বিরাট কোহলিঃ সাদা পোশাকের সব্যসাচী অধিনায়ক!
পোস্টটি ১৩৭৫ বার পঠিত হয়েছেবিরাট কোহলি অবশেষে কাপ্তানীর আর্মব্যান্ড নামিয়ে রেখেছেন। বিদেশের মাটিতে দারুণ কিছু সাফল্য, টেস্ট র্যাংকিংয়ে এক নম্বর দল হওয়া, ঘর ও ঘরের বাইরে দাপট দেখানো, দারুণ এক পেস অ্যাটাক গড়ে তোলা- সব কিছুর পর বিরাটের মনে হয়েছে, এবার বুঝি বেলা ফুরিয়ে এসেছে।
আবেগের সাথে মিশেছিল আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, বিরাট কোহলিকে আলাদা করে চিনিয়েছিল ওঁর এই হার না মানা গুণটাই। কিন্তু যা কিছু মাঠে আমরা চোখ দিয়ে দেখি, সংখ্যাও কিন্তু সেই সফলতার সাক্ষ্যই দিচ্ছে। তর্কসাপেক্ষে, বিরাট কোহলি ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হয়েই থাকবেন!
আপনি যদি জয়ের হার দিয়ে বিচার করতে যান, বিরাটকে একদমই পেছনে রাখতে পারবেন না। সাদা পোশাকে নিজের অধিনায়কত্ব করা ৬৮ ম্যাচের মধ্যে বিরাট নিজের দল ভারতকে জিতিয়েছেন ৪০ ম্যাচেই। ১৭ ম্যাচে হেরেছেন বটে, তবে বাকি থাকা ১১ ম্যাচে অন্তত মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়নি তাকে, ড্রেসিংরুমে ফিরেছিলেন ড্র মেনে নিয়েই। আর এই জয়ের হিসাবই আমাদের বলে, সাদা পোশাকে বিরাট কোহলির জয়ের হার শতকরা ৫৮.৮২ শতাংশ যেটা কিনা বর্তমান সময়ে বিরাটের কাছাকাছি থাকা সফল টেস্ট অধিনায়ক জো রুটের(৪৪.২৬%) চাইতে অনেক অনেক বেশি।
তবে বর্তমান ছাড়িয়ে যদি আপনি ক্রিকেটে এযাবতকালের খেলা সব অধিনায়ককে হিসেবের খাতায় আনতে চান, তাহলেও জানিয়ে রাখি- ন্যূনতম ৫০ ম্যাচে অধিনায়কয়ত্ব করেছেন, এমন অধিনায়কদের মধ্যে সাদা পোশাকে বিরাট কোহলির চাইতে বেশি জয়ের হার আছে মাত্র দুজনের-
স্টিভ ওয়াহ (৬০.৯৮%) ও রিকি পন্টিং (৬২.৩৩%)
টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামাটাও কিন্তু কোহলি এক রকম অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছিলেন। সাদা পোশাকে সবচেয়ে বেশিবার অধিনায়কত্ব করতে মাঠে নামা খেলোয়াড়দের মধ্যে কোহলির অবস্থান আছে একদম ছয় নম্বরে। এই তালিকায় কোহলির আগে আছেন গ্রায়েম স্মিথ, অ্যালান বোর্ডার, স্টিফেন ফ্লেমিং, রিকি পন্টিং এবং ক্লাইভ লয়েড।
বিশ্ব অধিনায়কদের তালিকাটা ছোট করে শুধু ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যেও বিরাট কোহলি সর্বেসর্বাই থাকবেন। কোহলির সাথে তুলনা দিতে হলে আপনি অবশ্য এখানে শুধু দুটো নামই খুঁজে পাবেন। ভারতীয় ক্রিকেটের সূর্যোদয়ের বীজ বুনে দেওয়া সৌরভ গাঙ্গুলী আর ভারতীয় ক্রিকেটকে দুহাত ভরে অর্জন এনে দেওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি। কিন্তু সাদা পোশাকে? কোহলির আশেপাশে কেউ নেই! ধোনির কথাই ধরুন না, সাদা পোশাকে ভারতের হয়ে ৬০ ম্যাচে টস করতে নেমে তাঁর জয়ের হার ছিল শতকরা ৪৫ ভাগ, ৪৯ ম্যাচে ২১ জয় এনে দেওয়া সৌরভের যেটা ছিল শতকরা ৪২.৮৫ ভাগ। তালিকাটা বড় করে যদি সুনীল গাভাস্কার কিংবা মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের মত গ্রেটদেরও এই তালিকায় ঠাঁই দিতে চান, তাতেও গাভাস্কার ও আজহারউদ্দিন যথাক্রমে ২৯.৭৮% ও ১৯.১৪% নিয়ে এই তালিকায় একটু পেছনের দিকেই থাকবেন।
বুঝতেই পারছেন, জয়ের হার দিয়ে কোহলিকে কোনভাবেই আপনি পেছনে রাখতে পারবেন না। শুধু ভারতীয় ক্রিকেট না, বিশ্ব ক্রিকেটে ন্যূনতম ৫০ ম্যাচে অধিনায়কয়ত্ব করা টেস্ট ম্যাচের অধিনায়কদের মধ্যে শতকরা ৫০ এর বেশি জয়ের হার আছেই ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র সাতজনের। কোহলি ছাড়া সপ্তসুরের বাকি ছয়জন হলেন- গ্রায়েম স্মিথ, রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়াহ, হ্যানসি ক্রনিয়ে, মাইকেল ভন, স্যার ভিভ রিচার্ডস এবং মার্ক টেইলর।
কোহলির অধিনায়কয়ত্বের সবচাইতে বড় গুণ ছিল তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে জানতেন। দুর্দান্ত ব্যাটিং ফর্মের সাথে মাঠে কোহলির এনার্জেটিক চলাফেরা ভারতীয় দলকে সবসময়ই চনমনে রেখেছে, ম্যাচ জিততে সাহায্য করেছে। টেস্ট অধিনায়কের আর্মব্যান্ড বেঁধে কোহলি শতক হাঁকিয়েছেন গোটা বিশেক। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিরাটের চাইতে বেশি শতক আছে আর মাত্র একজনের, দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ (২৮ টি)। তবে সেঞ্চুরির হিসেব ছাড়িয়ে ডাবল সেঞ্চুরির হিসেবে কোহলির আশেপাশে কোন অধিনায়ক নেই, সাতটা ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে কোহলি একাই এখানে সর্বেসর্বা। শুধু তাই নয়, সাদা পোশাকের অধিনায়ক হিসেবে করা তাঁর ৫৮৬৪ রান টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে করা চতুর্থ সর্বোচ্চ রান।
ঘরের মাঠে কোহলি সবসময়ই অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। ঘরের মাঠে ২৪ টেস্ট জয় নিয়ে কোহলি সবচেয়ে বেশি ঘরের মাঠের জয়ের তালিকায় আছেন তিন নম্বরে। কোহলির ওপরে এই তালিকায় আছেন কেবল রিকি পন্টিং(২৯ টি) ও গ্রায়েম স্মিথ (৩০ টি) । তাছাড়াও কোহলির শ্রেষ্ঠত্ব মাপতে হলে আপনি ফিরে যেতে পারেন ২০১৮-২০১৯ সালের সময়টাতে। সেবছর বিরাট কোহলি যখন সাজানো মঞ্চে উঁচিয়ে ধরছেন বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি, ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম কোন এশিয়ান অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট সিরিজ জয়ের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছেন তিনি। আর দুর্দান্ত এই সিরিজ জয়ের পর ইংল্যান্ডের মাটিতেও কোহলি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। টেস্ট ক্রিকেটকে রীতিমত প্রার্থনা মনে করে যে ইংল্যান্ড, তাঁদের কোহলি এন্ড কোং সিরিজ হারিয়েছিল ২-১ ব্যাবধানে!
তবে সবাইকে একদিন থামতে হয়। গোলিয়াথকে থামতে হয়েছিল, থামতে হয়েছিল এযাবতকালের সবাইকেই। জীবনানন্দ যেমনটা বলেছেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়। কোহলিও তাই বর্ণাঢ্য এই অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ হারের সদ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির এটাই বোধহয় সবচাইতে ভাল উপশম জানা ছিল কোহলির। ব্যাটিং ফর্মটা ঠিক ‘কোহলি’সুলভ যাচ্ছেনা, কোহলি হয়তো চাইবেন অধিনায়কত্বের পাহাড়সম চাপ থেকে দূরে সরে আবারও মাঠে নিজের স্বভাবজাত মুন্সিয়ানা দেখাতে।
নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে আমরাও সেটাই চাইব, তবে আমরা ভুলে যাব না- টেস্ট ক্রিকেটের অধিনায়কত্বের রেকর্ডবুক ওলটপালট করেই অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ডটা খুলে রেখে দিচ্ছেন একজন বিরাট কোহলি!
- 0 মন্তব্য