যে পাঁচ কারণে টেস্টে ধুঁকছে বাংলাদেশ
১৩৭ বছর আগে ইংলিশ ক্রিকেটের এপিটাফ লেখা হয়েছিল ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য স্পোর্টিং টাইমসে। ওই ছাইভস্ম থেকেই জন্ম হয়েছিল অ্যাশেজ নামটি। জিম্বাবুয়ের কাছে সাড়ে তিন দিনে হারের পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রয়াণগাঁথা আজ সিলেটে লেখা হয়ে গেল কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। যে দল ১৭ বছর ধরে ঘরের বাইরে কোনো টেস্ট জেতেনি, তাদের সঙ্গে নিজেদের মাটিতে হারার পর টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ছাইভস্মও ফেলতে পারেন কেউ কেউ। তবে এই দুর্দশার ভেতরটা খতিয়ে দেখলে উঠে আসবে বেশ কিছু কারণ ।
একাদশেই যখন গলদ
দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ে যখন প্রতিপক্ষ, তাদের বিপক্ষে এক পেসার খেলানোর পরেই আসলে প্রশ্ন উঠে যায় একটা দলের মানসিকতা নিয়ে। চারজন পেসার স্কোয়াডে থাকার পরও যে দল এক পেসার নিয়ে নামে, তারা আসলে মাঠে নামার আগে একটু হলেও ব্যাকফুটে চলে যায়। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলের সঙ্গে সেটা মানা যায়, কিন্তু জিম্বাবুয়ের সঙ্গে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা একটু কঠিনই। মাহমুদউল্লাহ আজ সংবাদ সম্মেলনে যতই আত্মপক্ষ সমর্থন করুন, তাতে একাদশ নিয়ে সিদ্ধান্তটা ঠিক প্রমাণ হয়ে যায় না। কাল কোচ স্টিভ রোডস এসে অবশ্য বলে গেছেন, বাংলাদেশ উইকেট পড়তে একটু ভুল করেছে। তবে তার পরেও কোচ স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের বোলিং ভারসাম্যটা ঠিক ছিল না।
সিনিয়রদের ওপর অতি নির্ভরতা
দেশের মাটিতে গত কিছুদিনে বাংলাদেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে যে দুই টেস্টে হারিয়েছে, তাতে সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবাল পথ দেখিয়েছেন সামনে থেকেই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের শততম টেস্টে জয়টাও এসেছে দুজনের হাত ধরেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দুজনের অভাবটা টের পেতে দেয়নি দল। কিন্তু সিলেট টেস্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, অন্তত লম্বা দৈর্ঘ্যে এই দুজনের ওপর এখনও কতটা নির্ভর করে বাংলাদেশ। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে মাশরাফি টেস্টে নেই অনেক দিন থেকে, মাহমুদউল্লাহ থাকলেও নিজেকে সাদা পোশাকে এখনও অপরিহার্য করতে পারেননি/ তার বাইরে এই টেস্টে ছিলেন মুশফিকই, কিন্তু সাকিব-তামিমের না থাকার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি শান্ত-লিটনরা। এক আরিফুল হকই যা একটু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বাকিদের আর কারও ব্যাটিংয়ে উইকেট না দিয়ে আসার মানসিকতা দেখা যায়নি। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সাকিব-তামিমের অভাবটা টের পাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড় একটা অশনী সংকেতই।
লাল বলের ঔদাসীন্য
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ যখন ৪৩ রানে অলআউট হলো, কয়েকটা দিন বিস্তর সমালোচনা হলো। এরপর টেস্ট শেষে যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি জেতা হলো, তখন টেস্টের পারফরম্যান্স নিয়ে সব সমালোচনা উধাও। এমনকি দেশে আসার পরও অধিনায়ক-কোচের কাছে টেস্টে অমন পারফরম্যান্সের জন্য সেভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো না। পরে এশিয়া কাপ আর জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডেতে জয় আবার ভুলিয়ে দিল সবকিছু। এই বছরেই শ্রীলঙ্কার কাছে দেশের মাটিতে হারের পরও টেস্টের ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণ তলিয়ে দেখা হয়নি সেভাবে। বরং টি-টোয়েন্টিতে হার নিয়ে হইচই হয়েছে বেশি। টেস্টে ব্যাটিং-বোলিংয়ের জন্য স্পেশালিস্ট গড়ে তোলার মানসিকতা নেই। পেস বোলারদের মধ্যেও অনেকে টেস্ট খেলতে সেভাবে আগ্রহী নন, সেটাও জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে। খেলোয়াড়েরা খারাপ করলেও ওপরমহলের কর্তারা টেস্ট দলের পারফরম্যান্স নিয়ে কাঁটাছেড়া করতে খুব ইচ্ছুক নন। ‘ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে তো ভালো করছে, খারাপ কী!’ এই হচ্ছে তাদের ভাষ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শুরুটা হচ্ছে টেস্ট দিয়ে, দেখা যাবে পরে টি-টোয়েন্টিতে, ওয়ানডেতে ভালো করলে টেস্টের সাফল্য, ব্যর্থতা যা হোক, সেটা ঢাকা পড়ে যাবে।
গ্রাফিকস- ইশতিয়াক অর্ণব/প্যাভিলিয়ন
ধৈর্যের অভাব যখন জাতিগত
সিলেট টেস্টে দুই ইনিংস মিলে জিম্বাবুয়ে খেলেছে ১৮২ ওভারের কাছাকাছি, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ১১৪ ওভারের মতো। এমন নয়, উইকেটে কোনো জুজু ছিল- মাহমুদউল্লাহ নিজেই সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন তা। জিম্বাবুয়ের বোলারদের আহামরি কোনো বলও করতে হয়নি, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিয়ে এসেছেন উইকেট। ধৈর্য হারিয়ে এভাবে উইকেট দিয়ে বসা, বা মনযোগের ঘাটতির এই সমস্যা সম্ভবত জাতিগত। যে দেশে সিংহভাগ লোকের ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই, সেখানে ব্যাটসম্যানদেরই বা দোষ কী? টেস্ট ক্রিকেট মানে যে দেশে এখনো চার-ছয়ে তুমুল হাততালি, সেখানে ব্যাটসম্যানরা কতক্ষণই বা লোভ সামলে রাখতে পারেন? চাতারা যেমন বলে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ওয়ানডের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না, কথাটা আসলে একবিন্দু বাড়িয়ে বলা নয়। সিলেটের মতো উইকেটে যখন রান ওঠা সহজ নয়, ধৈর্যটা বেশি দরকার, সেখানে সেই কাজেই ব্যর্থ ব্যাটসম্যানরা। অস্থিতিশীল একটা জাতির কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটাও ভুল।
এবং অর্থহীন ঘরোয়া ক্রিকেট
টেস্ট খেলার পূর্বশর্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেদের প্রমাণ করা। সব টেস্ট দলে প্রথম শ্রেণিতে যারা ভালো করেন, তারাই টেস্ট দলে আসেন। আর বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে যারা বছরের পর বছর নিজেদের প্রমাণ করে যাচ্ছেন, তারাই থেকে যাচ্ছেন উপেক্ষিত। এই বছরেই একবার ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের খেলা বাধ্যতামূলক করার একটা প্রস্তাব করেছিলেন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। কিন্তু আগের অনেক বারের মতো এবারও ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর তাতে জাতীয় দলের অনেকেই নেই। বিশেষ করে তুষার ইমরানের মতো ব্যাটসম্যান যখন জাতীয় লিগে বছরের পর বছর রান করে যাচ্ছেন, তাঁকে উপেক্ষার মানে জাতীয় লিগের প্রকারান্তরে একটা অর্থহীন টুর্নামেন্ট বলা। জাতীয় দলের অনেকেরই ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে কী হবে’ এই মানসিকতা আছে, সেটার দায়ও বিসিবি এড়াতে পারে না। যে দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের গুরুত্ব দিনকে দিন এভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেখানে জাতীয় দলে সাদা পোশাক গায়ে চড়ালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, সেই আশা করাটাও ভুল।