জিওফ গ্রিফিন : ক্রিকেটের 'চাকিং' চোরাবালির ট্র্যাজেডি
জিওফ গ্রিফিনের একটা হ্যাটট্রিক আছে। টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিকটি তার। ১৯৬০ সালের লর্ডস টেস্টে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে দুই ওভার মিলিয়ে পরপর তিন বলে মাইক স্মিথ, পিটার ওয়াকার ও ফ্রেড ট্রুম্যানের উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিলেন ২১ বছর বয়সী এ পেসার। তবে গ্রিফিনের ২ টেস্টের ক্যারিয়ারের শেষ হয়ে আছে ওই হ্যাটট্রিক করা লর্ডসই। সে ম্যাচে ‘চাকিং’-এর অভিযোগে যে ১১ বার নো কল করা হয়েছিল তার বলে!
চাকিং বা থ্রোয়িং-এর দায়ে অভিযুক্ত বোলারের সংখ্যা ক্রিকেট ইতিহাসে কম নয়। তবে গ্রিফিনের মতো এই চোরাবালিতে ডুবে এমন ট্র্যাজিক শেষ হয়েছে কম জনেরই।
ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে একবার দূর্ঘটনায় পড়েছিলেন নাটালে জন্ম নেওয়া এই পেসার। সেই থেকে ডানহাত পুরোপুরি সোজা করতে পারতেন না। তার অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বরাবরই। আন্ডার-আর্ম থেকে রাউন্ড-আর্ম, বা ওভার-আর্ম বিতর্ক পেরিয়ে ক্রিকেট তখন চাকিং বা থ্রোয়িংয়ের বেড়াজালে আটকে গেছে, বোলারদের অ্যাকশন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ষাটের দশকে বেশ কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান পেসারকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে বিতর্ক। ১৯৬১ অ্যাশেজের আগে ‘চাকার’দের সরিয়ে দিতে আম্পায়ারদের নির্দেশনা ছিল। গ্রিফিনের অবশ্য ১৯৬০ সফরে দক্ষিণ আফ্রিকা স্কোয়াডে থাকাটাই ছিল একটু বিস্ময়কর।
তবে নাটালের হয়ে আগের মৌসুমে ১২.২৩ গড়ে ৩৫ উইকেট নেওয়া গ্রিফিনকে উপেক্ষা করতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। আগের ঘরোয়া মৌসুমে থ্রোয়িংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত গ্রিফিন যুক্ত হলেন ইংল্যান্ড সফরে। লর্ডসে প্রথমে মিডলসেক্সের বিপক্ষে ম্যাচে নো কল করা হলো তার বিপক্ষে। এরপর ট্রেন্টব্রিজে আবার। গ্রিফিন এলেন আলোচনায়। ইংলিশ মিডিয়া সরব হলো। গ্রিফিনকে পাঠানো হলো আলফ গোভারের বিখ্যাত ইনডোর স্কুলে। যেন পুনর্বাসনে পাঠানো হলো তাকে। গোভার চেষ্টা করলেন, করলেন গ্রিফিনও। তবে হাত তো সোজা করা গেল না!
গ্রিফিনের হ্যাটট্রিক, ডেইলি মিররে/ক্রিকইনফো
তাকে টেস্ট দলে নেওয়া হবে না, এমন অনুমানই করা হয়েছিল। তবে এজবাস্টনে খেললেন তিনি। সেখানে অবশ্য নো কল করা হয়নি তাকে। তবে গতি কমিয়ে এনেছিলেন, সেটি বাড়াতে গেলেই হচ্ছিল সমস্যা। এজবাস্টন টেস্টের পর সাউথাম্পটনে হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে আবারও নো ডাকা হলো তাকে।
একদিন পর লর্ডস টেস্ট, আশ্চর্জনকভাবে গ্রিফিনকে রাখা হলো সেটির একাদশেও। ইংল্যান্ড ইনিংসের তৃতীয় ওভারে প্রথমবার নো ডাকলেন আম্পায়ার ফ্র্যাঙ্ক লি, স্কয়ার লেগ থেকে। বৃষ্টি এলো, বিরতির পর আবারও লি নো ডাকলেন। অবশ্য সেদিন গ্রিফিনের বোলিং দেখা অনেকেই বলেছিলেন, নো ডাকা বা না ডাকা ডেলিভারিগুলির মাঝে আদতে কোনও পার্থক্য দেখেননি তারা।
টেস্টের দ্বিতীয় দিন নতুন বল নেওয়ার আগ পর্যন্ত বোলিংয়ে আসেননি গ্রিফিন। আসার পর চারটি বল করতে পারলেন, এরপর ডাকা হলো টানা দুটি নো। এরপরের বলটি লি-এর চোখে ঠিকই ছিল, তবে তখনকার ব্যাকফুটের নিয়ম অনুযায়ী পা টেনে নেওয়ার কারণে নো ডাকলেন বোলিং-প্রান্তের আম্পায়ার সিড বুলার।
এসবের মাঝেই গ্রিফিন ভাল বোলিং করে যাচ্ছিলেন, স্মিথ বাইরের বলে তাড়া করতে গিয়ে সেঞ্চুরি মিস করলেন ১ রানের জন্য। সেটি ছিল গ্রিফিনের ওভারের শেষ বল, পরের ওভারের প্রথম দুই বলে প্রথমে ওয়াকার ও ট্রুম্যান হলেন বোল্ড। গ্রিফিনের হ্যাটট্রিক শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার নয়, লর্ডসেও প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক। তবে শীঘ্রই ইনিংস ঘোষণা করে দিল ইংল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকা অল-আউট হয়ে গেল ১৫২ ও ফলো-অনে পড়ে ১৩৭ রান করে। চতুর্থ দিন দুপুরের মাঝেই শেষ সেই টেস্ট।
কিন্তু সেদিন চা-বিরতিতে লর্ডসে আসার কথা রাণী এলিজাবেথের। তার সম্মানে ২০ ওভারের প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হলো। গ্রিফিন এবার প্রান্তবদল করে এলেন আম্পায়ার লি-এর দিকে। এবার রোষানলে পড়লেন আরেক আম্পায়ার বুলারের। বুলার স্কয়ার লেগ থেকে পয়েন্টে গেলেন, ভালভাবে দেখলেন, এরপর ডাকলেন নো। ডাকতেই থাকলেন।
শেষ পর্যন্ত অধিনায়ক জ্যাকি ম্যাকগ্লিউকে দিয়ে বার্তা দেওয়া হলো, আন্ডার-আর্ম করলেই শুধু ওভার শেষ করতে পারবেন গ্রিফিন। সেটাই করতে গেলেন, এবার নো ডাকা হলো আম্পায়ারকে ‘আন্ডার-আর্ম’ করবেন সেটি অফিশিয়ালি জানাননি বলে।
চাকিং? থ্রোয়িং? নাকি নয়?/ক্রিকইনফো
আম্পায়াররা যেন গ্রিফিনের বিপক্ষে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন। বলা হয়, এর পেছনে ছিলেন তখনকার এমসিসি প্রেসিডেন্ট গাবি অ্যালেন, চাকিংয়ের বিপক্ষে যিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সে ম্যাচের পর সহমর্মিতা জানাতে গ্রিফিনের কাছে এসেছিলেন ডন ব্র্যাডম্যানও, আম্পায়াররা যে অ্যালেনের আদেশ মানছেন, গ্রিফিনকে সেটি বলেছিলেন তিনিই। সফরের শুরুর দিকে গ্রিফিন এক সার্জনের তৈরি করে দেওয়া প্লাস্টিকের আবরণ পরেও বোলিং করেছিলেন লর্ডসে, তবে সেসবে কিছু যায় আসেনি।
গ্রিফিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল সেখানেই। এক আইনজীবী ব্যাপারটিকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ও সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন তাকে, যাতে বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তার। তবে যে ক্রিকেটকে এতো ভালবাসতেন, সেই খেলার সুনাম নষ্ট করতে চাননি গ্রিফিন।
লর্ডসের পর ইংল্যান্ড সফরে গ্রিফিন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সাথেই ছিলেন, তবে আর বোলিং করেননি। ৯ নম্বরে ব্যাটিং করেছিলেন। দেশের ফিরে নাটাল থেকে রোডেশিয়া গিয়েছিলেন। তবে সেখানেও স্যালিসব্যারিতে কুরি কাপের ম্যাচে নর্থ ইস্টার্ন ট্রান্সভালের বিপক্ষে ম্যাচে ক্রমাগত নো ডাকা হয়েছিল তাকে। সে ম্যাচে খেলেছিলেন ওপেনার রে গ্রিপার।
গ্রিপার বলেছিলেন, আম্পায়ার নো ডাকার পর বিরতিতে গিয়ে ফুলস্লিভ সুয়েটার পরে এসেছিলেন গ্রিফিন। সে গতিতেই বোলিং করছিলেন, আবারও নো ডাকার পর সুয়েটার তুলে দেখিয়েছিলেন, একটা ধাতব আবরণ পরে আছেন তিনি। গ্রিপারও সন্দেহ করতেন গ্রিফিনের অ্যাকশন নিয়ে, তবে সেবার ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন।
তবে সেই ম্যাচের পর আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেননি গ্রিফিন, ২৩ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল তার। ২ টেস্টে ২৪ গড়ে ৮ উইকেট, আর ৪২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২১.৫১ গড়ে ১০৮ উইকেট নিয়ে।
আন্ডার-আর্ম করে ওভার শেষ করছেন গ্রিফিন/ক্রিকইনফো
শুধু ক্রিকেট নয়, গ্রিফিন অন্য খেলাতেও ভাল ছিলেন বেশ। নাটালের হয়ে অ্যাথলেটিকসে হাই জাম্প, লং জাম্প, ট্রিপল জাম্প, পোল ভল্ট ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন, নাটাল অ-১৯ দলের হয়ে খেলেছেন রাগবি। পরে রোডেশিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন হকিতেও।
লর্ডসে গ্রিফিনকে নো ডাকার প্রায় ৩৫ বছর পর এমন নো ডাকা হয়েছিল এক শ্রীলঙ্কান স্পিনারকে, যিনি পরে হয়েছিলেন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক। ১৯৯৯ সালে মুত্তিয়া মুরালিধরনকে আবারও নো ডাকা হলে প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা।
আইসিসি চাকিংয়ের নিয়ম বদলে ফেলেছিল। বোলারের কনুইয়ের ফ্লেক্স বা ভাঁজ ও এক্সটেনশন বা সম্প্রসারণের সহনশীল মাত্রা করা হয়েছিল ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। এখন কোনও বোলারের অ্যাকশন সন্দেহজনক হলে বায়োমেকানিক্স পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে, আছে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। গ্রিফিনের আমলে ছিল না এর কিছুই।
মুরালিধরন একবার টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে প্লাস্টিকের আবরণ পরে তার বোলিং দেখিয়েছিলেন মার্ক নিকোলাসকে। মুরালিকে ক্রিকেট মেনে নিয়েছে, গ্রিফিনকে নেয়নি।
২০০৬ সালে মৃত্যুর আগে গ্রিফিন বলেছিলেন, “আমি ছিলাম অপ্রীতিকর চাকিং-চক্রান্তের শিকার। আমাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল। এর দায়ভার আমি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট ও এমসিসিকে দিই, যাদের উচিৎ ছিল এসব হতে না দেওয়া।”
সেসব না হলে গ্রিফিন কী হতে পারতেন, বা কী দিতে পারতেন, সে প্রশ্নটাই হয়তো সবচেয়ে জটিল। যেমন জটিল এই চাকিংয়ের হিসাব-নিকাশ, আর এর চোরাবালিতে পড়ে গ্রিফিনের মতো কারও ক্যারিয়ার ২৩ বছর বয়সেই শেষ হয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন- ক্রিকেটের চাকিং রহস্য