বার্সেলোনার স্বপ্নভঙ্গ: চার গোল আর তিন লাল কার্ডের পাগলামির গল্প
পাগলামিই বটে!
আগের লেগে প্রতিপক্ষের মাঠ থেকে জয় নিয়ে আসা দলটা নিজের মাঠে লিড দ্বিগুণ করে ফেললো ম্যাচের দ্বাদশ মিনিটেই। সেই দলের একজন খেলোয়াড়ই লাল কার্ড দেখলেন ঊনত্রিশতম মিনিটে, তখনো দুই গোলের লিড রাখা দলটা এরপরই ভেঙে পড়লো। পরের ত্রিশ মিনিটের মধ্যে লিড তো হারালোই, দলটা পিছিয়ে গেল এক গোলের ব্যবধানে। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে এলো কফিনের শেষ পেরেকটা। দুই লেগ মিলিয়ে একটা সময়ে ৪-২ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা দলটা শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হেরেই গেলো ৪-৬ ব্যবধানে। পাগলামি নয়তো কী!
দুই লেগ মিলিয়ে তিন গোল করেও ভেজা চোখে বাড়ি ফিরতে হলো রাফিনহাকে; Image Source: Getty Images
তবে গত এক দশকে এমন পাগলামি বার্সেলোনা সমর্থকেরা কম দেখেননি। রোমার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৪-১ ব্যবধানে জিতে অ্যাওয়েতে ৩-০ ব্যবধানে হেরে অ্যাওয়ে গোলের হিসাবে বাদ পড়া, লিভারপুলের বিপক্ষে ন্যু ক্যাম্পে ৩-০ ব্যবধানে জিতে অ্যানফিল্ডে ৪-০ ব্যবধানে পরাজয়, লিসবনে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৮-২ এর লজ্জা, পিএসজির বিপক্ষে হোমে ৪-১ ব্যবধানে পরাজয়, ইউরোপা লিগে পরপর দুবার অধঃপতন; টাইব্রেকার বাদে সম্ভাব্য সব উপায়েই চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পড়েছে বার্সেলোনা। অনেক বছর পর, এবারই বার্সা সমর্থকেরা নতুন আশা দেখছিলেন। দুই মৌসুমের ব্যর্থতার পর গ্রুপ পর্ব পেরোনো, শেষ ষোলোয় নাপোলির বিপক্ষে দারুণ জয়, পার্ক দো প্রিন্সেসে পিএসজিকে ৩-২ ব্যবধানে হারানো, বার্সা সমর্থকদের স্বপ্নের পরিধিটা বড় হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ করেই। কিন্তু গত এক দশকের অভিজ্ঞতা যেটা বলে, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনায় সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলবে, এমনটা আশা করা বোকামি, সেটা মাঠের বাইরে লিওনেল মেসির বার্সা ত্যাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি ট্রান্সফার উইন্ডোতে অনুষ্ঠিত ‘নাটক’ বা ইকোনোমিক লেভারের গ্যাঁড়াকল হোক, বা মাঠের ভেতরের ‘অদ্ভুতুড়ে’ সব পারফরম্যান্স হোক। তবে ইতিহাসের শিক্ষা যেহেতু এই, যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, বার্সা সমর্থকেরা আবারও আশায় বুক বাঁধলেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো আবারও, সমর্থকদের বুক ভেঙে বার্সেলোনা বাদ পড়লো চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। দ্যা অ্যাথলেটিকে উঠে এসেছে এই ম্যাচের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ।
২৯ মিনিট: একটি অপ্রয়োজনীয় লাল কার্ড
মাঝমাঠ থেকে ডিফেন্ডার রোনাল্ড আরাউহোকে পাস দিয়েছিলেন মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং। আরাউহোর সামনে তখন পাস দেওয়ার অনেকগুলো বিকল্প। ডানে জুলস ক্যুন্দে, একটু সামনে মিডফিল্ডার ইকায় গুন্দোয়ান, ফরোয়ার্ড রবার্ট লেওয়ানডস্কি বা রাইট উইঙ্গার লামিন ইয়ামাল, যে কেউই রিসিভ করতে পারতেন পাসটা।
Image Source: TNT Sports
আরাউহো পাসটা দিতে চেয়েছিলেন গুন্দোয়ানকে। কিন্তু তাঁর পাসটা পরিণত হয় ভুল পাসে, পিএসজির লেফটব্যাক নুনো মেন্দেসের পায়ে চলে যায় বলটি। ওয়ান-টাচ পাসে লেফট উইঙ্গার বার্কোলার উদ্দেশ্যে বল বাড়িয়ে দেন মেন্দেস। বার্কোলা ছুটতে শুরু করেন বার্সার পোস্টের দিকে।
Image Source: TNT Sports
তখনই ভুলটা করে বসেন আরাউহো। নিজেদের পোস্টের দিকে না গিয়ে তিনি ছুটে যান বার্কোলার দিকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ইংল্যান্ডের সাবেক সেন্টারব্যাক রিও ফার্দিনান্দ যে ঘটনাকে বলছেন, “নিজেদের শারীরিক সক্ষমতার ওপর আরাউহোর অতি-আত্মবিশ্বাস”। ফার্দিনান্দের বক্তব্য অনুসারে, আরাউহো এই অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে বার্কোলার দিকে ছুটে না গিয়ে বরং নিজেদের পোস্টের সামনে অবস্থান নিলে বার্কোলার জন্য পরবর্তী কাজ হলো আরাউহোকে ওয়ান-ভার্সেস-ওয়ানে মোকাবেলা করা। এই ব্যাপারটাতে আরাউহো যেমন বেশ ভালো, একই সাথে, আরাউহোকে পেরোলেও টের স্টেগানের বাধা ছিল সামনেই। কিন্তু প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে নামা আরাউহো হয়তো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, আর দ্রুত বল পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভুল করে বসলেন।
Image Source: TNT Sports
বার্কোলার প্রথম স্পর্শটা ছিল একদম নিখুঁত। প্রথম স্পর্শেই বলটা আরাউহো থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ওদিকে আরাউহো তখনো বেশ খানিকটা পেছনে।
Image Source: TNT Sports
বার্কোলা আরেকটু সামনে এগোলেন, গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগান ছাড়া তাঁর সামনে আর কেউ নেই তখন। এই সময়েই আরাউহো পেছন থেকে ধাক্কা দেন বার্কোলাকে। রোমানীয় রেফারি ইস্তভান কোভাক্সের সামনে লাল কার্ড দেখানোর কোন বিকল্প ছিল না।
রেফারির সাথে তর্ক করেও লাল কার্ডের সিদ্ধান্ত বদল করাতে পারেননি আরাউহো; Image Source: Getty Images
বার্সা হারিয়ে ফেলে তাদের রক্ষণের নেতাকে, সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য সেন্টারব্যাককে। প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের ফরোয়ার্ডরা স্বাভাবিকভাবেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন এরপরে। কোচ জাভি তরুণ উইঙ্গার লামিনকে তুলে নামান আরেক সেন্টারব্যাক ইনিগো মার্টিনেজকে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। আরাউহোর লাল কার্ডের এগারো মিনিট পরেই ম্যাচে সমতা ফেরান ওসমান ডেম্বেলে।
৫৪ মিনিট: সেট পিসে বিপর্যয়
দশজনের দলে পরিণত হলেও ম্যাচে ১-১ সমতা আর দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ এর লিড নিয়েই বিরতিতে গিয়েছিল বার্সেলোনা। দলকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি নতুনভাবে কৌশল সাজাবেন জাভি, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু বিরতির পরও দেখা গেল বার্সার হতশ্রী রূপটাই। বিশেষ করে সেট পিস সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো কাতালান ক্লাবটি। পিএসজির দ্বিতীয় গোলটা এলো এভাবেই, একটা কুইক কর্নার থেকে।
Image Source: TNT Sports
কর্নারটা নিয়েছিলেন ওসমান ডেম্বেলে। ফাবিয়ান রুইজ তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, একই সাথে টেনে নিয়েছিলেন বার্সার ডিফেন্ডারদেরও। ছোট্ট কর্নারের প্রত্যাশা করেছিলেন ডিফেন্ডাররা, কিন্তু ডেম্বেলের কর্নারটা অতটাও ছোট ছিল না। ডেম্বেলের পাসটা খুঁজে নিয়েছিল বক্সের ডান কোণায় দাঁড়ানো আশরাফ হাকিমিকে। গুন্দোয়ান ছুটে এসেছিলেন হাকিমিকে মার্ক করার জন্য। এসেছিলেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংও। কিন্তু হাকিমি পাস দিয়ে দিলেন বাঁয়ে, ভিতিনহাকে।
Image Source: TNT Sports
ভিতিনহার সামনে তখন অনেক জায়গা। রবার্ট লেওয়ানডস্কির পক্ষে ওই জায়গা কাভার করা অসম্ভব, পাশ থেকে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংও এসে পৌঁছাতে পারলেন না সময়মতো। ফলাফল, ভিতিনহার জোরালো শটটা জড়িয়ে গেল বার্সার পোস্টের ডানদিকের নিচের কোণার জালে। মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগানের ডাইভটা বিফলে গেল, দুই লেগ মিলিয়ে ম্যাচে এলো সমতা।
গোলের পর ভিতিনহার উদ্বাহু উদযাপন; Image Source: Getty Images
৫৬ মিনিট: মেজাজ হারালেন জাভি
চলতি মৌসুমে বার্সার ডাগআউটে দাঁড়িয়ে মেজাজ ঠিক রাখাটা জাভির জন্য বেশ কঠিন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিলো। মৌসুমজুড়েই দেখছিলেন একের পর এক হলুদ-লাল কার্ড। এই স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচেই বা ব্যতিক্রম হবে কেন!
Image Source: TNT Sports
ওসমান ডেম্বেলের ওপর ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংয়ের করা একটা ট্যাকেলকে রেফারি যখনই ফাউল হিসেবে ঘোষণা করেন, ক্ষেপে ওঠেন জাভি। ডাগআউটে থাকা টিভি ক্যামেরাম্যানের পাশের বোর্ডে লাথি মেরে বসেন সজোরে, সাথে রেফারির উদ্দেশ্যে ‘মধুবর্ষণ’ তো ছিলই।
Image Source: TNT Sports
ফলাফল, সরাসরি লাল কার্ড। ম্যাচের তখনও প্রায় ৩৫ মিনিট বাকি, বার্সা হারিয়ে ফেললো তাদের মূল সেন্টারব্যাক ও হেড কোচকে।
৫৯ মিনিট: এবার ক্যান্সেলোর পাগলামি
জাভি লাল কার্ড দেখার তিন মিনিটের মধ্যেই পিএসজিকে পেনাল্টি উপহার দিলেন বার্সেলোনার লেফটব্যাক জোয়াও ক্যান্সেলো। ব্যাখ্যাতীত এক পেনাল্টি।
Image Source: TNT Sports
ওসমান ডেম্বেলের প্রথম টাচটা যথেষ্ট বাজে ছিল। পোস্ট থেকে দূরে সরে গিয়েছিল বলটা। এই সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে জায়গাটা কাভার করতে পারতেন ক্যান্সেলো, ডেম্বেলেকে কর্নার পতাকার দিকে সরে যেতে বাধ্য করতে পারতেন। বিপদের আশঙ্কাও তাতে দূরীভূত হতো।
Image Source: TNT Sports
কিন্তু ক্যান্সেলো বেছে নিলেন পাগলামির পথটাই। স্লাইডিং ট্যাকেল করতে বসলেন বক্সের মধ্যেই। বলটা তো জিততে পারলেনই না, উল্টো পিএসজি পেয়ে গেল পেনাল্টি।
Image Source: TNT Sports
পেনাল্টি থেকে ভুল করেননি কিলিয়ান এমবাপ্পে। গোল করে এগিয়ে দিলেন ফরাসি দলটিকে।
৬৬ মিনিট: এবং আরো একটা লাল কার্ড
আগের মৌসুমেই ম্যানচেস্টার সিটির অধিনায়ক হিসেবে ট্রেবল জিতেছেন ইকায় গুন্দোয়ান। বার্সেলোনার হয়ে খেলছেন এই মৌসুমে, কিন্তু তাঁর স্বপ্নটা তো আর কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। দলকে পিছিয়ে পড়তে দেখে তাই তিনি হয়ে উঠলেন মরিয়া, নিজেই চেষ্টা করতে থাকলেন ম্যাচে সমতা ফেরানোর। এমবাপ্পের গোলের পর গোলের কাছাকাছি চলেও এসেছিলেন তিনি। পিএসজির পেনাল্টি বক্সে ভিতিনহার সাথে মৃদু সংঘর্ষের পর ভূপাতিত হয়ে পেনাল্টির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই আবেদনে কর্ণপাত করেননি রেফারি।
Image Source: TNT Sports
জাভি তো ততক্ষণে সরে গেছেন ডাগআউট থেকে, রেফারির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে তাই এগিয়ে এলেন গোলরক্ষক কোচ হোসে রামন দে লা ফুয়েন্তে। তিনি ঠিক কী বলেছিলেন সেটা টিভি ক্যামেরায় বোঝা যায়নি, তবে আপত্তিকর কিছু যে হবে, সেটা নিশ্চিত। রেফারিও লাল কার্ড দেখিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করে দিলেন তাঁকে।
৮৯ মিনিট: কফিনের শেষ পেরেক
বার্সেলোনা কিন্তু হাল ছাড়েনি। ম্যাচে সমতা ফেরানোর চেষ্টাটা অব্যাহত রেখেছিল কাতালানরা। কিন্তু বার্সার সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে, এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রার ইতিটা টেনে দিলেন পিএসজির সবচেয়ে বড় তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে।
নিজেদের বক্সের কাছে নিজেই বলটা জিতেছিলেন এমবাপ্পে, এরপর দ্রুত পাস দেন হাকিমিকে। ডান পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকা হাকিমি খুব বেশি বাধার সম্মুখীন হননি। সমতার খোঁজে প্রায় পুরো বার্সেলোনা দলটাই তখন পিএসজির বক্সের কাছে।
Image Source: TNT Sports
হাকিমি দ্রুত পাস দিলেন এমবাপ্পেকে। কিন্তু এমবাপ্পের শটটা ঠেকিয়ে দিলেন টের স্টেগান। রিবাউন্ডে ঠেকালেন মার্কো অ্যাসেনসিওর শটও। এবার বলটা পড়লো ক্যুন্দের সামনে। কিন্তু ক্লিয়ার করতে গিয়ে ক্যুন্দে বলটা তুলে দিলেন স্বদেশী এমবাপ্পের সামনে।
Image Source: TNT Sports
এমবাপ্পে কি আর এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন!
লেওয়ানডস্কির বিষাদ, এমবাপ্পেদের উল্লাস; Image Source: Getty Images
সাথে সাথে নিশ্চিত হয়ে গেল, আরো একবার কষ্ট বুকে চেপে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে বার্সেলোনা সমর্থকদের। আরো একবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হবে। আরো একবার হতাশা আর বিষাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। চ্যাম্পিয়নস লিগ নামক সোনার হরিণকে ছুঁতে অপেক্ষার পালাটা শুরু করতে হবে আরো একবার। পিএসজি সমর্থকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একশ আশি ডিগ্রি উল্টো। ‘লা রেমনটাডা’ হয়ে গেছে, তাও বার্সার মাঠে। সামনে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড আর রিয়াল মাদ্রিদ বা বায়ার্ন মিউনিখের বাধা থাকলেও, স্বপ্নের চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে তো মাত্র দুটো ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে প্যারিসের দলটি!