• অন্যান্য খবর
  • " />

     

    সেরেনা উইলিয়ামস: একজন মায়ের বর্ণবাদ ও দুরারোগ্য ব্যাধি জয় করার গল্প

    সেরেনা উইলিয়ামস: একজন মায়ের বর্ণবাদ ও দুরারোগ্য ব্যাধি জয় করার গল্প    

    ‘শরীর, শরীর, তোমাদের মন নাই?’

     

    সেরেনা উইলিয়ামস সুযোগ হয়তো পুতুল নাচের ইতিকথার শশী ডাক্তারের মতো এই প্রশ্নটাই করতেন সবাইকে, বিশেষ করে নিজের দেশের মানুষকে। গায়ের রঙ তো আছেই, তার শরীর নিয়েও যত কথা হয়েছে সেটা শুধু টেনিস বাদে অন্য কোনো খেলার কোনো নারী খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই বোধ হয়নি। সেরেনা দেখতে পুরুষালি, তার মধ্যে কোনো নারীসুলভ কমনীয়তা নেই- এসব শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন সারাজীবন। সেরেনা ঠিক ‘বিপণণযোগ্য’ ছিলেন না কখনো, শারাপোভা বা অন্য খেলোয়াড়দের মতো তাকে বিজ্ঞাপনের মডেল বানাতে স্পন্সরদের হিড়িক পড়েনি। শারাপোভা সেই কবে একটা গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছেন, এখন তো ডোপ পাপে নিষিদ্ধ হয়ে খেলার বাইরেই। অথচ অর্জনে তাকে বহুগুণ ছাড়িয়ে গিয়েও গত বছর পর্যন্ত বিজ্ঞাপন থেকে সেরেনার আয় ছিল কম। তার গড়ন নিয়ে প্রকাশ্যেই শোভন মন্তব্য করেছেন রাশিয়ান টেনিস ফেডারেশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট শামিল টারপাশেভ, একবার দুই উইলিয়ামস বোনকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ওরা তো আসলে দুই ভাই। পরে অবশ্য সেটার জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে। সেরেনা এসব কখনো সহ্য করেছেন, কখনো মুখ বুজে থেকেছেন। আবার কখনো ফেটে পড়েছেন ক্ষোভে।

     

    এখন সবকিছু জয় করলেও সেরেনা বলেছেন, ছোটবেলা থেকে ব্যাপারটা এরকম ছিল না। বোন ভেনাস ছিলেন তার তুলনায় লম্বা, সত্যি বলতে ক্যাপ্রিয়াতি, ডেভেনপোর্টরা সবাই সেরেনার চেয়ে লম্বা ছিলেন। কিন্তু সেই তুলনায় তার মোটা মোটা হাত পা নিয়ে ভাবতেন, মানুষ আমাকে নিয়ে কী ভাববে? সেই ভাবনা থেকে সেরেনাকে প্রথম মুক্তির দরজা দেখালেন সৎ বোন ইয়েতুন্ডে। তিনিই প্রথম বললেন, ‘দেখ নিজেকে কখনো ছোট ভেব না। তুমি ভেনাসের মতো নও, তুমি কখনো চাইলে ওর মতো লম্বা হতে পারবে না। আবার তুমি ভেনাসের চেয়ে আলাদ, ভেনাসও কখনো চাইলে তোমার মতো হতে পারবে না।’ এই কথাই শক্তি যুগিয়েছল সেরেনাকে, ছোটবেলার এই হীনমন্যতা বড় হয়ে জয় করেছেন সহজেই। সেরেনা যেমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার শরীর নিয়ে কত রকমের কথাই তো শুনতে হয়েছে। ভালো কথা, খারাপ কথা- সবই। মানুষ তো নিজের মত দিতেই পারে, তবে আমি কী ভাবছি সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি আমাকে পছন্দ করেন আর নাই করেন, আমার পোশাক বা শরীর আপনি যে দৃষ্টিতেই দেখেন না কেন- আমি সেটা থেকেই আত্মবিশ্বাস খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। যেসব মেয়েরা মাত্র টেনিস খেলা শুরু করেছে তাদেরকে আমি এটাই বলার চেষ্টা করি- তোমার নিজেকে ভালোবাসতে হবে। তুমি নিজেকে ভালো না বাসলে কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। আর নিজেকে ভালো বাসলে একটা সময় সেটা মানুষের চোখে পড়বেই, এবং তারাও তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করবে।’

     

    **

    সৎ বোন ইয়াতুন্ডের কথা সেরেনা সুযোগ পেলেই বলেন। তার জীবনের সবচেয়ে গভীর ক্ষতগুলোর একটি যে হয়ে আছেন ইয়াতুন্ডে! পাঁচ বোনের মধ্যে ইয়াতুন্ডে ছিলেন সবচেয়ে বড় ছিলেন, সেরেনা-ভেনাসকে ভালোবাসতেন নিজের ছোট বোনের মতোই। বড় হয়েছেন একটা সময় পর্যন্ত একসঙ্গে, এরপর সেরেনা-ভেনাস টেনিসের জন্য পাড়ি দিয়েছেন অন্য রাজ্যে। তবে ঘনিষ্ঠতা কমেনি, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে দুই বোনের ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেছেন। তখন ২০০৩ সাল। টেনিসে শুরু হয়ে গেছে উইলিয়ামস বোনদের যুগ, ইয়াতুন্ডে থেকে গিয়েছিলেন নিজের বেড়ে ওঠার শহর কম্পটনে। সেখানে একটা হেয়ার সেলুন চালাতেন। একদিন পার্কিং লটে নিজের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে তর্ক করছিলেন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে। হঠাৎ দূরের রাস্তায় শুরু হয়ে গেল গোলাগুলি। ইয়াতুন্ডে পড়ে গেলেন দুই গ্যাঙের বন্ধুকযুদ্ধের মাঝে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা বুলেট এসে লাগে মাথায়, হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তার। সেরেনা অনেক বছর সেই ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেননি। ২০০৯ সালে বললেন, বোনের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন। বিষণ্ণতা জেঁকে ধরেছিল তাঁকে, বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে অবসাদ থেকে মুক্ত হতে। ইয়াতুন্ডে ছি্লেন সেরেনার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। বোনের নামে ২০১৬ সালে একটা ফাউন্ডেশনও খুলেছিলেন। গত বছর এসে খবর পান, ইয়াতুন্ডের খুনী প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন। খবরটা শোনার মিনিট দশেক পর সিলিকন ভ্যালি ওপেনে ইয়োহানা কন্তার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। সেই ম্যাচে হেরে যান ৬-০, ৬-১ ব্যবধানে। সেরেনার মন যে সেদিন খেলায় ছিল না, সেটি বলে না দিলেও চলে।

     

    **

    স্বজন হারানোর ক্ষত তো আছেই, সেরেনাকে জয় করতে হয়েছে আরও একটা বড় যুদ্ধ, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়েছে যন্ত্রণাকাতর একটা সময়। পেশাদার হিসেবে চোট তো সব টেনিস খেলোয়ারেরই অনুষঙ্গ, সেরেনা অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নন। তবে ২০১১ সালে এসে চোটের চেয়েও অনেক অনেক বড় একটা ধাক্কা খেতে হলো তাকে। তার আগে বছর থেকেই শুরু দুর্ভাগ্যের, সেবার মিউনিখে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুতে যাওয়ার সময় কাচের দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে পা কেটে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল,  পায়ে দিতে হয়েছিল অনেক সেলাই। পরে জানা গেল, পায়ের লিগামেন্টই কেটে গেছে। সেরে উঠতে প্রায় আট মাসের মতো সময় লেগে গেল। এরপরেই ঘটল সেই ঘটনা।

     ২০১১ সালের মার্চে অস্কারের জাঁকালো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সেরেনা। আলো ঝলমলে পরিবেশ, চারপাশে সব পরিচিত মুখ। এসব অনুষ্ঠানে যা হয়, আড্ডা আর গল্প চলতে লাগল। সেরেনার এর মধ্যেই একটু খারাপ লাগা শুরু হলো, ঠিক যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। শুরুতে খুব একটা পাত্তা দেননি, ভেবেছিলেন হয়তো গ্যাস বা এমন কিছুর সমস্যা। আরেকটু সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খারাপ লাগাটা কমছিল না, একটা সময় সেরেনার মনে হচ্ছিল দম আটকে মরেই যাবেন। ফিজিওথেরাপিস্ট ছিলেন সঙ্গেই, তিনি সরাসরি সেরেনাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল,  সেরেনার ‘পালমোনারি এমবোলিজম’ নামে ফুসফুসের একটা রোগ হয়েছে। যেটির মানে ফুসফুস থেকে দেশের অন্যান্য কোনো অংশে রক্ত যাওয়ার যে ধমনী আছে, সেটি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধেছে সেই জায়গায়। আরেকটু দেরি করলে এমনকি প্রাণসংশয়ও হতে পারত তার। সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্ত্রোপচার করা হল। জানা গেল, সমস্যাটা মোটেই ছোট কিছু নয়, বরং বেশ খানিকটা গুরুতর। আরও একটি অস্ত্রোপচার করা হলো, হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটতে লাগল একেকটি অসহ্য প্রহর। তবে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা উন্নতি হলো পরিস্থিতির। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে সেরেনা পরে আবেগপ্রবণই হয়ে গিয়েছিলেন, ‘জীবনের অনেক কঠিন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, বোনের মৃত্যুর ধাক্কা পেতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু এই ঘটনার পর আমার পুরো জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে। আমি শিক্ষা পেয়েছি- কোনো কিছুই পেয়ে গেছি বলে ধরে নেওয়া যাবে না। প্রতিটা দিন নতুন করে শুরু করতে হবে। এরপর আমি আসলে উইম্বলডনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম না। আমি আসলে প্রস্তুত হচ্ছিলাম জীবনের জন্য।’ শুনলে অবিশ্বাস্যই মনে হবে, মনের জোরে হোক আর অন্য কিছুর জন্যই হোক- অস্ত্রোপচারের মাসখানেকের মধ্যেই কোর্টে ফিরেছিলেন সেরেনা। র‍্যাঙ্কিংয়ে নামতে নামতে ১৬৯ নম্বরে চলে গিয়েছিলেন, উইম্বলডনে বাদ পড়ে গিয়েছিলেন চতুর্থ রাউন্ড থেকে। তবে সেরেনা যে অন্য ধাতুতে গড়া, এরপর সেটা দেখিয়েছেন সেই বছরেরই ইউএস ওপেনের ফাইনালে উঠে। যে অসুস্থতা অন্য অনেকের ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারত, সেরেনা সেটি জয় করে পরের বছরেই জিতেছেন দুইটি গ্র্যান্ড স্লাম। যুদ্ধক্ষেত্র বা দ্বীপান্তর থেকে টম হ্যাংকস উদ্ধার নাও পেতে পারেন, ঢাকার ব্যস্ত দুপুরে কদিন হয়তো ট্রাফিকজ্যাম নাও থাকতে পারে- তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে সেরেনা যে ঘুরে দাঁড়াবেন, সেটি নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাজি ধরে ফেলা যায়।

     

    **

    তবে এই অসুস্থতা থেকে জয় করার চেয়েও বড় আরেকটা পরীক্ষা সেরেনাকে দিতে হয়েছে আরও বেশ কয়েক বছর পর। তখন মার্চ ২০১৭। রেডিটের কোফাউন্ডার অ্যালেক্স ওয়াহিয়ানের সাথে সেরেনার প্রেমটা তখন আর গুঞ্জন নেই, দুজন প্রকাশ্যে ঘোরাফেরাও শুরু করে দিয়েছেন বাগদানও হয়ে গেছে আগের ডিসেম্বরে। খুব শিগগির দুজন গাঁটছড়া বাঁধতে পারেন, শোনা যাচ্ছিল এমনও। ওই সময়েই স্ন্যাপচ্যাটে একটা ছবি পোস্ট হয় সেরেনার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেলফির সঙ্গে ক্যাপশনে লেখা, ২০ সপ্তাহ। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় ফিসফাস, তাহলে কি সেরেনা মা হতে চলেছেন? একটু মুটিয়ে যাওয়া শরীর দিচ্ছিল সেই সাক্ষ্য। সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন উঠল, যদি সেরেনা ২০ মাসেরই অন্তঃসত্ত্বা হন, তাহলে তো অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সময়ও আট সপ্তাহের অন্তঃসত্বা ছিলেন। ওই অবস্থায় কোর্টে নেমেছেন, বোন ভেনাস উইলিয়ামসকে হারিয়ে জিতেছেন গ্র্যান্ড স্লামও। অতি-মানবী-য়  সেরেনা অবশ্য মা হওয়ার গুঞ্জনে একদম মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেল, সেরেনা আসলেই মা হতে চলেছেন।

    কিন্তু সমস্যার মাত্র শুরু তখন। প্রসবের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, তত সেরেনা খারাপ বোধ করছিলেন। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে বললেন, সিজারিয়ানই করাতে হবে। ঝুঁকি নেওয়া যাবে না কোনোভাবেই। সেরেনা বেশ ভেঙে পড়েছিলেন সেই খবরে। বাংলাদেশে মোটামুটি সাধারণ হলেও যুক্তরাষ্ট্রে স্বাভাবিক প্রসূতির সংখ্যাই বেশি। জরুরি প্রয়োজন না হলে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারও করতে চান না। সেরেনাও চেয়েছিলেন, আর সবার মতো তার সন্তানও ভূমিষ্ঠ হোক স্বাভাবিকভাবে। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার হলো, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভালোয় ভালোয় ঘর আলো করে এলো ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান।

    কিন্তু সমস্যা তখনও কাটেনি। অস্ত্রোপচারের পর পুরনো ফুসফুসের রোগ নতুন করে দেখা দিল সেরেনার। ছয় সপ্তাহ আরও থাকতে হলো হাসপাতালের বেডে, আক্রান্ত হলেন প্রসবোত্তর মানসিক অবসাদে। টেনিস ছেড়ে দেবেন কি না, সেরকম একটা গুঞ্জনও শোনা গেল। বয়স তো তার ৩৬ পেরিয়ে গেছে, খেলা ছেড়ে দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সেরেনা তো অন্য ধাতুতে গড়া। গত বছরের ফ্রেঞ্চ ওপেনে আবার ফিরলেন গ্র্যান্ড স্লামে, বাদ পড়লেন চতুর্থ রাউন্ড থেকে। এরপর উইম্বলডনের ফাইনালে উঠলেন, প্রমাণ করলেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। আর ইউএস ওপেনের ফাইনালে উঠে জানান দিলেন, টেনিসকে তখনও কিছু দেওয়ার আর টেনিস থেকে কিছু পাওয়ার আছে তার।

     

    ***

     

    ২৩টি গ্র্যান্ড স্লাম দিয়ে ঠিক তাকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। মেয়েদের টেনিসের অবিসংবাদিত রাণী তিনি- সেটাও আসলে সেরেনার একমাত্র পরিচয় নয়। বর্ণবাদ আর লিঙ্গবৈষম্যের যে প্রাচীর সেরেনা ভেঙেছেন, সেটা ট্রফির চেয়েও সম্ভবত বড়। তার চেয়েও বড় কথা, নিজেকে প্রকাশ করতে কখনো কুন্ঠাবোধ করেননি । জয়ে বাঁধনহারা উদযাপন করেছেন, কখনো কখনো তা ছাপিয়ে গেছে মাত্রা। পরাজয়ে ভেঙে পড়েছেন, কখনো মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। হতাশায় নুইয়ে পড়েছেন, ক্ষোভে চিৎকার করেছেন। আবার হেরে গেলে প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ধরেছেন বুকে। কালো দাগও তো কম লাগেনি ক্যারিয়ারে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাইন আম্পায়ারের সাথে তর্ক করেছেন, বলেছেন অভব্য, অপ্রকাশযোগ্য কথাও। সেটার জন্য ২০১০ ইউএস ওপেন থেকে আরেকটুর জন্য নিষিদ্ধ হতে বসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে গেছেন। ২০১১ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও আম্পায়ারের সাথে কথা কাটাকাটির জেরে হাত মেলাননি তার সঙ্গে। গত বছর ইউএস ওপেনেও আবার জড়িয়ে গেছেন বিতর্কের সঙ্গে। নাওমি ওসাকার সঙ্গে ম্যাচের সময় অভিযোগ উঠেছিল, কোচ দর্শকসারি থেকে তাকে ইশারা ইঙ্গিতে কৌশল বাতলে দিচ্ছেন। সেরেনা মেজাজ হারিয়ে র‍্যাকেট আছড়ে ছুঁড়ে ফেলেছেন, তৃতীয়বার আম্পায়ারের সাথে অশোভন আচরণের জন্য একটি গেম পেনাল্টিও দিতে হয়েছেন। পরে সেরেনা অভিযোগ করেছিলেন, মেয়ে বলেই তার সাথে অমন আচরণ করা হয়েছে।

     

    সেই অভিযোগের সত্যি-মিথ্যা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। তবে এটা নিয়ে সন্দেহ নেই, সেরেনা সবসময়ই অকপট ছিলেন ও আছেন। ভান ভনিতা ছাড়া সব সময় নিজের কথা বলেছেন, কারও কথার ধার ধারেননি। নিজের শেকড় নিয়ে সচেতন হয়েছেন, একটা সময়ে বার বার ছুটে গেছেন আফ্রিকায়। একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা-মা আমাকে সব সময় বলতেন, ইতিহাস না জানলে তুমি ভালো মানুষ হতে পারবে না। নিজের অতীতটা তোমাকে জানতে হবে। তুমি কোথা থেকে উঠে এসেছে সেটা তোমাকে বুঝতে হবে। আমেরিকায় কালো হয়ে জন্ম নিলে সেটা আপনি সবসময় নাও জানতে পারেন। আপনি হয়তো আপনার শেষ নামটা নাও জানতে পারেন। আরও অনেক কিছু অজানা থাকতে পারে আপনার। আমার জন্য আফ্রিকায় ফেরাটা ছিল তাই অনেক জরুরি। একজন আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে সেটা ছিল আমার কাছে একটা স্বপ্নপূরণের মতো। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি কোত্থেকে এসেছি। আমি বুঝতে চেয়েছি, আমার পূর্বপুরুষেরা কতটা কষ্ট করেছে। দাসদের যেসব দুর্গে আটকে রাখা হতো, সেটা আমি দেখেছি। আমি জানার চেষ্টা করেছি, তাদের যাত্রাটা কেমন ছিল। আর আমি মনে করি, মানুষ হিসেবে এরপর থেকে একটা পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে। আমি বুঝতে পেরেছি, হাল ছেড়ে না দেওয়ার এই যে প্রতিজ্ঞা এটা আসলে আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই সহ্যশক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হতো তাদের। আমি মনে করি, এই অভিজ্ঞতা মানসিকভাবে আমাকে শক্ত হতে অনেক সাহায্য করেছে। ’

     

    অসংকোচ প্রকাশে সেরেনার সাহস তাই তাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে। নিজে ফ্যাশন সচেতন, পোশাক থেকে চুল- সবকিছু নিয়েই প্রচুর পরীক্ষা করেছেন। নাচতে ভালোবাসেন, মজা করতে ভালোবাসেন। আবার রেগেও যান, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। ক্ষমা, উদারতার মতো গুণ যেমন আছে, তেমনি রাগ, ক্ষোভের মতো মানবীয় দিকও আড়াল করার কোনো চেষ্টা করেননি কখনো। রাগ নিয়ে যেমন একবার একটু অনুতাপের সুরেই বলেছিলেন, ‘আমি বুঝি মাঝেমধ্যে আমার রাগটা বেশিই হয়ে যায়। আমাকে যারা রোল মডেল মনে করে তাদের কাছে তাই ভালো কোনো বার্তা যায় না। তবে একই সঙ্গে এটাও ঠিক, রাগ থেকে বোঝা যায় খেলার প্রতি আমার নিবেদন কতটুকু। রাগ ঠিক বলব না, এই জেদটা আমার মধ্যে না থাকলে এত বড় আমি কখনোই হতে পারতাম না। এটা আমাকে আরও ভালো কিছু করার জন্য তাঁতিয়ে দেয়।’

    সবকিছুর পর সেরেনা তাই আমাদের মতোই রক্তেমাংসে, দোষেগুণে মিলিয়ে মানুষ। বোন ভেনাস তো বটেই, অন্য অনেক সহ খেলোয়াড়ের সঙ্গেও সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি। ক্যারোলিন ওজনিয়াকি একবার বলেছিলেন, গলফার ররি ম্যাকইলরয়ের সঙ্গে তার বাগদান ভেঙে যাওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। কারও ফোন ধরছিলেন না, বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। ওই সময় সেরেনা সরাসরি তার কাছে এসে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করেছেন। কথা বলেছন, গল্প করেছেন, ওজনিয়াকিকে বার বার বলেছেন ভেঙে গেলে চলবে না। মেয়েদের টেনিসে বন্ধুতা হয় না, এরকম একটা কথা ছিল। সেরেনা তা ভুল প্রমাণ করেছেন। সম্ভবত জীবনে এত কিছু সয়েছেন বলেই অনেক ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে যেতে পেরেছেন।  নিজের ক্যারিয়ারের এতো সংগ্রাম, অনায়াসেই তাকে ওয়ান্ডার ওম্যান বলে ফেলা যায়। কিন্তু সেরেনা নিজেকে আলাদা নয়, আর দশজনের মানুষের মতোই মনে করেন। নিজেকে নিয়ে বাড়তি কোনো ভাবাবেগও নেই তার,  ‘আমার মনে হয় আমার গল্পটা বৈশ্বিক। আমার মনে হয় না এটা কোনো দেশ, রং বা গোত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার মনে হয় না এটার গন্ডি শুধু আমার লিঙ্গের মধ্যে আবদ্ধ। এটা বৈশ্বিক কারণ আমি আর সবার মতো সাধারণভাবেই জন্মেছি। আমার বাড়তি কোনো হাত ছিল না, আমি অনেক বেশি লম্বাও ছিলাম না। আমি পরিশ্রম, নিবেদন আর প্রতিজ্ঞার জোরেই এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমি জানতাম অনেক মানুষ আমার ওপর আস্থা রাখে না, সেজন্য নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসটাও বাড়াতে হয়েছে আমার। দিন শেষে এটা এমন একটা গল্প যেটা সবাই নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারে।’

     

    আকাশের তারা হয়েও সেরেনা তাই দিন শেষে মাটির কাছাকাছিই।

    (সেরেনা উইলিয়ামসকে নিয়ে এই লেখাটি প্যাভিলিয়ন সম্পাদক অম্লান মোসতাকিম হোসেনের বই 'নায়কদের নেপথ্যের' অংশবিশেষ। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার ২৮৬ চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনে। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া যাবে এখানে  বা এখানে)