• ইংল্যান্ডের ভারত সফর
  • " />

     

    ঋষভ, আপনি হাসতে থাকুন

    ঋষভ, আপনি হাসতে থাকুন    

    কুলদিপ যাদব হাসছেন। পেছনে মোহাম্মদ সিরাজও তাই। 

    সিরাজ এ টেস্টে খেলেছেন, কুলদিপ পরের টেস্টটা কবে খেলবেন সেটি নিশ্চিত নয়। এ সিরিজে অভিষেক হওয়া আক্সার প্যাটেল নিয়েছেন ২৭ উইকেট, চোটের কারণে বাইরে রবীন্দ্র জাদেজা, রবি আশ্বিন হয়েছেন সিরিজসেরা, ওয়াশিংটন সুন্দর ভারতের ব্যাটিং-লেজের দৃঢ়তা বাড়াচ্ছেন শুধু। তবে আপাতত কুলদিপ হাসছেন পান্টের ইনিংসে।

    আহমেদাবাদের নতুন স্টেডিয়াম ড্রেসিংরুমের সিঁড়িটা দীর্ঘ, এমনিতেও টি-টোয়েন্টির যুগে মাঠে ড্রেসিংরুমের বাইরে এখন আলাদা ডাগ-আউট থাকে। কুলদিপ-সিরাজরা ছিলেন সেখানেই। ঋষভ পান্ট একটু আগে জো রুটকে স্লগ করেছেন, ৯৪ থেকে সেই শটে পৌঁছে গেছেন জাদুকরি তিন অঙ্কে। এর আগে পান্টের শেষ ৪ ফিফটির তিনটিতে সেঞ্চুরি থেকে দূরত্ব ছিল ৩, ৯ ও ১১ রানের। পান্টের মুখে শুরুতে হাসি ছিল, খানিক বাদে সেটি রূপ নিল স্বস্তিতে। কুলদিপের হাসিটা থাকলো একই। 

    পান্টের ইনিংস মনে করিয়ে দিল আরেকবার, জীবনে আপনার একটু হলেও হাসির দরকার, সবকিছু ভুলে। জীবনের সঙ্গে ক্রিকেট মিশে গেলেও দিনশেষে এটা খেলা, যে খেলা আপনি যেই হন না কেন, একেবারে শুরুতে খেলতেন বা দেখতেন শুধু মনের আনন্দেই। 

    অ্যান্ডারসনকে পুল করতে গিয়ে শর্ট মিডউইকেটে ধরা পড়ে পান্ট নিজের ওপর রাগ ঝাড়লেন, মাঠ ছাড়ার আগে মুখে একটু হাসি ঝিলিক মেরে গেল। তার ইনিংসটা এমনই, ৯৪ থেকে তিন অঙ্কের দিকে যেতে যে র‍্যাপিড-ট্রানজিটে চড়লেন, সেটি মুখ থুবড়ে পড়লেও সে হাসিটা লেগে থাকতো তার ইনিংসে, তার ব্যাটিংয়ে, যারা দেখেছেন, তাদেরও মুখে। থাকা উচিৎ। 

    **** 

    মাইলফলক সবসময়ই একটা মানসিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কিছুটা যন্ত্রণাও। তবে মাইলফলকের আরেকটা অর্থ-- আপনি পেরিয়ে এসেছেন অনেকটা পথ। সে পথে হেঁটে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। সে আত্মবিশ্বাস আপনার বাকি পথটা সহজে পার করে দিতে পারে, আবার কখনো হয়ে দাঁড়াতে পারে বুমেরাং-ও। 

    বীরেন্দর শেওয়াগ তাই নিজের এবং ভারতের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির সামনে দাঁড়িয়ে, ২৯৫ থেকে মাইলফলকে যেতে পারেন সাকলাইন মুশতাককে ছয় মেরে। শেওয়াগ আবার অস্ট্রেলিয়ায় নিজের ‘প্রথম’ ডাবল সেঞ্চুরি মিস করেছিলেন ওই ছয় মারতে গিয়েই। তবে তার মাইলফলক নিয়ে আফসোস ছিল না, আফসোস ছিল সে শটটা আর তিন গজ গেলেই বাউন্ডারি পেরুতো। সবাই শেওয়াগের মতো করে ভাবেন না, সবার ব্যাটিং দেখলে সবার আগে আনন্দ বা ‘ফান’ ব্যাপারটা আসে না।
     


    এখন পর্যন্ত ২০ টেস্টের ক্যারিয়ারে পান্টের ফিফটি ৬টি, এর মাঝে ৪ বারই তিনি আউট হয়েছেন নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে-- প্রতিবারই বাউন্ডারি শটের চেষ্টায়, তা ম্যাচের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। অবশ্য এই শেষ কথার অর্থ একটু মিসলিডিং হতে পারে, মনে হতে পারে ম্যাচের প্রেক্ষাপট পান্ট বুঝতে পারেন না। আদতে যে পেস আর যে স্টাইলে তিনি খেলে এসেছেন, মাইলফলক দৃষ্টিসীমায় থাকলেও সেটি বদলায় না। আহমেদাবাদেও যেমন বদলালো না। 

    ক্যারিয়ারে এটি তার তৃতীয় সেঞ্চুরি, দ্বিতীয়টি পূর্ণ করেছিলেন চার মেরে। ২০১৮ সালে ওভালে প্রথমটি পূর্ণ করেছিলেন ছয় মেরে। সেবার আগেই সিরিজ হেরে বসা ভারত-- বা বলা যায় লোকেশ রাহুল ও ঋষভ পান্ট-- শুধু অ্যালেস্টার কুকের বিদায়ের ক্ষণটাই বিলম্বিত করছিল যেন। 

    সেদিন অ্যান্ডারসনের ৮ বল খেলেছিলেন পান্ট, করেছিলেন ১ রান। ১১৭ বলে পূর্ণ করেছিলেন সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারে তৃতীয় টেস্ট ছিল সেটি। অ্যান্ডারসন ভারত ইনিংসের শেষ উইকেট নিয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে হয়েছিলেন ইতিহাসের সফলতম পেসার। কুককে বিদায় দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হওয়ার আগে সেই সময়টায় তিনি হাসছিলেন শুধু।

    **** 

    শেষ ইংলিশ গ্রীষ্মেই ইতিহাসের প্রথম পেসার হিসেবে ৬০০ উইকেট বসে গেছে অ্যান্ডারসনের নামের পাশে। চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্টে তার ১ ওভার হয়তো ইংল্যান্ড এ সিরিজে তেমন কিছু করতে পারলে ঢুকে যেতো লোকগাঁথায়। এ টেস্টে তার ২৫ ওভারের ১৪টি করেছেন মেইডেন। দেখিয়েছেন, আর যাই হোক না কেন, এই ৩৮ বছর বয়সে এসে, কন্ডিশন যেটাই হোক না কেন, অন্তত পরিস্থিরির দাবি মেটাতে পারেন তিনি। 

    এ ইনিংসে তিনি চার খেয়েছেন ৭টি, এর ৫টিই মেরেছেন পান্ট। প্রথমটি ১ রানে দাঁড়িয়ে, এজড হয়েছিলেন, যদিও খেলেছিলেন সফট হ্যান্ডে। পরেরটি অফস্টাম্পের বাইরে, কাভারে স্ল্যাপ, তখন রান ৮। ৮১তম ওভারে দ্বিতীয় নতুন বল নিয়ে যখন অ্যান্ডারসন এলেন, পান্টের রান ৭৫। ১৭ ওভারে ১১ মেইডেন অ্যান্ডারসনের, দিয়েছেন ২০ রান। ভারতের লিড ১৮, ম্যাচের পরিস্থিতিতে তার সেই স্পেল হতে পারে ইংল্যান্ডের শেষ লাইফলাইনের একটি। 

    পান্ট প্রথম বলে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে চার মারলেন, দ্বিতীয় বলে কাভার দিয়ে-- “অ্যান্ডারসন হু?” অ্যান্ডারসন সে ওভারে কামব্যাক করলেন ঠিকই, তবে পান্ট তার ট্রাম্পকার্ডটা বের করলেন পরের ওভারে। স্টাম্পঘেঁষা লাইনে গিয়েছিলেন, পান্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, করলেন রিভার্স স্ল্যাপ। সে শটে ঔদ্ধত্য, সে শটে আনন্দ। সে শটটা পান্টের। 

    ২০১৪ সালের পর অ্যান্ডারসনের বলে রিভার্স সুইপ বা পুল ধরনের কোনো শট খেলেননি কোনো ব্যাটসম্যান। ২০১৫ সালের পর সীমিত ওভারে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি অ্যান্ডারসন। তাকে সেই বিস্মৃত স্বাদ দিলেন পান্ট। অ্যান্ডারসন যেন ধন্দে পড়ে গেলেন, এ শটে কী প্রতিক্রিয়া দেবেন সেটি নিয়ে। 

    হয়তো মনে মনে একটু হাসলেন তিনি। 

    **** 

    “আমি আসলে এখনও সমস্যা খুঁজে পাইনি কোনো, (কারণ) ব্যাপারটা যতোই জটিল হোক না কেন, যদি ঠিকঠাক দেখতে পারেন তাহলে সেটা আগের চেয়ে জটিলতর হয়ে ওঠে না…”
    -আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক পোউল অ্যান্ডারসন 

    প্রেক্ষাপট, স্নায়ুচাপ, ফর্ম, ইনিংস, সিরিজ, বোলার--  পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে যতো চলকই থাকুক না কেন, দিনশেষে ব্যাটিং কিন্তু এসে ঠেকে ঠিক পরের বলটা খেলার ওপর। যেন পাটিগণিতের সরল অঙ্ক, বলবে সরল করতে, অথচ প্রক্রিয়া কতো জটিল মনে হয়! 
     


    “আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে পছন্দ করি, বল দেখি, সে অনুযায়ী রি-অ্যাক্ট করি, আমার খেলার স্টাইল এটাই”, আহমেদাবাদের সেঞ্চুরির পর বলেছিলেন পান্ট। 

    পান্ট তাই অ্যান্ডারসনের বলে রিভার্স ল্যাপ করতে পারেন, নতুন বলে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে আসতে পারেন, সে বলের পরিস্থিতি যে তার কাছে মনে হয়েছিল তেমনই। পান্টের এমন সরল ব্যাটিং তাই বদলে দেয় ম্যাচের গতিপথ-- সিডনিতে, গ্যাবায় কিংবা আহমেদাবাদে।

    পান্টের ক্যারিয়ারে নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, বয়স বাড়বে, অ্যান্ডারসনের মতো লম্বা ক্যারিয়ারের জন্য পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। তবে তার আগে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রতিক্রিয়া দেখানোর যুগে, দ্রুত রি-অ্যাক্ট করার তাড়নার মাঝেও পান্টের ব্যাটিং দেখে সেই আনন্দটা-- যেটার জন্য খেলা বা দেখা শুরু করেছিলেন-- অনুভব করা আপনি চাইবেন, পান্ট একই থাকুন। অন্তত ব্যাটিংয়ে তার সরলীকরণের এই মন্ত্রটা। 

    ****

    স্টাম্পের পেছনে পান্ট অনর্গল কথা বলেন। হার্শা ভোগলের মতে, তিনি কমেন্টেটরদের কাজ একটু কঠিন করে তুলছেন, কারণ সবাই এখন তাদেরকে চুপ করতে বলে স্টাম্প মাইকের ভলিউম বাড়াতে বলেন।  

    তবে উইকেটকিপিং তো শুধু পেছন থেকে কথা বলা নয়, এটি যে স্কিলের, পান্টের সেটি নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। এ সিরিজে পান্ট দেখিয়েছেন তার সেই স্কিলের উন্নতি। ক্রমাগত অনুশীলন কাজে দিয়েছে, ব্যাটিংয়ের আত্মবিশ্বাস অনূদিত হয়েছে উইকেটকিপিংয়ে। তবে ব্যাটিংটা তার ছোট অথচ আলোচিত ক্যারিয়ারে আছে আগের মতোই-- বল দেখো, রি-অ্যাক্ট করো। 

    আহমেদাবাদে তার ব্যাটিংয়ের সময় ভোগলে বলছিলেন ‘ফান’ শব্দটা। ম্যাচশেষে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে দেখে মনে হয়, এতো উপভোগ করছেন ব্যাটিংটা, এতো আনন্দ নিয়ে খেলছেন, তার কারণটা। 

    “স্যার”, পান্ট ভোগলেকে স্যার বলেই সম্বোধন করছিলেন, “ছোটবেলা থেকে এটাই ভেবে এসেছি, যে ক্রিকেটই খেলি না কেন, উপভোগ করেই খেলতে হবে। হাসতে হাসতে খেলব, আশেপাশের মানুষ হাসবে-- এটাই আমার কাজ। দল জিততে থাকবে, নিজে হাসতে থাকব, এটাই ভেবে এসেছি।” 

    আপনি হাসতে থাকুন, ঋষভ। কুলদিপের, অ্যান্ডারসনের, আপনার, আমার, আমাদের জটিল জীবনে একটু হাসির প্রয়োজন আছে।