• অ্যাশেজ ২০১৯
  • " />

     

    'বিগ বেন থিওরি', জ্যাক লিচের চশমা ও হেডিংলি রূপকথা ২.০

    'বিগ বেন থিওরি', জ্যাক লিচের চশমা ও হেডিংলি রূপকথা ২.০    

    চাপ। পদার্থবিদ্যায় এটা পরিমাপ করা বেশ সহজ, একক ক্ষেত্রফলে প্রযুক্ত বল। মানে বলকে (উঁহু, ক্রিকেটের বল নয়, 'ফোর্স') ক্ষেত্রফল দ্বারা ভাগ করুন, চাপ পেয়ে যাবেন। পদার্থবিদ্যার টার্মগুলো সমীকরণে প্রকাশ করা যায়। তবে চাপ ব্যাপারটা মানবিক হলে এর তেমন সোজাসাপ্টা সমীকরণ নেই। তখন আলাদা একটা অর্থ আছে এর। কেউ চাপে আছে, বা চাপে পড়েছে, বা চাপ সামলাতে পারেনি-- এসব কথার বিপরীতে তাই বাড়তি ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়। আর ব্যাপারটা যখন খেলায়, ক্রিকেটে- তখন চাপ আসে প্রত্যাশার ভার নিয়ে, কী হতে চলেছে সেই অনিশ্চয়তার রূপ ধরে। 

    ব্যাটসম্যান, বোলার, ফিল্ডার, আম্পায়ার- চাপ কাউকে ছাড়ে না নিশ্চিতভাবেই। ও হ্যাঁ, চাপ ছাড়ে না আপনার আমার মতো দর্শকদেরও। নাহলে কেন চেয়ারে বসেও মনে হবে, যুত করতে পারছেন না? কেন নখগুলোকে নেইল-কাটারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে মুখের কাছে নিয়ে যাবেন আপনি? অথবা অদ্ভুত সব তত্ত্ব বা থিওরি বের করবেন- এখান থেকে ওঠা যাবে না, বাথরুম যাওয়া যাবে না, ল্যাপটপে ব্রাউজার ওপেন করা যাবে না, কারও এদিকে আসা যাবে না? 

    চাপ কমাতে তাই একেকজন একেকটা থিওরি বের করেন। জ্যাক লিচ চশমা মোছেন। বেন স্টোকস দেখবেন না দেখবেন না করেও তাকিয়ে থাকেন লিচের ব্যাটিংয়ের দিকে। ন্যাথান লায়ন একটু আগে চাপে ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা ভুলতে হয়তো শুয়ে পড়েন ক্রিজের ওপর। 

    কারও তত্ত্ব কাজে আসে। কারও আসে না। কেউ অভাবনীয় কিছু সৃষ্টি করেন। কেউ ডোবেন বিষণ্ণতায়।

    ****

    হেডিংলি টেস্ট জ্যাক লিচের শেষ ইনিংসের একটা হাইলাইটস থাকা উচিৎ। শুধু ব্যাটিংয়ের হাইলাইটস না আসলে, সেটিতে হয়তো কিছুই জানা হবে না। তার মাঠে নামার পর থেকে পুরো ব্যাপারটা। গ্লাভস খোলা, হেলমেট খুলে বা হেলমেটের ফাঁক গলে চশমা বের করা, পকেট থেকে চশমা মোছার কাপড় বের করা, সেটা মোছা- এরপর আবার শেষ থেকে শুরুর কাজটা উল্টোভাবে রিপিট করা। অথবা তার সেই দৌড় এটা ভেবে, স্টোকস সিঙ্গেলটা নেবেন। স্টোকস কী করছেন, সেটি যেন বুঝেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না লিচ। চাপ খেলা করছিল তার সঙ্গে।

    লিচের এসব কান্ড তার ইনিংসের হাইলাইটসে থাকবে না। 

    স্টোকসের ইনিংসের অংশ বলে হয়তো শুধু থাকবে তার সিঙ্গেল নিতে চেয়ে দেওয়া দৌড়টা। স্টোকস ফিরিয়ে দেন তাকে। ফিরে আসতে আসতে তিনি দেখেন, কীভাবে ন্যাথান লায়নের হাত গলে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচটা বেরিয়ে গেল বলের রূপ ধরে। টিম পেইন, ডেভিড ওয়ার্নাররা উদযাপনের দৌড় শুরু করে দিয়েছিলেন। লায়ন বলটা ধরবেন, স্টাম্প ভাঙবেন। জলবৎতরলং। অস্ট্রেলিয়া ফিরিয়ে দেবে ইংল্যান্ডকে এজবাস্টনের স্মৃতি। সেই ২০০৫। টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের কমেন্ট্রিতে বসা (বা দাঁড়িয়ে থাকা) গ্লেন ম্যাকগ্রা, স্কাইয়ের কমেন্ট্রিতে বসা রিকি পন্টিংদের সামনে কি তখন ফিরে আসছিল ১৪ বছর আগের সেই অ্যাশেজ? 

    তবে লায়নের আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল সমীকরণে চাপ নামের চলকের উপস্থিতি বদলে দিল সব। লিচের চোখে-মুখে গোবেচারা ভাব, যেন কিছুই করেননি তিনি। তিনি তখন বনে গেছেন পাড়ার ক্রিকেটার। স্টোকস বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, কী হতে পারতো আরেকটু হলেই! ড্রেসিংরুমে জো রুটদের মাথা থেকে হাত সরে না। লিচের বেঁচে যাওয়া দেখে আনন্দে লাফান স্টুয়ার্ট ব্রড। 


    পরের বলটায় দায়মোচনের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন প্রায় লায়ন। তার বলে হুট করেই কিছু হচ্ছিল না স্টোকসের, আগের ওভারে একটা সিঙ্গেলের বেশি কিছু বের করতে পারেননি। ফাইটিং গেমে অনেক লেভেল পেরিয়ে শেষ বসের সামনে চাপে পড়ে গেলেন যেন তিনি। ইনফ্রন্ট অফ স্কয়ারে ছেয়ে থাকা ফিল্ডারদের দিকে না গিয়ে স্টোকস পেছনে খেলতে চাচ্ছিলেন। শেষ বলে সুইপ করতে গিয়ে মিস করে গেলেন। সামনের প্যাড ছুঁয়ে বল আঘাত করলো পেছনের পায়ে। মুহুর্তের জন্য হয়তো থমকে গেল সময়।

    জোয়েল উইলসন না করে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার আবেদন। চাপে পড়ে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আম্পায়ার? হক-আইয়ে স্টোকসকে মৃত দেখাচ্ছিল, তবে অস্ট্রেলিয়ার রিভিউ ছিল না। আগের ওভারে লিচের বিপক্ষে লেগস্টাম্পের বেশ বাইরে পড়া বলটায় এলবিডব্লিউর রিভিউ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। শেষ জুটি ভাঙার চাপ মরিয়া করে তুলেছিল তাদের। সে রিভিউটা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ালো এ ম্যাচে দুই দলের পার্থক্যের একটি মানদন্ড। 


    ****

    আগেরদিন টানা দুই ইনিংসে শূন্যর চাপ নিয়ে নেমেছিলেন জো রুট। ফিফটি করলেন। ইংল্যান্ডকে মিরাকলের স্বপ্ন দেখালেন। সেই স্বপ্নের ভারেই হয়তো পরদিন নুয়ে পড়লেন। জনি বেইরস্টোর ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো নিরীহ এক বলে। ক্রিস ওকসের কাভার ড্রাইভ মাটিতে থাকলো না। জস বাটলার স্টোকসের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে রান-আউটের ফাঁদে পড়লেন। জফরা আর্চারের আক্রমণ-তত্ত্ব কাজে আসলো না। 

    স্টোকসের জন্য রইলেন শুধু লিচ। 

    বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে তাকে সঙ্গ দিতে শেষ পর্যন্ত কেউ ছিলেন না। ফাইনালে মার্ক উড শেষ বলে সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি, সুপার ওভার অবশ্য বদলে দিয়েছিল স্টোকসের জীবন। মাসখানেকের ব্যবধানে আবার প্রায় একই চিত্র। একদিকে স্টোকস। আরেকদিকে ব্যাটিং অর্ডারের গোলাম।     

    জ্যাক লিচ কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে পারেন না। অ্যাসটিগম্যাটিজম বলে সমস্যা আছে তার। ফলে চশমাই ভরসা তার। সেই চশমা হয়তো হয়ে গেল জ্যাক লিচের চাপ কমানোর উপায়। 

    কদিন আগেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে তার ৯২ রানের ইনিংস ইংল্যান্ডকে দিয়েছিল একরাশ স্বস্তি। ব্যাটিংটা একেবারেই পারেন না, তা নয়। তবে স্টোকসের যেন সেসব মনে নেই। তবে ভরসা রাখতে হচ্ছে তার ওপর। 

    ****

    “প্রত্যেক বোথামের একজন ডিলির দরকার পড়ে।” 
    -মাইক আথারটন। 

    হেডিংলি বললে এতদিন চলে আসতো ১৯৮১। চলে আসতো ইংল্যান্ডের অদ্ভুত এক গ্রীষ্ম- জীবনে, ক্রিকেটে। ইয়ান বোথাম সেই হেডিংলিতে লিখেছিলেন ইংলিশ ক্রিকেটের রূপকথার গল্প, ক্রিকেট হয়ে উঠেছিল ইংলিশদের জীবনের চাপ ভোলার উপকরণ। ব্যাটিংয়ে তার সঙ্গী ছিলেন গ্রাহাম ডিলি, যিনি জানতেন পরের ম্যাচে তার বাদ পড়াটা নিশ্চিত প্রায়। 

    লিচের ডিলি হয়ে ওঠার আগেই স্টোকস হয়ে উঠেছেন বোথাম। অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। 

    স্টোকস এরই মাঝে জাতীয় নায়ক বনে গেছেন ইংল্যান্ডের, লর্ডসের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত করেছে, তাকে চাইলেও ভুলতে পারবেন না ইংলিশরা। আগের টেস্টে সেঞ্চুরি করে ম্যাচসেরা হয়েছেন। তবে ১-০তে পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ড হেডিংলিতে ২-০তে পিছিয়ে যাওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছে প্রায়, প্রথম ইনিংসে ৬৭ রানে অল-আউট হয়ে। 


    দ্বিতীয় ইনিংসে মারনাস লাবুশেনরা অস্ট্রলিয়ার লিডটা নিয়ে যাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডের নাগালের বাইরে। স্টোকস মেশিনের মতো টানা বোলিং করে গেলেন। তাকে সরিয়ে আর্চারকে আনা হলো, আর্চার চোটে পড়ে মাঠের বাইরে গেলেন। সে ওভার পূর্ণ করতে এলেন স্টোকস। আর্চারের ওই ৪ বল বাদ দিলে কার্যত ১৫.২ ওভার টানা করে গেলেন তিনি। টানা বোলিংয়ের চাপটা নিতে পারেন তিনি- শারীরিক ও মানসিকভাবে। 

    তৃতীয় দিন যখন ব্যাটিংয়ে এলেন, অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা যেন হয়ে উঠেছেন স্কেলমাপা। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে টিকে থাকার লড়াইকে মন্ত্র জপলেন স্টোকস। ৫০ বল, ২ রান। এমন ব্যাটিং তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না সাধারণত। লিচের ইনিংসের মতো ম্যাচ হাইলাইটস থেকে তাই হয়তো বাদ পড়ে যায় স্টোকসের ইনিংসের এ অংশও।

    পরদিন ফিফটি করতে খেললেন ১৫২ বল, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির। ততক্ষণে সময় চলকটা হেডিংলি টেস্টের সমীকরণ থেকে বাদ পড়ে গেছে। স্টোকসের তাই কিছু যায় আসে না, তবে বয়ে যাচ্ছিল উইকেটের ধারা। ৬ ও ৯ নম্বর মিলে তুলেছেন ৫১ রান। ৭, ৮, ১০ মিলে ২ রান। ১১ নম্বরকে সঙ্গে নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করাও তাই বাদ পড়লো স্টোকসের সমীকরণ থেকে। 


    ****

    সুইচ অন। সুইচ অফ। জোরে শ্বাস নেওয়া। জোরে শ্বাস ছাড়া। চাপ কমানোর থিওরি। আর সবার স্টোকস সেটিই করছিলেন। 

    তবে তার সঙ্গে অন্য কিছু।

    লায়নকে তুলে মারলেন, তাকিয়ে থাকলেন বলের দিকে। ছয়। আবার তুলে মারলেন। ক্ষণিকের জন্য হেডিংলিতে নীরবতা, বলের নিচে যে দাঁড়িয়ে ফিল্ডার। তাকে সামান্য ব্যবধানে টপকে গেল স্টোকসের শট। হেডিংলিতে উল্লাস। লায়নকে এরপর সুইচ হিটে ছয় মারলেন। সুইচ হিট? না, স্টোকস গ্রিপ বদলাননি। রিভার্স সুইপ? রিভার্স স্লগ সুইপ? কিছু যায় আসে না। ছয়। প্যাট কামিন্সকে করলেন স্কুপ। ছয়। স্টোকস পেরিয়ে গেলেন যেন ফরম্যাটের সীমানা। 

    হ্যাজলউড এলেন। লেগসাইডে পাঁচজন। অফস্টাম্পের বাইরে শর্ট বল। টেনে ওয়াইড লং-অন দিয়ে চার। স্টোকসের সেঞ্চুরি। তবে তাতে কিছু যায় আসে না তার তখন। লো-ফুলটস। ডিপ মিডউইকেট দিয়ে ছয়। লেংথ বল। একই ফল। লেগসাইডের পাঁচজন দর্শক। ওয়েস্টার্ন টেরেসের দর্শকরা মাতোয়ারা। কামিন্স এলেন। লেংথ বল। ডিপ-মিডউইকেটকে যেন নিজের সম্পদ বানিয়ে ফেলেছেন স্টোকস। কেউ তাকে আটকাতে পারছে না। আবার লেংথ বল। এবার ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে চার। ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয়তা এক অঙ্কে নেমে এলো। আর এলো চাপ। এতক্ষণ যেটিকে মনে হচ্ছিল অলৌকিক কিছু, সেটি এখন কড়া নাড়ছে দরজায়। 

    পরের বলে ডাবলস নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তার, লিচ ডাক শুনতে দেরি করে ফেললেন একটু। সিঙ্গেল। লিচ ঠেকিয়ে দিলেন দুই বল, এর মধ্যে পরেরটিতে রিভিউ নিল অস্ট্রেলিয়া। যে রিভিউটা থাকলে গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো হেডিংলির। তবে জুয়া খেলার চাপ সামলাতে পারলেন না পেইনরা।

    পরের ওভারে স্টোকস কোনো একভাবে পেরিয়ে গেলেন লং-অফের সীমানা। অস্ট্রেলিয়া এরই আগে তাদের সেরা ফিল্ডার লাবুশেনকে নিয়ে গেছে সেখানে। শট খেলার পর নীচু হলেন স্টোকস। যেন তাকিয়ে দেখছেন শিকারের জন্য ছোঁড়া গুলিটা লক্ষ্যভেদ করতে পারলো কিনা। হয়তো মুহুর্তের মধ্যে এসে বসা এক জীবনের চাপ সামাল দিচ্ছিলেন। সে চাপ সামলে গেল। তবে চাপ সামলাতে পারলেন না লায়ন। পারলেন না জোয়েল উইলসন। 

    চশমার কারিকুরি করে, কামিন্সের প্রথম দুই বল সামলে, তৃতীয় বলে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিঙ্গেলটা নিয়ে ফেললেন লিচ। এরপর দেরি করলেন না স্টোকস। হয়তো চাপটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছিল তার। কাভার দিয়ে বেরিয়ে গেল বলটা। সবার আগে স্টোকস জেনে গেলেন, কী ঘটেছে। তার ভেতরের সব চাপ বেরিয়ে এলো বুনো উল্লাসের রূপ নিয়ে। ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমের কম্পন হয়তো অনুভব করতে পারলেন আপনি স্ক্রিনের সামনে বসেই। লায়ন আরেকবার শুয়ে পড়লেন, চাপ তার ক্ষেত্রে রূপ নিল হতাশায়। হয়তো বিষণ্ণতায়।

    স্টোকস এরপর নুয়ে পড়লেন। হয়তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না তার, তিনি কী করেছেন। ইংল্যান্ড কী করেছে। লিচ কী করেছেন। সেই লিচই এসে টেনে তুললেন তাকে। 

    ১৯৮১-এর ৩৮ বছর পর হেডিংলি দেখলো আরেক রূপকথা। হয়তো ছাপিয়ে গেল আগেরটিকে। যে রূপকথায় ঢুকে গেলেন স্টোকস। ঢুকে গেল তার চাপ সামলানোর তত্ত্ব। ঢুকে গেলেন লিচ। আর তার চশমা।