• ক্রিকেট

ব্যর্থতার অতল গহ্বরে নিপতিত বাংলাদেশের ক্রিকেট

পোস্টটি ১৩১৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দিয়েই লেখাটি শুরু করা যথার্থ বলে মনে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে শোচনীয় পরাজয়ের পর যিনি বলেছিলেন - ''এটাই হবার কথা ছিলো। মূল কারণ সততার অভাব। ঘরোয়া ক্রিকেটকে গত কয়েক বছর যেভাবে 'ক্রিমিনালাইজ' করা হয়েছে তাতে শুধু অপেক্ষায় ছিলাম ধসটা কখন নামবে।''

 

এইদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা আছে এমন কেউই আমিনুল ইসলামের সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোন কারণ খুঁজে পাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এমন লজ্জাজনক পারফরম্যান্স কোনো 'বিনা মেঘে বজ্রপাত' হয়ে আসেনি। বরং বছরের পর বছর ধরে ডমেস্টিক ক্রিকেটে চলে আসা সীমাহীন দূর্নীতি, নির্দিষ্ট কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং, ক্রিকেট বোর্ডের কিছু অযোগ্য পরিচালকগণ যাদের 'লিডার' হিসেবে আছেন তথাকথিত 'সফলতম' প্রেসিডেন্ট আর সবশেষে জবাবদিহিতা আর মানবিহীন জাতীয় দলের ক্রিকেটার, নির্বাচকমন্ডলী আর কোচিং স্টাফবৃন্দ..। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ভয়াবহতম এই ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত করতে গেলে এইসব কারণই ঘুরে-ফিরে বারবার চলে আসছে, অদূর ভবিষ্যতেও আসবে। 

 

LKD

 

মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই শ্রেয়। প্রথম পর্ব (আদতে বাছাই পর্ব) আর মূলপর্ব মিলিয়ে সর্বমোট আটটি ম্যাচ খেলার পরও স্মৃতিতে গেঁথে থাকার মত কোনো পারফরম্যান্স কি অর্থ আর সময় ব্যয় করে টিভি-সেটের সামনে বসে থাকা দেশের মানুষদের বা মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী হারানোর ভয় নিয়েও কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে অকূন্ঠ সমর্থন জানাতে গ্যালারীতে ছুটে যাওয়া প্রবাসীদেরকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ দল? উত্তর হলো, 'না'। অবশ্য ম্যাচপ্রতি দুই লক্ষ টাকা সম্মানী হিসেবে পাওয়া টাইগাররা একের পর এক তলানীতে নেমে যাওয়া পারফরম্যান্সের পরও সংবাদ সম্মেলনে যে 'পেইনকিলার', 'আয়নাবাজি' আর 'স্যাভেজ রিপ্লাই' এর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তাতে এসব যুগান্তকারী তত্ত্বের আবিষ্কর্তা হিসেবে এদেশের মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন পাওয়ার দাবি তাঁরা করতেই পারেন। তবে সেই আসন সম্মানের নাকি উপহাসের, সেটা অবশ্যই তর্কযোগ্য বিষয়। 

1001253-ban-vs-sco

 

ক্রিকেটাররা অবশ্য এই বলে দাবি করতেই পারেন যে, 'প্রেসের সামনে বেফাঁস কথা বলা তো আমরা শুরু করিনি' – এবং এমন দাবি কেউ করে থাকলে সেটায় সহমত জানানো ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। কারণ মাঠের বাইরে এই পারস্পরিক কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ির 'শুভ উদ্বোধন' ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপোন। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারের পরপরই অপেশাদারিত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অসংখ্য সাংবাদিকদের সামনে একেবারে নাম ধরে তিন সিনিয়র ক্রিকেটারের যে সমালোচনাটা তিনি করেছিলেন মূলত সেটাই হয়তো পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিলো। এরপর মাঠের খেলার চেয়ে বাইরের এই 'খেলা' এতই বেশি হলো যে এই 'পারফরম্যান্স' এর উপর ভিত্তি করে কোনো ট্রফি যদি আইসিসির পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব হতো তাতে বাংলাদেশ অবধারিতভাবেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতো।

 

Russell-Domingo-1

 

বাছাইপর্ব ও মূলপর্ব মিলিয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা সর্বমোট ১৬ টি দলের মধ্যে বাংলাদেশে কোচিং প্যানেল ছিলো সবচেয়ে বেশি স্টার-স্টাডেড। হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো, স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ, পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন কিংবা ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্স প্রত্যেকেরই হয় খেলোয়াড়ি নয়তো কোচিং ক্যারিয়ার যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। কিন্তু গত আড়াই বছরে এই কোচিং প্যানেলের বলার মত কোনো সাফল্য আছে কী? উত্তর হলো 'না'। বরং ২০১৯ বিশ্বকাপের পরপরই নিয়াগ পাওয়া বর্তমান কোচিং প্যানেল বিশেষত হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ব্যর্থতার খতিয়ান দেখলে বিস্ময়াভিভূত হতে হয় এই ভেবে যে এত ব্যর্থতার পরও কীভাবে এই প্যানেল তথা হেড কোচ গত আড়াই বছর ধরে বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছেন!

 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে একপাশে সরিয়ে রাখলেও তো চোখে ভেসে উঠছে ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট হার, ভারতের বিপক্ষে দুই টেস্টই আড়াই দিনে শেষ হয়ে যাওয়া (যার মধ্যে ইডেন গার্ডেনসের সেই ঐতিহাসিক ডে-নাইট টেস্টও রয়েছে), এক জিম্বাবুয়ে ছাড়া আর কোনো দলের বিপক্ষে গত তিন বছরে কোনো টেস্ট না জেতা এমনকি এই বছরের শুরুর দিকে তৃতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতেই হোয়াইটওয়াশ হওয়ার মত বিভীষিকাময় সব স্মৃতি। এত কিছুর পরও যে টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে বরং সেটাকেই মনে হচ্ছে আইসিসির দাক্ষিণ্য। আর এই টুর্নামেন্ট নিয়ে আদৌ বিসিবি বা খেলোয়াড়দের কোনো পরিকল্পনা আছে কি নাকি 'টেস্ট খেলতে হয় বলেই খেলি' মানসিকতা নিয়ে পরবর্তী টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে নামবেন ক্রিকেটাররা?  আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় অবস্থাটাই বাস্তবতার সাথে অধিক মানানসই। অবশ্য দেশের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট লীগের নিম্নস্তরের অবকাঠামো, মানহীন উইকেট আর নামমাত্র পারিশ্রমিক পাওয়া খেলোয়াড়রা ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন ফরম্যাটে এসে ভালো করবেন, এ আশা করাই বরং দুরাশা।

 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য অর্জন কোনো মহাকাশ বিজ্ঞান নয়। উচ্চমানের ও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ঘরোয়া ক্রিকেট, তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভাবান ক্রিকেটার তুলে আনার জন্য দক্ষ ও আন্তরিক ক্রীড়া সংগঠক, জেলা পর্যায়ে অনুশীলন ও খেলা আয়োজন করার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো সমৃদ্ধ স্টেডিয়াম তৈরী, এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের উইকেট তৈরী....। এর কোনোটিই চতুর্থ ধনী ক্রিকেট বোর্ডের আয়ত্ত্বের বাইরে নয় বলেই অনুমান করি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যে কোনো ব্যবসা বা অর্থ-লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান নয় বরং একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান, ৯০০ কোটি টাকার এফডিআর নিয়ে বৃথা আস্ফালন করার আগে দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিসিবি প্রেসিডেন্টের এই বোধোদয় হওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। ঘরের মাঠের পূর্ণ সুবিধা নিয়ে কয়েকটি সিরিজ জয় করলেই যে নিজেদেরকে বড় দল হিসেবে পরিচয় দেওয়া যায় না বরং হোম কন্ডিশনে আন্তর্জাতিক মান থেকে বহু নিচুস্তরের উইকেট বানিয়ে জয় পাওয়ার  'আত্মবিশ্বাস' যে কতটুকু ঠুনকো হতে পারে এই বিশ্বকাপ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

 

MUSHY

 

যেকোনো খেলার গ্লোবাল ইভেন্টে যে কোনো দল অপ্রত্যাশিত রকমের বাজে ফলাফল করতেই পারে। এই বাংলাদেশের কল্যাণেই ২০০৭ বা ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপে যথাক্রমে ভারত ও ইংল্যান্ড তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এক ব্যর্থতার শিকার হয়েছিলো। কিন্তু ব্যর্থতা থেকে প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার মানসিকতা যে দীর্ঘমেয়াদে কোনো দলকে কী পরিমাণ সাফল্য এনে দিতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঠিক আগের বিশ্বকাপেই গ্রুপপর্ব থেকে বাড়ি ফেরার পরও ২০১১ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে ভারত ও ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়। কিন্তু একের পর এক ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকার পরও কি এদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কারোর পক্ষে কি সেই 'প্রকৃত শিক্ষা' নেওয়া সম্ভব হবে? যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে হয়তো সুদূর ভবিষ্যতেও জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ককে 'আশা করি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরেরবার ভালো করবো' টাইপের কোনো উক্তি দিয়েই যেতে হবে। অন্যদিকে দেশের আপামর ক্রিকেট ভক্তরা এই দল থেকে একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাবেন না।