন পর মারা যান এছাড়াও অন্য দুজন খেলোয়াড়কে দুর্ঘটনার জেরে অবসর নিতে হয় ইউনাইটেড বস ম্যাট বাসবি গুরুতর আহত হন এবং তাকে বেশ কিছুকাল হাসপাতালে থাকতে হয়। এসময় অনেকেই ধরে নিয়েছিলো যে ক্লাবটি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ইউনাইটেডের কোচ জেমস মারফি অন্তর্বর্তীকালীন ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে কোনোরকম চলতি সিজন শেষ করে নেন।
ঘটনা সেখানে শেষ হতেই পারতো কিন্তু অমানবিক,নিষ্ঠুর,নিকৃষ্ট কিছু বিরোধী দলের সমর্থক ধুঁকতে থাকা ইউনাইটেডকে মিউনিখ ট্র্যাজেডি নিয়ে খোঁচা দিতে বাদ রাখেনি।
প্রিয় ক্লাবকে ভক্ত,সমর্থকগণ উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিভিন্নরকম চ্যান্ট করে কিন্তু বিরোধী দল যখন চ্যান্ট করে সেটা অবশ্যই মক কিংবা ট্রলের জন্যই আর সেই ট্রলটি যদি হয় কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাহলে ওসব ভক্ত,সমর্থকদের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় আর মিউনিখ ট্র্যাজেডিকে ইংরেজি 'MUNCHEN' এবং ' Manchester United' এর সাথে মিল রেখেঃ-''Man U Man U went on a plane Man U Man U never come back again and Man U never intended coming home'' চ্যান্ট করে ইউনাইটেডকে অপমান করতো আর যার নেতৃত্বে ছিলো নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটি সমর্থক, আর্চ রাইভাল লিভারপুল এবং রাইভাল লীডস ইউনাইটেডের কিছু উগ্র এবং নিকৃষ্ট সমর্থকগণ।
আর এই উগ্রতার সূত্রপাত করে ওয়েস্টব্রুম ফ্যানগণ ৬ই ফেব্রুয়ারি আহত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করা ইউনাইটেড লিজেন্ড ডানকান এডওয়ার্ডসকে উদ্দেশ্য করে চ্যান্ট করে "Duncan Edwards is manure, rotting in his grave, man you are manure—rotting in your grave."
ব্যস তখন থেকেই 'Man U' অর্থাৎ 'ম্যান ইউ' শব্দটি ইউনাইটেড ফ্যানদের কাছে লজ্জার,হতাশার,বেদনার আর হ্যাটার্সদের জন্য নিকৃষ্ট,নগ্ন উল্লাসের শব্দ।
যেই ইউরোপীয়ান কাপের জন্য ইউনাইটেডের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ঠিক একই প্রতিযোগিতায় প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড জিতে নিয়েছে ইউরোপীয়ান কাপ পরবর্তীতে গ্লোরি গ্লোরি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড(GGMU) শব্দটি যদি ১৯৬৮ সালে বেনফিকাকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও প্রচলন হতো তাহলেই হয়ত শব্দটির যথার্থতা আরো বেশি ফুটে উঠতো কেননা ইংল্যান্ডকে ইউরোপীয় গ্লোরির প্রথম স্বাদতো এই ইউনাইটেডই দিয়েছে।
আপনি যদি ইউনাইটেডের পাড় ভক্ত,সমর্থক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী নাও হোন অথবা শুধুমাত্র ফুটবল ফ্যানই হোন তাহলে ইউনাইটেড,ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অথবা এমইউএফসি(MUFC) কিন্তু কখনো,কখনোই ম্যান ইউ নয়..!
যদি না আপনি একান্তই ইউনাইটেডেড চরম হ্যাটার হয়ে থাকেন..!
ছবিসত্ত্ব এবং তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া
- 0 মন্তব্য