ফার্গি টাইমের উৎপত্তিকথন
পোস্টটি ১১২২ বার পঠিত হয়েছেএকটি কথা প্রচলিত আছে, "ফুটবল খেলে ২২ জন, কিন্তু ফার্গি টাইমে গোল দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচ জিতে।" স্যার এলেক্স ফার্গুসন এর অধীনে ২৬ বছরে এমন অগণিত ম্যাচ আছে, যেগুলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে জিতেছে। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে জেতার ঘটনা ফুটবলে হর হামেশাই ঘটে থাকে, তবে স্যার এলেক্স এর ফার্গুসন এর ইউনাইটেড যেনো একদম শেষ মুহূর্তেই গোল দিয়ে প্রতিপক্ষকে জয়চ্যুত করতে ভালোবাসতো। স্যার এলেক্স এর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচের অন্তিম সময়ে গোল দিয়ে শুধুমাত্র সাধারণ ম্যাচই জিতেনি, বরং ১৯৯৯ সালে ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাফল্য ট্রেবলজয় এর পেছনেও শেষ মুহুর্তের গোলের ভূমিকা অসামান্য। অনেকে ১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে ইউনাইটেড এর কামব্যাকের গল্প জানে, তবে এফএ কাপের সেমি ফাইনালে আর্সেনালের বিপক্ষে গিগস এর ম্যাচ ডিসাইডিং গোলও এসেছিল অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ মুহূর্তে, যে গোল ইউনাইটেডকে ফাইনালে তুলেছিল ফলে ইউনাইটেড এফএ কাপ জিতে ট্রেবল পূর্ণ করার পেছনে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। এভাবে স্যার এলেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২৬ বছরে অবিশ্বাস্যভাবে একের পর এক কামব্যাক করায় ফুটবল ডিকশনারিতে "ফার্গি টাইম" শব্দটি স্থান পেয়েছে।
কিন্তু এই ফার্গি টাইম শব্দটির উৎপত্তি হলো কীভাবে? এর উত্তর খুঁজতে কিছু সময়ের জন্য ফিরে যেতে হবে নব্বই এর দশকে।
৯১-৯২ সিজনে প্রিমিয়ার লীগ জেতার একদম দাঁড়প্রান্তে ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে সিজনের শেষদিকে এপ্রিলে ওয়েস্ট হাম, নটিংহ্যাম ফরেস্ট এবং লিভারপুলের কাছে হারায় ৪ পয়েন্টের জন্য লীডস এর কাছে শিরোপা হারায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফলে ইউনাইটেড এর ২৫ বছরের লীগ শিরোপা খড়া আরো এক বছরের জন্য দীর্ঘ হয়।
৯২-৯৩ সিজন প্রিমিয়ার লীগ এডিশনের প্রথম সিজন ছিল। গতবারের ফর্ম এবারও ধরে রাখে ইউনাইটেড। এপ্রিল পর্যন্ত লীগের শীর্ষস্থানে ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, তবে সে সময়ে সমান সংখ্যক পয়েন্ট নিয়ে ইউনাইটেড এর ঘাড়ে শ্বাস ফেলছিল এস্টন ভিলা।
এমন সমীকরণ নিয়েই ওল্ড ট্রাফোর্ডে শেফিল্ড ওয়েডনেসডের মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সে সময়ে শেফিল্ড ইউনাইটেড টপ সিক্স এ ফিনিশ করার জন্য ফেভারিট ছিল সুতরাং তারা একদম ঝেড়ে ফেলার কোনো উপায় ছিল না।
ম্যাচ শুরু হয়। ম্যাচের প্রথমার্ধে দুই দলই গোলের অনেকগুলো সুযোগ তৈরি করলেও গোল করতে ব্যর্থ হয় উভয় দল। ফলে গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয় প্রথমার্ধ।
এই ম্যাচের মূল নাটকীয়তা অপেক্ষা করছিল দ্বিতীয়ার্ধের জন্য। আমরা সাধারণত রেফারিদের মাঠে ইঞ্জুরড হতে খুবই কম দেখি, তবে ম্যাচের এক ঘন্টার সময়ে সেই ম্যাচের মূল রেফারি মাইক পেক মাসল এ টান খাওয়ায় তাকে মাঠ ছাড়তে হয়। তার জায়গায় লাইন্সম্যান জন হিলডিচ রেফারি হিসেবে মাঠে প্রবেশ করেন।
ম্যাচের ৬৪ মিনিটের সময়ে ইউনাইটেড ডি বক্সের ভেতরে পল ইন্স শেফিল্ড এর ক্রিস ওয়াডল কে ট্যাকল করে বসেন। ফলে পেনাল্টি পায় শেফিল্ড ওয়েডনেসডে। পেনাল্টি থেকে গোল করতে কোনো ভুল করেননি শেফিল্ডের জন শেরিডান। ফলে ১-০ গোলে এগিয়ে যায় শেফিল্ড ওয়েডনেসডে।
শেফিল্ড এর গোলের পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ওল্ড ট্রাফোর্ড। কিছু ইউনাইটেড ফ্যানের চোখে মুখে ইতিমধ্যে কান্না চলে আসে। গত সিজনেও এভাবে হাত ফসকে গিয়েছিল লীগ টাইটেল, এই সিজনেও কি তেমনই হবে? ২৬ বছরের লীগ ট্রফিখরা কি আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে? সে সময়ে প্রতিটি ইউনাইটেড ফ্যানের মাথায় এই প্রশ্নগুলোই ঘুরে ফিরে আসছিল।
পিছিয়ে পড়ার পর ক্যাপ্টেন ব্রায়ান রবসন কে বদলি হিসেবে মাঠে নামালেন স্যার এলেক্স। ম্যাচের সেই মুহূর্তের কথা বিবেচনা করলে এটা সারপ্রাইজিং একটা সিদ্ধান্ত ছিল কারণ সেই সিজনে মাত্র ৮ ম্যাচ খেলেছিলেন রবসন, তবে স্যার এলেক্স চেয়েছিলেন এমন নার্ভি মুহুর্তে যাতে অভিজ্ঞ রবসন বাকি টিমমেটদের অনুপ্রেরিত রাখতে পারে।
গোল কন্সিড করার পর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল ইউনাইটেড, তবে চীনের প্রাচীর হয়ে সে সময়ে আবির্ভাব ঘটে শেফিল্ড গোলকিপার ক্রিস উডস এর। ক্যান্টোনা এবং হিউগস এর একের পর এক শট তিনি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন।
ম্যাচের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ৯০ মিনিট পূর্ণ হতে যখন ৪ মিনিট বাকি, তখন কর্নার পায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ডেনিশ আরউইন এর নেয়া সেই কর্নার থেকে গোল করে ইউনাইটেডকে সমতায় ফেরান স্টিভ ব্রুস, যা গত ৬ মাসে তার প্রথম লীগ গোল ছিল।
সমতায় ফেরার পর একটু হলেও প্রাণ ফিরে ইউনাইটেড সমর্থকদের মাঝে। কিন্তু তবুও চিন্তা ছিল। কারণ সেই ম্যাচ ড্র হলেও হাত থেকে ফসকে যাবে ২ পয়েন্ট, যা লীগ শিরোপা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক হতে পারে।
ম্যাচের সময় ৯০ মিনিট পার হয়ে গেলেও বাঁশি বাজাচ্ছিলেন না ভারপ্রাপ্ত রেফারি হিলডিচ। এদিকে তখন গোলের জন্য মরিয়া ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, এক গোলকিপার বাদে সবাই তখন শেফিল্ড এর হাফে। শেফিল্ড এর ডি বক্সের সামনে প্রেস করে বল রিকভার করেন সেন্টার ব্যাক গ্যারি প্যালিস্টার, তার পরই ক্রস তুলে দেন বক্সে। প্যালিস্টার এর ক্রস শেফিল্ড এর ওর্থিংটনের শরীরে লেগে ডিফ্লেক্টেড হয়ে সরাসরি গিয়ে পড়ে ব্রুসের মাথায়, তার হেড করা গোল ইউনাইটেড কে এনে দেয় ২-১ গোলের লীড। ব্রুসের সেই গোলের পর পুরো ওল্ড ট্রাফোর্ড মেতে উঠে উল্লাসে, ডাগ আউটে দৌড়িয়ে সেই গোল উদযাপন করেন স্যার এলেক্স ফার্গুসন।
ব্রুসের গোলের পরই রেফারি বাঁশি বাজান ফুল টাইমের, ফলে ২-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
সেই গেমউইকেই কভেন্ট্রি সিটির সাথে গোলশূন্য ড্র করে এস্টন ভিলা, ফলে ২ পয়েন্টের ব্যবধানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা। লীগের সর্বশেষ ৫ টি ম্যাচের সব কয়টি জিতে ২৬ বছর পর ১৯৯৩ সালে লীগ শিরোপা ঘরে তুলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
সেখান থেকে শুরু, এরপর স্যার এলেক্স ফার্গুসনের অধীনে ২০ বছরে আরো ১২ বার লীগ শিরোপা জিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, জিতে ইউসিএল এর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু সংখ্যক ট্রফি। তবে এই সব সাফল্যের ভিত্তি ছিল ৯২-৯৩ সালের লীগ টাইটেল, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি শেফিল্ড ওয়েডনেসডের বিপক্ষের এই ম্যাচ। এই ম্যাচ না জিতলে হয়তো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সেবার লীগ শিরোপা জিততে পারতো না, টানা ২ বার লীগ শিরোপার কাছাকাছি গিয়ে না জিততে পারার আক্ষেপে হয়তো এই ক্লাবটির সামনের গল্প এতো সুন্দর নাও হতে পারতো। তবে এই সব "যদি" "কিন্তু" "হয়তো" এর সমীকরণ মুছে দিয়েছিল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে করা স্টিভ ব্রুসের সেই গোল, যেই গোলের কারণে ফুটবল ডিকশনারিতে "ফার্গি টাইম" নামের একটি শব্দের সংযোজন হয়েছে, সেই গোল শুধুমাত্র ২৬ বছর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে লীগ শিরোপাই এনে দেয়নি, বরং মহিমান্বিত ফার্গি টাইম শব্দের উৎপত্তি ঘটিয়েছে।
- 0 মন্তব্য