• ক্রিকেট

হাশিম আমলা: ক্রিকেটে যার নিখাদ ভদ্রলোক ভাবমূর্তি

পোস্টটি ১৫৬৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কিছু কিছু মানুষ আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করবেন নিজের কর্মের মাধ্যমে। তেমনই একজন ক্রিকেটার হাশিম আমলা। যিনি ক্রিকেটকে ছাপিয়ে যান, হয়ে উঠেন একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। ক্রিকেটে যার নিখাদ ভদ্রলোক ভাবমূর্তি। 

ধারাভাষ্যকার ডিন জোন্স যখন, তাঁকে 'সন্ত্রাসী' বলে অপমান  করেন। তখনও তিনি তাঁকে ক্ষমা করে দেন! তিনি বলেন- ' আমি মুসলিম। একজন মুসলিমের কাজ কেউ ক্ষমা চাইলে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া' 

তিনি যে কতটা ধর্মপরায়ণ, তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১২ সালে দ্য ওভাল টেস্টে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে গড়েন প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করার কীর্তি! তখন ছিল রমজান মাস। আমলা এই  ইনিংস খেলেছিলেন রোজা থাকা অবস্থায়! ৩১১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসটা খেলতে আমলা বল খেলেছিলেন ৫২৯ টা! মানে প্রায় ৮৮ ওভার ব্যাটিং করেছেন রোজা নিয়েই। 

হাশিম আমলার জন্ম  ১৯৮৩ সালে ৩১ মার্চ; দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে। ভারতীয় গুজরাটি মুসলিম বংশের সন্তান আমলা। সে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ক্রিকেট মাঠে কিংবা বাইরে তাঁর কর্মকাণ্ডে অন্তত তা প্রমাণিত হয়।  

মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা আমলার ক্রিকেটের  হাতেখড়ি তাঁর শহরের  ডারবান হাই স্কুলে। এই স্কুলে ল্যান্স ক্লুজনারের মতো তারকা পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।  তাঁর ভাই আহমেদ আমলাও পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন। তাঁর ক্যারিয়ার বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। হাশিম আমলার দুই বছর  আগে আহমেদ আমলার অভিষেক হয়। তাঁরা একসাথে দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট টিম কাওয়াজুলু নাটাল ডলফিন্সে খেলেছিলেন।  হাশিম-সুমাইয়া দম্পতির ঘরে দুইটি সন্তানও আছে। 

হাশিম আমলা যেমন প্রতিভাবান ছিলেন।তেমনি তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণও ছিল। ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়ে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব করেছিলেন বটে, তবে বলার মতো সাফল্য পাননি। 

ব্যাটার হাশিম আমলা বিশ্বের সেরাদের একজন ছিলেন। পরিসংখ্যান তো তাঁর হয়েই কথা বলে। তিন ফরম্যাটেই দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ব্যাট হাতে দাপট দেখিয়েছেন। টেস্টে ৯ হাজারের উপরে, ওয়ানডেতে ৮ হাজারের উপরে রান করা তো আর ছেলেখেলা না।  

একদিনের ক্রিকেটে আমলা সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। ১৮১ ওয়ানডেতে ৪৯.৪৬ গড়ে রান করেছেন ৮১১৩।  ২৭টা  শতক করেছেন।  করেছেন ৩৯ টা অর্ধশতকও। 

ওয়ানডে ক্রিকেটের অনেক রেকর্ডও তাঁর দখলে। 

একদিনের ক্রিকেটে দ্রুততম ২০০০ রান (৪০ ইনিংস), ৩০০০ রান (৫৯ ইনিংস), ৪০০০ রান (৮১ ইনিংস), ৫০০০ রান (১০১ ইনিংস),  দ্রুততম ৬০০০ রান (১২৩ ইনিংস) এবং দ্রুততম ৭০০০ রান (১৫০ ইনিংস) করা  প্রথম ক্রিকেটার  হাশিম আমলা।  

২০১৪ সালের কথা।  মাত্র ৮৬ ইনিংসে ১৫ টা সেঞ্চুরি করেন হাশিম আমলা। ঐ বছর আরো দুইটা সেঞ্চুরি করেন এই ব্যাটসম্যান। ১৬তম শতক করতে লেগেছে ৯৪ ইনিংস। ১৭তম শতকের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে মাত্র ৯৮ ইনিংস। যা সময়ের হিসেবে দ্রুততম।  

২০১৫ সালেও  শতকের দেখা পান আমলা। ১৮তম শতক করতে  তাঁর লেগেছে ১০২ ইনিংস। ২০টা সেঞ্চুরির মাইলফলকে পৌঁছাতে মাত্র ১০৮ ইনিংস লেগেছে তাঁর। যা ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম।  সবচেয়ে কম ইনিংসে ২০টা সেঞ্চুরি করার রেকর্ড।  

টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা মাত্র চতুর্থ ক্রিকেটার তিনি। ২০১৭ সালে দ্রুততম ক্রিকেটার হিসেবে  ২৫ টা শতক করেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান। ২০১৮ সালে,  হাশিম আমলা ভিরাট কোহলীর রেকর্ডও নিজের করে নেন। মাত্র ১৬৭ ইনিংসে ২৭টা সেঞ্চুরির মাইলফলকে পৌঁছান আমলা। ভিরাট কোহলীর লেগেছে ১৬৯ ইনিংস।  

২৫ টা সেঞ্চুরি করা প্রথম আফ্রিকান ক্রিকেটার হাশিম আমলা। 

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে যেকোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপটা হাশিম আমলা ও কুইন্টন ডি ককের। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৮২ রান তুলেছিলেন তাঁরা। ২০১৫ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ফাফ ডু প্লেসির সাথে ২৪৭ জুটি গড়েছিলেন। খেলেছিলেন তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ১৫৯ রানের ইনিংস।  

টেস্ট ক্রিকেট আমলাকে অনেক কিছু দিয়েছে।১২৪ ম্যাচে ৪৬.৬৪ গড়ে  ৯২৮২  রান করেছেন। ২৮ টা সেঞ্চুরি করেছেন।  হাফ সেঞ্চুরি করেছেন ৪১ টা। 

টেস্ট ও ওয়ানডেতে ২৫ টা সেঞ্চুরি করা মাত্র চতুর্থ ক্রিকেটার তিনি। প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড ও তাঁর। ২০১০ সালে টেস্ট ও ওয়ানডেতে ১০০০ রান করার রেকর্ডও আছে  তাঁর।  উইন্ডিজের বিপক্ষে চতুর্থ উইকেটে এবি ডি ভিলিয়ার্সের সাথে করেছিলেন রেকর্ড ৩০৮ রানেট জুটি। নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ২৫৩ রানের কথা না  বললেই নয়। 

টিটুয়েন্টিতেও হাশিম আমলা কম যান না। ৪৪ ম্যাচে ৩৩.৬০ গড়ে করেছেন ১২৭৭ রান।  শতকের দেখা না পেলেও,  ৮ টা অর্ধশতক করেছেন। সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ৯৭। বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি খেলেছেন।  আইপিএলে দুটি সেঞ্চুরি করেছেন।  টিটুয়েন্টিতে পঞ্চম উইকেটে ডোয়াইন ব্রাভোর সাথে ১৫০ রানের জুটির রেকর্ড করেছেন। 

হাশিম আমলার সতীর্থ ডেল স্টেইনের মন্তব্যই  হতে পারে সকলের জন্য সত্যিকারের অনুপ্রেরণা। 

" আমার যখন অনুপ্রেরণার দরকার হয়, তখন আমি আমার বামপাশে ঘুরে তাকাই; আর দেখি হাশিম আমলা কোরআন পড়ছেন" 

৮ আগস্ট,  ২০১৯ সালে ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছিলেন আমলা।  বাইশ গজে না থাকলেও,  তাঁর কীর্তি গুলা অবিনশ্বর হয়ে থাকবে ক্রিকেট ভক্তদের মনে।