বাংলাদেশের ব্যাটিং দুর্দশাঃ টেকনিকের ভুল না সমস্যা মানসিকতায়?
ক্রিকেটে ভুলকে চাইলে দুটি ধরনে ফেলা যায়। এক ধরনের ভুল যা অভিজ্ঞরা করেন, আরেক ধরনের যা অনভিজ্ঞরা করেন।
তামিম ইকবাল সেন্ট লুসিয়া টেস্টে কেমার রোচের বেশ বাইরের বল যেভাবে তাড়া করে আউট হলেন, সেটি অনভিজ্ঞ কেউও করতে পারতেন। করতে পারতেন কি, নাজমুল হোসেন শান্ত ওই ইনিংসেই তা করে দেখিয়েছেন। তামিম ইকবাল অভিজ্ঞ হয়েও কেন তা করলেন, প্রশ্ন উঠছে সেটি। এত বাইরের বল তাড়া করে আউট হওয়ার যে অপ্রয়োজনীয়তা, সেটি সম্পর্কে জানতে হলে তো আদতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজনই নেই। তা তো যে কারোই বুঝার কথা!
কিন্ত অভিজ্ঞ একজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা হতে পারে অবশ্য। পূর্বে এমন কিছুর মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিজ্ঞ কেউ সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন সে আশা করা হয়। বল সুইং করছে, তার উপর পিচের বাউন্স অসম, রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে এসে এঙ্গেলে বল কিছুটা ভেতরে ঢুকিয়ে সুইংয়ে বের করছেন। কাভার ড্রাইভ খেলাটা তো তাই ঝুঁকির মধ্যেই পড়ে। কিন্ত তামিম সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিয়ে হলেন আউট। আসলে তামিম ইকবালের এই আউটটা কেবলই একটি উদাহরণ, টেস্টে অপ্রয়োজনীয় শটে আউট হওয়াটা তো আজকাল বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের নিত্যদিনের কাজই হয়ে গেছে।
সেকারণেই তো বাংলাদেশের ইনিংস সামান্য ঝড়-ঝাপ্টাতেও লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গেল তিন বছরে বাংলাদেশ যে ২০ ম্যাচ খেলেছে, তাতে স্কোরবোর্ডে ৫০ রান তোলবার আগেই চার উইকেট খুইয়েছে ১৩ বার। আর ৩৬ ইনিংসের ২৩টিতেই এমন হয়েছে, রানের ঘরে ১০০ উঠবার আগেই উইকেটের ঘরে বসে গেছে ৪।
এতটাই বেহাল অবস্থা বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের। ঘরের মাঠ, বাইরের মাঠ। স্পিন, পেস। সুইং, বাউন্স। সবকিছুতেই বাংলাদেশের একই হাল। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সাইমন হারমার ও কেশভ মাহরাজের স্পিনে কুপোকাত, তার আগে সাজিদ খানের স্পিনে ঘরের মাঠে। আবার ঘরের মাঠে আসিথা ফার্নান্দোর বাউন্স, কাসুন রাজিথার সুইংয়ে দিশেহারা। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে টালমাটাল রোচ-জোসেপদের পেস ও সুইংয়ে। ব্যাপারটা যেন এমন, যা অস্ত্র আছে তা নিয়েই নেমে পড়ো, বাংলাদেশ তোমাকে ব্যাটিং ধস উপহার দেবেই!
চলতি বছরে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশেরই ব্যাটিং গড় পঁচিশের নিচে নেই। ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম সাতজনের গড় বিবেচনায়ও বাংলাদেশ তলানিতে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সম্মিলিত গড় ২৭.৯৬।
কে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে কিছুই পারে না। বছরের অর্ধেকও শেষ হয়নি, সবচেয়ে বেশি ‘শূন্য’র রেকর্ড করে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। এবছরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা রানের ঘরে পা দেওয়ার আগেই ফেরত এসেছেন ৩৩ বার। বাংলাদেশ বাদে যে দুই দল সবচেয়ে বেশি ‘ডাক’ মেরেছে এই বছরে, তাদের ডাক সংখ্যা মিলিয়েও বাংলাদেশের চেয়ে কম হয়। নিউজিল্যান্ড এ পর্যন্ত মেরেছে ১৬টি ডাক, ইংল্যান্ডের ১৪টি। তবে ২০২১ সাল থেকে হিসাব করলে ইংল্যান্ডই ‘ডাক’ মারায় সবার এগিয়ে। এসময়ে ইংল্যান্ডের ২৩ ম্যাচে ‘শূন্য’ ৬৮টি। বাংলাদেশের অবশ্য ১৫ ম্যাচেই ৫৬টি! তার মানে গেল বছর দেড়েক ধরে প্রতি ম্যাচেই গড়ে বাংলাদেশের তিন থেকে চারজন ব্যাটসম্যান ‘ডাক’ মেরেছেন!
বাংলাদেশের লেজের ব্যাটসম্যানেরা ব্যাটিংয়ে ‘নিরক্ষর’ পর্যায়ে পড়েন বলে তাদের শূন্য মারা স্বাভাবিক ব্যাপারই। তবে শুধু টপ অর্ডারের দিকে তাকালেও দেখা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ‘শূন্য’ পায়নি আর কোনও দল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের ৯টি ও ৭টি করে ডাক মিলিয়ে হয় ১৬টি, সেখানে বাংলাদেশের একাই ১৭টি ডাক!
আচ্ছা, কেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের এই দুর্দশা? অনেক কারণ খুঁজে বের করলেও যদি বলি, ধৈর্যের অভাব। তাহলে আপনি দ্বিমত করবেন না নিশ্চয়ই। যে খেলাটাই ধৈর্যের, সেখানে এই মৌলিক বিষয়টারই যথেষ্ট অভাব বাঙালীদের। যেসব বলের ধারেকাছেও ব্যাট নেওয়ার দরকার নেই, সেসবের সঙ্গেই বাংলাদেশি ব্যাটারদের খাতিরানা। অযথা বাইরের বল তাড়া করে আউট হওয়ার দৃশ্য তাই প্রত্যেক ইনিংসে নিয়মিত।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে স্পিনে কাবু যে হলো বাংলাদেশ, সেখানে দুটি টেস্টেরই দ্বিতীয় ইনিংসে তীক্ষ্ণ ও বড় টার্নের সাথে বাউন্সও ছিল বেশ। বাংলাদেশে লো বাউন্সের টার্ন খেলে অভ্যস্ত বলে সেটি চ্যালেঞ্জিং ছিল বটে। তবে সেখানেও ধৈর্য ধরে চাপ শুষে নিয়ে খেলা যেত। যা করেনি বলেই দুই ইনিংসে ৫৩ ও ৮০ রানে অলআউট। অযথা শটে আউট হয়েছেন অনেকেই। প্রথমেই আসবে অভিজ্ঞ মুশফিক রহিমের লাঞ্চ যখন সন্নিকটে, তখন রিভার্স সুইপ খেলে বোল্ড হওয়ার কথা। এরপরেই মনে পড়ে বড় বড় টার্ন হওয়া সত্ত্বেও লিটন দাসের ডাউন দ্যা উইকেটে এসে খেলার ঝুঁকি নিয়ে স্টাম্পিং হওয়া।
এসবের সাথে তো আসলে টেকনিকের কোন সংযোগ নেই। ব্যাটিং ব্যর্থতায় টেকনিকে সমস্যার কারণ দেখালে না মেনে উপায় নেই। তবে সেই সাথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, ধৈর্য ধরে কঠিন সময়টা কাটিয়ে না দেওয়ারও তো দায় কম নয়!
কন্ডিশন যখন চ্যালেঞ্জিং, হয় ভালো টার্ন করছে, কিংবা ভালো সুইং-সিম পাচ্ছেন বোলাররা। এই অবস্থায়ই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত হন। সুইং দেখে নড়বড়ে হয়ে যান, আত্মবিশ্বাসের লেভেলও কমতে থাকে। তাই ভুল করে বসেন, সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকুও দিতে পারেন না সেজন্য।
অ্যান্টিগা টেস্টেই দেখুন৷ তামিম ইকবাল আউট হলেন কি ধরনের বলে, লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে যাওয়া ফুললেংথের এক বলে কিপারে ক্যাচ দিয়ে। মিরাজও আউট হলেন একইভাবে। এমন বলে আউট হওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে। অ্যান্টিগায় প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসাররা বেশ সুইং পাচ্ছিলেন। তা দেখে ব্যাটারদের আত্মবিশ্বাস হয়তো নড়বড়ে হয়েছিল, যে কারণে নিরীহ বলেও আউট। আবার দীর্ঘক্ষণ ধরে ভালো বল দেখতে থাকা ব্যাটার যখন খারাপ বল দেখে, তখন অতিউৎসাহী হয়ে গড়বড় করে ফেলে হয়তো। আর বোলারদেরও তো এই ফাঁদ পেতে রাখতে সচরাচরই দেখা যায়।
কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আরেকটা সমস্যা খুঁজে পেয়েছিলেন, ফিফটিকে বড় ইনিংসে রুপান্তর করতে না পারা। বাংলাদেশ চলতি বছরে ১৯টি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস পেয়েছে (আউট হওয়া), তার মধ্যে মাত্র পাঁচটিই সেঞ্চুরিতে রুপ পেয়েছে। অর্থাৎ কনভার্সন রেট প্রায় ২৬%, যা চলতি বছরে কমপক্ষে পাঁচ ম্যাচ খেলা দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। তবে এ সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা, বেশিরভাগ ইনিংসই ওই ফিফটি পর্যন্ত যাওয়ার আগেই খতম হয়ে যাওয়াটা।
ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে টেস্ট অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, বাংলাদেশি ব্যাটারদের সবারই টেকনিকে সমস্যা রয়েছে। রাসেল ডমিঙ্গো অবশ্য মানসিকতায় সমস্যা দেখেন। টেস্ট ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে ভালো টেকনিকের প্রয়োজন অবশ্যই। তবে কঠিন এ দুনিয়ায় টেকনিকে ফাঁকফোকর রেখেই বেঁচে থাকাদেরও কি পাওয়া যায় না!
তবু টেকনিকের সমস্যা কমিয়ে আনা জরুরি। তবে তার চেয়েও বড় জরুরি বোধহয়, টেস্ট মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। যে সমস্যার কারণেই তো বারবার দেখতে হয় ওই দুধরনেরই ভুল!