• আইসিসি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬
  • " />

     

    ক্রিকেটের 'চাকিং-রহস্য'

    ক্রিকেটের 'চাকিং-রহস্য'    

    সনজিত সাহা দীপের প্রথম ইন্টারভিউ করি ফোনে। ওয়ালেটে একটা কাগজে প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াই, দেখি, একটা প্রোফাইলের মতো কিছু করতে হলে আর কী কী থাকা চাই। ফোনে সমস্যা, সময় মেলে না, কথা বলা হয়ে ওঠে না আর! এরপর আবার সুযোগ নেই, ওয়ালেটের সেই কাগজে লেখা প্রশ্নগুলো ততক্ষণে হারিয়ে গেছে। তবে কথা বলতে অসুবিধা হয়না, যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন, কী কী জানতে চাইব আমি! লেখাটা তাই প্রত্যাশার চেয়েও বেশী বড় হয়ে গেল শেষে।

     

    প্রথমবার কথা বলাতেই সনজিত তাঁর অদ্ভূত বা আন-অর্থোডক্স অ্যাকশনের কথা বলেছিলেন, তবে খুব বেশী সময় নিয়ে নয়। তখন তো অ্যাকশন মুখ্য ছিল না! সেই কবে তাঁর বোলিং দেখেছিলাম, তখন সনজিত পেস নাকি স্পিন করতেন, তা-ই মনে নেই! মাঝে শুধু দুই একটা ডেলিভারির ক্লিপিংস দেখেছি। এক বড় ভাই সামনাসামনি দেখেছেন, তবুও দূর থেকে। অ্যাকশন নয়, তাঁর চোখে বেশী করে পড়েছিল, সনজিতের ফ্লাইট দেয়ার প্রবণতা। একটু বেশীই। পরে অবশ্য বলেছিলেন, জোরের ওপর বল করেন তিনি। বলকে টার্ন করাতে চান জোরের ওপরই।

     

    টেলিভিশনে এরপর দেখি সনজিতের বোলিং। প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মতোও! আন-অর্থোডক্সই বটে! সনজিতের অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রথম ম্যাচেই তাঁর অ্যাকশন সন্দেহজনক মনে হয় আম্পায়ার টিম রবিনসন, চেত্তিহরি শামসুদ্দীন আর ফিল জোন্সের। তবে কোচ বা ম্যানেজমেন্ট অবাক হন না। তাঁদের নাকি মানসিক প্রস্তুতিই ছিল এমন। বিশ্বাস ছিল, সনজিতের অ্যাকশন ঠিকই আছে, তবে সন্দেহ হতেই পারে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হলে ২ সপ্তাহের মধ্যে ল্যাব-টেস্ট দিতে হতো সনজিতকে। তবে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের নিয়ম আবার আলাদা। আইসিসির বিশেষজ্ঞ প্যানেল ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে জানাবে, আসলেই সে বোলার বোলিংয়ের যোগ্য কিনা! সে প্যানেল সনজিতের অ্যাকশন নিয়ে আরেকবার সন্দেহ প্রকাশ করে। সনজিতের তাই বিশ্বকাপে আর বোলিং করা হয়নি। ল্যাব-টেস্ট দিতে সনজিত হয় অস্ট্রেলিয়ায় যাবেন, নয়তো ভারত।

     

    ল্যাব পরীক্ষার প্রস্তুতির প্রস্তুতিটাই কেবল শুরু হচ্ছে তাঁর। দেখে খুব একটা বিচলিত মনে হয় না তাঁকে, তবে ভেতরের খবরটা তো আর জানা যায় না! সেই ১৯৬৮ সালে প্রয়াত ইংলিশ লেগস্পিনার ইয়ান পিবলস তাঁর বই ‘স্ট্রেইট ফ্রম দ্য শোলডার’ এ বলেছিলেন এই সন্দেহজনক ‘চাকার’-দের কথা, ‘যতক্ষণ কোনো চাকার বিরক্তি, সন্দেহ বা শারীরিক আঘাতের ভীতির উদ্রেক করে, হোক না অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়াই, ততক্ষণ সে নিজেই হয় সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী!’

     

    ডেলিভারি- শুরু থেকে শেষ 

     

    কারা এই ‘চাকার’ বা ‘থ্রোয়ার’? ক্রিকেটে হঠাৎ করেই ‘অচ্ছুৎ’ হয়ে পড়েন যে এই প্রজাতি, আসলে কেন? ক্রিকেট বেসবল নয়, শুদ্ধবাদীরা এটা প্রায়ই মনে করিয়ে দেন। বেসবল ধিমধাম মারপিটের খেলা, ক্রিকেট নয়। বেসবল ‘থ্রোয়িং’, ‘পিচিং’য়ের খেলা, ক্রিকেট নয়। আপাতত ‘ধিমধাম মারপিট’ কিছুটা চিন্তার বাইরে। চিন্তাটা এখন শুধুই ‘থ্রোয়িং’।

     

    এমসিসি প্রণীত আর আইসিসির স্বীকৃত আইনটা এমন, ‘ডেলিভারি সুইংয়ের যে পর্যায়ে বোলারের বাহু কাঁধের পর্যায়ে আসে, সে পর্যায় থেকে বল ডেলিভারির আগ পর্যন্ত কনুই যদি আংশিক বা সম্পূর্ণ সোজা না হয়, তবে তা বৈধ ডেলিভারি বলে গণ্য হবে। তবে এই নিয়ম অবশ্য কোনো বোলারকে কবজি বাঁকা করা থেকে বিরত রাখবে না।’

     

    এই ‘আংশিক’ কথাটা নিয়েই যতো বিপত্তি। ক্রিকেটে যাঁরা থ্রোয়ার বা চাকার হন, তাঁদের সঙ্গে বেশ মিল আছে জ্যাভেলিন থ্রোয়ারদের। আর হ্যাঁ, আপত্তি কিন্তু বাঁকা করা নয়, সোজা করা নিয়েই! জ্যাভেলিন থ্রোয়াররা যেটা করে থাকেন। বাঁকা হাত শেষ মুহুর্তে গিয়ে সোজা করেন খুব বেশী। এই কনুই সোজা করার ব্যাপারটা মাপা হয় দুই পর্যায়ে। ডেলিভারির সময় বাহু, কনুই যখন কাঁধের সঙ্গে অনুভূমিক থাকে, তখন কনুই যতখানি ভাঁজ (ফ্লেক্স) থাকে, এরপর যখন বল হাত থেকে বেরিয়ে যায়, সে মুহুর্তে কনুই যতখানি প্রসারিত(এক্সটেনসন) হয়, এ দুইটার বিয়োগফলের মাত্রাটাই হলো চাকিংয়ের মূল ভিত্তি। আইসিসির নিয়মের ওই ‘আংশিক’ শব্দটা এখানেই তাৎপর্যপূর্ণ, ‘ফ্লেক্স’ আর ‘এক্সটেনসন’ এর বিয়োগফলের সহনসীমা এখন ১৫ ডিগ্রী। একসময় স্লোয়ারদের জন্য এটি ছিল ৫ ডিগ্রী, মিডিয়াম-পেসারদের জন্য ৭.৫ ডিগ্রী, পেসারদের জন্য ১০ ডিগ্রী। এক মুত্তিয়া মুরালিধরন এসে বদলে দিয়েছিলেন সব নিয়ম। মানে মুরালির অদ্ভূত শারীরিক গঠন তুলেছিল অনেক প্রশ্ন, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই আইসিসি বদলে ফেলেছিল নিয়ম।

     

     

     

    সেই ১৯৯৯ সাল থেকে আইসিসির ‘বায়োমেকানিক্স’ এ সহযোগী ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া’ বা ‘ইউডাব্লিউএ’। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব হিউম্যান মুভমেন্ট’ এর ক্যাম্পাসে তো আসেন কত রকমের ক্রীড়াবিদই, কেউ পারফরম্যান্সের মান বাড়াতে, কেউ নিজেকে বিশ্লেষণ করতে। তবে ক্রিকেটাররা যখন যেতেন, সোয়ান নদীর পাশের ছিমছাম ক্যাম্পাসটাও বুক দুরুদুরু কমাতে পারতো না তাঁদের!

     

    মুত্তিয়া মুরালিধরন যেদিন ল্যাবে গেলেন, ক্যাম্পাসটা ভরে উঠেছিল সাংবাদিক, টেলিভিশন ক্যামেরায়। শোয়েব আখতার যেদিন গেলেন, ল্যাবের দরজাটা খুলে দিতে হয়েছিল, শোয়েবের রান-আপের জন্য! শোয়েব মাঠ থেকে দৌড়ে এসে ল্যাবে ঢুকে বল করতেন! ‘থ্রোয়িং’ এর কথা উঠলেই এ দুইজনের কথা আসে। তবে দুজনই ছাড়পত্র পেয়েছিলেন তাঁদের ‘অদ্ভূত’ শারীরিক গঠনের কারণে।

     

    মুরালির হাত সহজ বাংলায় যাকে বলে, বাঁকা ছিল। সাধারণ মানুষ কোনো চাপ ছাড়া হাত দুই দিকে ছেড়ে দিলে (স্কুলের পিটির সময় 'সোজা হও' এর কমান্ড) যেমন একই রেখা বরাবর থাকে, মুরালির থাকতো না। মানে মুরালির জন্মগত একটা ‘ভাঁজ’ বা ‘ফ্লেক্স’ ছিল হাতে। তাঁর কাঁধের গঠনটাও আবার ছিল অদ্ভূত। অন্য যে কোনো ক্রিকেটারের চেয়ে কাঁধটা বেশী ‘নমনীয়’ ছিল তাঁর, হাত নয়, কাঁধই ঘুরাতে পারতেন তিনি! সব মিলিয়ে একটা ‘ইল্যুশন’ তৈরী হতো, মুরালি চাক করছেন! তবে মুরালি বা তাঁর ডাক্তার, সবারই এক কথা, তাঁর হাত পুরো ডেলিভারি জুড়েই একইরকম বাঁকা থাকে। নিয়মানুযায়ী তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই কোনো।

     

    পরীক্ষা করে দেখা গেল, মুরালির অফস্পিনে সমস্যা নেই, তবে দুসরার সময় কনুইয়ের ‘প্রসারণ’ বা ‘এক্সটেনশন’ ১০ ডিগ্রী এর মতো। স্লো বোলারদের জন্য আবার আইসিসির সহনশীলতার মাত্রা ৫ ডিগ্রী মোটে। উপায়? মুরালি বললেন, তাঁর হাত চলে পেসারদের মতোই দ্রুত। বোলিংয়ের জন্য তাঁকে খুব তাড়াতাড়ি কাঁধের সঙ্গে হাত ঘুরাতে হয়। অবশ্য আইসিসির এই বিভিন্ন রকম বোলারদের জন্য বিভিন্ন রকম ডিগ্রীর মানে সমস্যাও ছিল। পেসাররা যদি স্লো বল করেন? স্পিনাররা যদি ‘কুইকার’ করেন? মুরালি প্রশ্নগুলোকে উসকে দিয়েছিলেন। রস এমারসন মুরালির বলে নো ডেকেছিলেন, তারপর ডেকেছেন ড্যারেল হেয়ার। অর্জুনা রানাতুংগা দল নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেছেন। মুরালি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন, টিভি ক্যামেরার সামনে হাতে ‘ব্রেস্ট’ পরে দেখিয়েছেন, তিনি হাত বাঁকা রেখেই সব রকম ডেলিভারি করতে পারেন, অফস্পিন, টপস্পিন, দুসরা।

     

    আইসিসি এরপর সব বোলারদের জন্য সহনশীলতার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দিল। ১৫ ডিগ্রী, ২০০৪ সাল।

     

    এরও আগে শোয়েব আখতারের অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ তুলেছিলেন আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার আর পিটার উইলি। ম্যাচ রেফারি জন রিড এরপর আইসিসিতে ‘অফিশিয়াল’ অভিযোগ তুলেছিলেন। শোয়েবকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শোয়েব যখন ইউডাব্লিউএ-তে অ্যাকশন শোধরানোর কাজে ব্যস্ত, তখনই দেখা গেল, শোয়েবের কনুইয়ে ‘হাইপার-এক্সটেনশন’ আছে। মুরালির ছিল ভাঁজ, শোয়েবের আবার ‘এক্সটেনশন’। সাধারণ অবস্থায় যেখানে বাহু, কনুই কবজি মিলে ১৮০ ডিগ্রী কোণ করার কথা, শোয়েবের তার চেয়ে বেশী ছিল। আইসিসির বোলিং প্যানেলে মাইকেল হোল্ডিং ছিলেন, সে প্যানেল বলেছিল, এক ধরণের শর্টপিচ বল করতে গেলে শোয়েব হাত বেশী ‘ভাঁজ’ করেন, সেটা করা যাবে না। পিসিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে তখনকার আইসিসি প্রেসিডেন্ট জাগমোহন ডালমিয়ার ‘খাতির’ ছিল। শোয়েবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলো। ইউডাব্লিউএ-তে যাঁর অধীনে শোয়েব কাজ করেছিলেন, তিনি ড্যারেল ফস্টার। শোয়েবের অ্যাকশনটাও অদ্ভুত ছিল, ওপর-থেকে-নীচে না হয়ে সব শক্তি যেন শোয়েবের বুক চিরে বেরুত। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে সেই ফস্টারই পাকিস্তান দলের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। শোয়েব কোনো এক ম্যাচের আগে বলেছিলেন, চতুর্থ ওভারের শেষ বলটা তিনি ১০০ মাইল বেগে করবেন। ফস্টার হেসেছিলেন সে কথা শুনে, শোয়েব ঠিক ঠিক তাই করার পরার হেসেছিলেন আরও বেশী!

     

    শোয়েবের হাইপার-এক্সটেনশন

     

    শোয়েবের মতোই ‘হাইপারএক্সটেনশন’ ছিল জেনি গান-এর। ইংল্যান্ড মহিলা দলের এই পেসারকে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে একসময় নিষিদ্ধ করা হয়। ক'দিন পর বিশ্বকাপ, সেখানে আবার খেলতে বাধা ছিল না কোনো। তবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রথম ম্যাচের পরই তাঁর অ্যাকশন আবার সন্দেহজনক হলো। আইসিসির বিশেষজ্ঞ কমিটি ফল দিল, গানের হাতে ‘এক্সট্রিম-হাইপারএক্সটেনশন’ আছে, যা একরকম ভ্রম সৃষ্টি করে। গানের অ্যাকশনকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হলো। ঘটনা ২০০৯ সালের।

     

    একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইসিসি যে ‘শুদ্ধিকরণ’ পথে হেঁটেছিল, তা যেন নতুন করে ফিরে এল। তবে কিছুটা ‘একাডেমিক’ সমস্যায় পড়লো আইসিসি। লফবরো বিশ্ববিদ্যালয় আর ইউডাব্লিউএ, এ দুই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। ইউডাব্লিউএ-এর গবেষণাসংখ্যা বেশী, দুই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পদ্ধতির মাঝে পার্থের প্রতিষ্ঠানেরটাই বেছে নিল একটা নিরপেক্ষ কমিটি।

     

    মাঠ ছেড়ে পরীক্ষাগারে জোহান বোথা 

     

    তবে আইসিসি জুড়ে দিল শর্ত। পরীক্ষাপদ্ধতি হতে হবে সোজাসুজি, এবং দিন দিন পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়াতে হবে। পার্থের অবস্থান এমনিতেই এক কোণে, তার ওপর বিশেষজ্ঞ বলতে ছিলেন শুধু একজন, ডঃ জ্যাকলিন অ্যালডারসন। সুতরাং বাড়াতে হবে পরীক্ষার উৎকর্ষতাও। আইসিসির মতে ইউডাব্লিউ তাঁদের দেয়া শর্তের প্রথম ধাপই পেরুতে পারেনি। ২০১৪ সালের মার্চ, প্রতিষ্ঠানটি আইসিসির সঙ্গে সকল ধরণের সম্পর্ক ‘ছিন্ন’ করলো। কারণ হিসেবে সেই ডেভিড ফস্টারই বলেছিলেন, তাঁরা আইসিসির সঙ্গে পরীক্ষাকেন্দ্র প্রসারণে রাজি হয়েছিলেন, তবে তাঁদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা হবে, তাঁদের অনুমতি না নিয়েই, এজন্য নয়।

     

    আইসিসি বললো, তাঁরা নিজস্ব লোকবল দিয়ে নতুন পদ্ধতি বের করতে কাজ করে যাচ্ছে। আর ইউডাব্লিউএ একটা একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে, নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান আসলে তাদের লাইসেন্সের ব্যবস্থা রাখারও নাকি ইচ্ছা পার্থের সে বিশ্ববিদ্যালয়ের! অ্যাকশন সংক্রান্ত বিষয়ে আইসিসিকে অনেক ‘জ্ঞান’ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটার সঙ্গেই আইসিসির সম্পর্ক তাই টিকলো না। গড়ে উঠলো নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র। লফবোরোতে, ব্রিসবেনে, চেন্নাইয়ে, কার্ডিফে, প্রিটোরিয়ায়। একটা হওয়ার কথা পাকিস্তানেও। আইসিসির এ নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

     

    নতুন পদ্ধতি এলো। আইসিসির শুদ্ধিকরণ যেন পেল অন্য এক মাত্রা! জুন, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ জনের বোলিং অ্যাকশন সন্দেহজনক হয়েছে, নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাতজন, ফিরে এসেছেন প্রায় সাতজন।

     

    ইউডাব্লিউএ বা জ্যাকলিন অ্যালডারসন অবশ্য আইসিসির নতুন পদ্ধতিকে ‘ভুল’ বলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ’১৫ ডিগ্রী এর সহনশীলতা মাপতে আসলে কোনো ভুল বা সঠিক রাস্তা বলে কিছুই নেই!’ তবে নতুন পদ্ধতিতে সুবিধাও আছে। যে বোলিং অ্যাকশনের কারণে কোনো বোলারকে সন্দেহ করা হয়, ল্যাবে সেই অ্যাকশনটা মিলিয়ে দেখা এখন বেশ সহজ।

     

    কাজটা সহজ হয়েছে আম্পায়ারদের জন্যও। আইসিসির এই ল্যাব পরীক্ষার আগের যুগে আম্পায়াররা যখন মাঠেই নো বল ডাকতেন, বোলারদের জন্য তা ছিল ক্যারিয়ারনাশের সমান। অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি পেসার ইয়ান মেককিফের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল, যখন আম্পায়ার কলিন এগার এক ওভারে তাঁকে চারবার নো ডেকেছিলেন। ড্যারেল হেয়ার বা রস এমারসনের ক্যারিয়ারও বিতর্ক নিয়ে শেষ হয়েছে, মূলে ছিলেন তো ওই মুরালিধরনই। সেখানে এখন কাজটা সহজ, ব্রুস অক্সেনফোর্ড, রড টাকার বা রিচার্ড ইলিংওর্থদের জন্য। সন্দেহ হলে তাঁরা ম্যাচ রেফারির কাছে রিপোর্ট করেন, বাকিটা দেখার দায়িত্ব বায়োমেকানিক্সদের, আইসিসির। বিতর্ক হলে আইসিসিই সামাল দিবে, বিতর্কের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে কোনো এক পরীক্ষাগার। সেখানকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করা যাবে, আবার পরীক্ষা দেয় যাবে। আইসিসির এক অফিশিয়ালের মতে, ‘আমরা বোলারদের বিচার করতে যাই না। তাঁরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে, গতি আর পেশীর মাঝে সমন্বয় করতে। আমরা শুধু আইনটা দেখি, যদি মনে হয় আইন ভঙ্গ হচ্ছে, রিপোর্ট করি। বাকীটুকু বিজ্ঞানের কাজ।’

     

    আরাফাত সানি ও তাসকিন আহমেদ- যে দুজনের অন্তর্ভুক্তি বিতর্কই বাড়াচ্ছে শুধু! 

     

    বিজ্ঞানটাই কিন্তু আসল। যখন ক্রিকেট জানলো, হাত পুরো সোজা রেখে বল করা সম্ভব নয়, আনা হলো সহনশীলতার মাত্রা। হাত কতখানি ভাঁজ করা যাবে, আবার কতখানি সোজা করা যাবে। তবে বিজ্ঞানের প্রয়োগটা এত সোজা নয়। ইয়ান পিবলস তাঁর বইয়েই লিখেছিলেন, ইংলিশ বাঁহাতি স্পিনার টনি লকের কথা। যখন স্কুলের ইনডোরে অনুশীলন করতেন, নেটটা যথেষ্ট উঁচু ছিল না ফ্লাইট মনমতো করতে। লক তাঁর ‘ট্র্যাজেকটরি’ পরিবর্তন করলেন, অজান্তেই পরিবর্তন এলো অ্যাকশনেও। যখন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে নামলেন, নো ডাকা হলো তাঁকে। সে পর্যায়ে গিয়ে অ্যাকশন পরিবর্তন করার ‘অসুবিধা’টা মানতে পারেন নি লক। অ্যাকশন শোধরাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।


    আরো পড়ুনঃ তাসকিনের নিষেধাজ্ঞা এবং কিছু সওয়াল-জবাব


     

    অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার এক বোলার একবার কাঁধের চোটে পড়েন। অস্ত্রোপচারের পর আগের অ্যাকশনে ফিরে যেতে পারেননি, গতি ধরে রাখতে কনুই বেশী বাঁকা করতে হচ্ছিল তাঁর। তবে পরীক্ষাগার তা মেনে নেয়নি, বোলিং অ্যাকশনটাও তাই ‘অবৈধ’! ক্রিকেট আর বিজ্ঞান, এ দুই সম্বন্ধে বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের প্রখ্যাত ধারভাষ্যকার জন আরলট একবার ল জার্নাল-এ লিখেছিলেন, ‘থ্রোয়িংয়ের সংজ্ঞা বের করাটা আইনজ্ঞ আর অ্যানাটমিস্টদের কাজ। ক্রিকেটারদের নয়।’

     

    তাহলে এই যে সহনশীলতার মাত্রা? বৈধ বোলিং অ্যাকশন, অবৈধ অ্যাকশন? হাত ভাঁজ করে, ভাঁজ করা হাত সোজা করে আসলে কী ‘অন্যায্য’ সুবিধা পান বোলাররা?

     

    সাঈদ আজমল- 'শোধরানো' অ্যাকশনে ফুরিয়ে গেছে জাদু! 

     

    ডঃ মার্ক পোর্টাস সেইসব বিজ্ঞানীদের অন্যতম, যাঁদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আইসিসি ১৫ ডিগ্রী এর সীমাটা নির্ধারণ করেছিল। পোর্টাস তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, ‘ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে, কনুই সোজা করা আর বলের গতির মাঝে।’ তবে দুইটা আবার এমন হতে পারে যে একটা আরেকটার ফল। কোনো বোলার হয়তো দ্রুত বল করছেন, শরীরের ভেতরকার জড়তা, ছন্দ ধরে রাখার সামঞ্জস্য রাখতেই হয়তো বোলাররা ডেলিভারির আগে কনুইটা সোজা করে ফেলেন! পোর্টাস নিজেই বলেছিলেন, ‘এটা(হাত সোজা করা) একটা ফল হতে পারে দ্রুত বল করার, কারণ নয়। তবে আমরা কোনটিই প্রমাণ করিনি এখনও, হতে পারে সে ধারণা করেছি।’ পোর্টাস আবার এটাও বলেছিলেন, ‘সম্প্রসারণ(এক্সটেনসন) ও সোজা করা(স্ট্রেইটেনিং) এর মাঝেও তফাৎ আছে।’

     

    তবে পোর্টাসদের ধারণা নিয়েও আবার প্রশ্ন উঠেছে। কেন মিডলটন একজন বায়োমেকানিস্ট, ইউডাব্লিউএ-তে সাঈদ আজমলের যখন প্রথমবার পরীক্ষা করা হয়, সে পরীক্ষক দলের সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁর পিএইচডি গবেষণাপত্রে তিনি বলের গতির সঙ্গে হাত সোজার করার সম্পর্কটা আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছেন।

     

    অস্ট্রেলিয়ার গ্রেড ক্রিকেটের ১২ জন বোলারকে দিয়ে তিনি ২০টি করে ডেলিভারি করিয়েছিলেন। ফলটা কিছুটা চমকপ্রদই, ‘আমার ১২ জন বোলারের ১০ জনই ডেলিভারির আগ মুহুর্তে হাত সোজা নয়, ভাঁজ করে। স্পিনারদের জন্য এটা সাধারণ নয়। তবে পেসারদের অবশ্য এই প্রবণতাটা থাকে। আমরা দেখেছি, যেসব বোলার ডেলিভারির আগে কনুই ভাঁজ করে, তাদের গতি বৃদ্ধি পায়। কনুই সোজা করলেই বরং গতি কমে যায়। পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু উল্টো, এখনকার নিয়ম বা যেভাবে এই পুরো বিষয়টা দেখা হয় তার থেকে!’

     

    আরেকটা গবেষণাপত্র আবার বলছে, ''এই ‘অবৈধ’ বোলিং অ্যাকশন ঠিক করার পুরো কায়দাটাই বেঠিক! সহনশীলতার মাত্রা যে ‘ভাঁজ’ থেকে ‘সোজা’ এর মাঝের কোণ(ডিগ্রী) দিয়ে মাপা হয়, তা না করে দেখা উচিৎ এই দুইয়ের মাঝের গতিটা(ভেলোসিটি, বেগ)। যদিও যারা থ্রো(চাকিং) করে, প্রায় সবাই ১৫ ডিগ্রী এর সীমা অতিক্রম করে, তবে এই গবেষণাপত্র দেখাচ্ছে, ১৫ ডিগ্রী এর মাঝে থেকেও থ্রো-এর মতো অ্যাকশন করা যায়। যদি এটাই প্রস্তাবিত হয় যে, এসব ব্যাপার ক্রিকেট বোলিংয়ের সঙ্গে যায় না, তবে বোলারের কনুই সম্প্রসারণের কোণিক বেগ, কনুইয়ের পরম(অ্যাবসলিউট) কোণ বিবেচনায় আনা উচিৎ।''

     

    সোহাগ গাজী- নতুন অ্যাকশনে হারিয়ে খুঁজছেন নিজেকে 

     

    তবে আইসিসির বর্তমান সহনশীলতার মাত্রা নিয়ে আপত্তি নেই কারও। অনেকেরই মত, আরও সুক্ষ্ণ বিষয় বিবেচনায় আনতে গেলে শুধু জটিলতায় বাড়বে! আইসিসির চিন্তাভাবনাও বোধহয় সেরকমই, সেই ২০০৪ সালের ধারনাতেই আবদ্ধ থাকা, ‘অধিকাংশ লোকই মনে করে, হাত সোজা করার ব্যাপারে আমাদের প্রাচীন ধারণাই পোষণ করা উচিৎ। বিষয়টা সরল।’

     

    তবে আইসিসি কিন্তু জটিল চিন্তাভাবনার দিকেই এগুচ্ছে। এ বছরের শেষের দিকেই হয়তো আন্তর্জাতিক ম্যাচে বোলারদের বোলিং-বাহুর ওপর সেন্সর বসানো হবে, যেটা তথ্য সংগ্রহ করবে, আসলে হাত সোজা বা বাঁকা করার ওপর কী কী প্রভাব পড়ে! ২০১৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের অনুশীলন সেশনে কিছু ওভার এর আওতায় আনা হয়েছিল। তবে এর একটা পরবর্তী ধাপ আছে। এই সেন্সর কার ওপর বসানো হবে, কোন কোন ম্যাচ বা কোন ধরণের বোলার এর আওতায় আসবে, উপমহাদেশের গরম, রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ায় এটি কেমন কাজ করবে, অথবার ওয়েলিংটনের হিমশীতল পরিবেশেই বা কেমন, ঠিক করা হয়নি কিছুই। হয়তো জটিলতার কথা ভেবেই!

     

    আল-আমিন- উৎরে গেছেন ভালভাবেই! 

     

    যদি মাঠের মধ্যেই ক্রিকেট অ্যাকশনের ‘বিচার’টা করা যায়, তাহলে তো হয়েই গেল! সব জানা অজানার অবসান হবে, হয়তো অবসান হবে অনেক বিতর্কেরও! প্রযুক্তি যখন মানুষের সাথে মিশেছে, জটিলতা শুরু হয়েছে তো তখন থেকেই! ক্রিকেটে প্রযুক্তিও তো তাই! আম্পায়ারের ভুল এড়াতে প্রযুক্তি এসেছে, সেই প্রযুক্তি আবার জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন ভুলের! গ্রহণযোগ্যতাটা তাই সর্বজনব্যাপী হচ্ছে না কোনোমতেই!

     

    সেখানে বোলিং অ্যাকশন তো আরও বেশী জটিল! ‘থ্রোয়িং’ বা ‘চাকিং’ এর সুবিধাটা কী, নিশ্চিত নয় তো সেটাই! যখন ১৫ ডিগ্রী এর সীমা নিয়ে আসা হলো, বিষাণ সিং বেদীদের মতো কেউ কেউ নাখোশ হলেন। খুশী হলেন আবার মুরালিধরনরা। ক্রিকেট ভালবাসেন তো দুই শ্রেণীর মানুষই! তবে কি সহজ উপায়, থ্রোয়িং বৈধ করে দেয়া? আমেরিকার বেসবল লিগে একবার স্টেরয়েড নেয়া বৈধ করা হয়েছিল। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স এতটাই বেড়েছিল যে, সেটাও আর দর্শকদের আগ্রহ জোগাতে পারছিল না! হোম রান তো তখন মুড়ি-মুড়কি! ক্রিকেটেও তো তাই। ব্যাটসম্যানদের হাত এতটাই খুলে দেয়া হয়েছে, ওয়ানডেতে চারশ রান এখন হয়ে গেছে নতুন তিনশ। ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেই তাই এখন লো-স্কোরিং ম্যাচে প্রতিন্দ্বন্দ্বীতার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন! থ্রোয়িং বৈধ করে দিলে কি এটি নিজেই খুঁজে নেবে এর সংস্কার! কে জানে!

     

    বোলিং অ্যাকশনের সঙ্গে যে বিজ্ঞান জড়িয়ে, ক্রিকেট বা ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরাও জানেন খুবই সামান্য। আর ‘অবৈধ’ অ্যাকশনের ব্যাপারটাও কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসার আগেই ঠিক করা প্রয়োজন নয়? হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমনও দেখা যাবে, আইসিসি সব বোলারদেরই ‘সার্টিফিকেট’ বা ‘লাইসেন্স’ দিচ্ছে। তখন হয়তো কেউ বলবেন, ‘আহারে, লাইসেন্সটাই পাচ্ছে না! অভিষেকটা নাহলে হয়েই যেত!’

     

    বিজ্ঞানের যে অথৈ সাগর, ক্রিকেট তো তার সৈকতেই নুড়ি পাথর কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখনও!

     

    তথ্যসূত্রঃ
    ১. আইসিসি

    ২. এমসিসি

    ৩. লফবরো ইউনিভার্সিটি, ইউকে

    ৪. ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া

    ৫. ইএসপিএনক্রিকইনফো

    ৬. বিবিসি

    ৭. চ্যানেল ফোর, ইউকে