• ইংল্যান্ড-পাকিস্তান
  • " />

     

    ইউনুস খান : 'শূন্যে বাঁধি ঘর'!

    ইউনুস খান : 'শূন্যে বাঁধি ঘর'!    

    হাবিব ব্যাংকের হয়ে যখন ফার্স্ট ক্লাস খেলতেন, অধিনায়ক ছিলেন আকরাম রাজা। ইউনুস খানকে নিয়ে একটা খেলা খেলতেন আকরাম। প্রত্যেক সেশনের পর গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কতো হলো রান?’ হয়তো হয়েছে ৬০। আকরাম তাঁকে বলতেন, পরের সেশনে যখন ব্যাট করতে নামবেন, যেন এটা ভেবে নামেন, রান আসলে শূন্য। তিন সেশন খেলে ১৫০ রান হলেও আকরামের টোটকাটা থাকতো একই।

     

    ‘যখন ২০ রান হয়, আমার মনে হয় মাত্র তো শুরু হলো।’ ইউনুস খান বলেছিলেন, গতবছরের এক সাক্ষাৎকারে। ‘এখন তাহলে ৫০ করতে হবে। যখন ৫০ হয়ে গেল, আমি তাহলে আবার শূন্যতে পৌঁছালাম। তারপর ৭০, আর তারপর, অবশ্যই এটা মনে হয়, ১০০ আসছে। কারণ, বল তখন পুরোনো, ফিল্ডাররা ক্লান্ত। আর যেসব বলে আপনি সুবিধা নিতে পারবেন, সেসব বলই পাচ্ছি। যদি এমন হয়, আমরা ইনিংস ঘোষণা করছি না শীঘ্রই, তাহলে ১০০ হয়ে যাওয়ার পরই পরিকল্পনা থাকে, ব্যাট করে যাওয়ার। ২০০ করার, ৩০০ করার।’

     

    বলা সহজ, করা তো নয়! ইউনুস খান তবুও করে দেখান। ইউনুসের তাই ৩০ ফিফটি, ৩২ সেঞ্চুরি। শীর্ষ দশ সেঞ্চুরিয়ানের তালিকায় ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রুপান্তরের এমন হার আর কারও নেই! ৯০ এর ঘর ছুঁয়েছেন, এমন গত ৩০টি ইনিংসেই ইউনুস সেঞ্চুরি করেছেন! নড়বড়ে নব্বইয়ে ইউনুস আউট হয়েছেন মাত্র একবার, সেই ২০০১ সালে!  

     

    ****


    লর্ডস, লন্ডন। মিসবাহ-উল-হকের পুশ-আপ। ইয়াসির শাহর ভেলকি। পাকিস্তানের জয়। পাকিস্তানের পুশ-আপ। নেতৃত্বে ইউনুস খান। ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫৮ রান ও দুইটি ক্যাচ নেয়া ইউনুসই। ইউনুস আছেন উদযাপনে, ব্যাটিংয়ের হাল ধরাতে নেই।

     

    ওল্ড ট্রাফোর্ড। ইউনুসের আবার শূন্য থেকে শুরু। ইংল্যান্ড ইয়াসিরকে পড়ে ফেলছে, ইংল্যান্ড পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণকে ভোঁতা করে দিচ্ছে। ইউনুসের  কাছ থেকে একটা বড় ইনিংস দরকার ছিল পাকিস্তানের। প্রথম ইনিংসে করলেন এক রান। বিশাল ব্যবধানে হার, চারদিনের মাঝেই। দ্বিতীয় ইনিংসে ইউনুসের রান ২৮। আবার শূন্যের দিকে যাত্রা। গন্তব্য বার্মিংহাম।

     

    এজবাস্টন। ইংল্যান্ডকে বোলিংয়ে চেপে ধরেছে পাকিস্তান। প্রথম ইনিংসে লিড ১০৩ রানের। ইউনুসের অবদান তাতে ৩১। লিড পেয়েও তা ধরে রাখা দায় হয়ে গেল, ১-০ তে এগিয়ে থাকা পাকিস্তান এজবাস্টনে হেরে পিছিয়ে গেল ১-২ এ। ইউনুস আবার লন্ডনে ফিরলেন, শূন্য থেকে শুরু করবেন বলে।

     

    ওভাল। সারের হয়ে যখন খেলতেন, ইউনুসের ঘরের মাঠ ছিল এটা। এবার ইংল্যান্ডকে চেপে ধরলো পাকিস্তান, ওয়াহাব রিয়াজ আর সোহেল খানের পেসে। চাপটা আলগা হয়ে গেল, মঈন আলি আর জনি বেইরস্টোর জুটিতে। ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করলেন মঈন, ইউনুস নিশ্চয়ই অভিনন্দনই জানিয়েছেন।

     

    নিজের চার নম্বর জায়গাটাও ছেড়ে দিলেন আসাদ শফিককে। এলেন পাঁচে। ইউনুস শুরু করলেন আবার, শূন্য থেকে।

     

    সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পালা তাঁর!


    ****

     

    ২৩.৫ গড়, সর্বোচ্চ ৩৩। ছয় ইনিংসে ইউনুসের রানের খাতা। ইউনুস খান, ৩৮ বছর হয়ে গেছে বয়স। একটা করে ইনিংসে ব্যর্থ হন, ইউনুসের শেষটা যেন উঁকি মারে। পাকিস্তানের মতো দেশ থেকে উঠে আসলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক, যেখানে কিছুই নিশ্চিত নয়, কিছুই স্থায়ী নয়!

     

    ২৯ বছর আগে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন জাভেদ মিঁয়াদাদ। পাকিস্তানের ব্যাটিং কিংবদন্তি। ততোদিনে ইংল্যান্ডে দশ টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ২৫! ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টে মিঁয়াদাদ জবাব দিয়েছিলেন ২৬০ রান করে।

     

    মিঁয়াদাদকে আগেই ছাপিয়ে গেছেন ইউনুস। রানে। এবার ইংল্যান্ড সফরের শেষ টেস্টে, সেই ওভালেই মিঁয়াদাদের মতো কিছু করে দেখানোর পালা তাঁর!

     

    ****


    আউটসাইড-এজ হয়ে চার হয়, ইউনুসের প্রথম স্কোরিং শট। দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পর নেমেছিলেন। ক্রিস ওকসকে কাভারে মেরে দুই রান নেন, ইউনুসের রান ২০ হয়। ইউনুসের ইনিংস তাহলে শুরু হলো!

     

    চা-বিরতির সময় ইউনুসের রান ২৬। আসাদ শফিকের সঙ্গে জুটিটা জমে উঠছে তখন। শফিক ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে থাকলেন ১৭ বল। তাঁর চাপ কমাতেই কিনা, মঈনকে প্রথম ছক্কাটা মারলেন ইউনুস। ইংল্যান্ড এরপর একটা রিভিউ করলো, ব্যর্থ। শফিককে ৯৯-এ রেখেই ফিফটি হয়ে গেল ইউনুসের। ইউনুস তাহলে আবার শূন্যতে পৌঁছালেন।

     

    শফিক যখন আউট হলেন, ইউনুসের রান তখন ৭০ পেরিয়ে গেছে। ফিনের প্যাডের ওপরে করা বলটা ফাইন লেগ দিয়ে চার মেরে ৭০ করেছেন। ইউনুসের আত্মবিশ্বাস তখন ঠিকরে পড়ছে যেন! ইউনুসকে যে ডাকছে, সেঞ্চুরি। অবশ্য পুরোনো বলটা থাকতে থাকতে ৯১ রান পর্যন্ত করতে পারলেন। নতুন বলে পঞ্চম ওভারের প্রথম বলেই চলে গেলেন মিসবাহ। ওই ওভারেই এলেন আর গেলেন অভিষিক্ত ইফতেখারও! ইউনুস তখনও ৯৯ রানে। ওকসের বলটায় শুধু ব্যাট ঠোকালেন। ইউনুস ছুটলেন। ৩২ নম্বর সেঞ্চুরির দিকে।

     

    পাকিস্তান তখনও চার রানে পিছিয়ে। পাকিস্তান ইনিংস ঘোষণা করবে না। ইউনুসের লক্ষ্য তাহলে ২০০! এরই মাঝে দ্বিতীয় দিন শেষ। নতুন দিন, নতুন সেশন। তাহলে নতুন ইউনুস!

     

    ****

     

    ইউনুসের এবার নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার পালা। আবার শুরু থেকে। সরফরাজ ওদিকে রান তোলার দায়িত্বটা নিয়ে নিয়েছেন। ইউনুসকে যেন সময় দিচ্ছেন তিনিও! স্টুয়ার্ট ব্রডকে ফ্লিক করে দিনের প্রথম রানটা যখন ইউনুস নিলেন, ততক্ষণে খেলে ফেলেছেন ১৩টি বল! আরও সাত বল পরে অ্যান্ডারসন থেকে নিলেন আরেকটি রান। এর পাঁচ বল পর ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে চার। এক ঘন্টা শেষ, ইউনুসের ২৫টি ডেলিভারি খেলা শেষ। স্কোরিং শট; মাত্র তিনটি!

     

    তবে ইউনুস নড়বড়ে ছিলেন না। ইউনুস সময় নিচ্ছিলেন। সুনিপুণ শিল্পীর মতো রঙের আস্তরণ গড়ছিলেন, একের পর এক।  

     

    সরফরাজের সঙ্গে ৭৭ রানের জুটিটা শেষ হলো। ইউনুসের তখনও সব ঠিকঠাক। টাইমিং, মুভমেন্ট। ফিনের লাফিয়ে ওঠা বলটা ব্যাটে লাগলো না, ব্রুস অক্সেনফোর্ড আঙ্গুলও তুলে দিলেন। ইউনুস ওপাশের সঙ্গী ওয়াহাব রিয়াজের সঙ্গে আলোচনা করলেন, বলটা কি আসলেই ওপরের দিকে উঠছিল কিনা। ইউনুস বেঁচে গেলেন। টপ অব দ্য বাউন্সে খেলার অভ্যাসটাই হয়তো বাঁচিয়ে দিল!

     

    রিয়াজ সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন ইউনুসকে। ২৩ বলে এক রান। যা করার ইউনুসই করবেন! লাঞ্চে গেলেন ইউনুস, রিয়াজকে সঙ্গী করেই। ৩২ বলে চার করে রিয়াজ যখন স্ট্যাম্পড হলেন, ইউনুসের ডাবল সেঞ্চুরি তখনও ৪০ রান দূরে। বাকী শুধু মোহাম্মদ আমির আর সোহেল খান।

     

    রিয়াজের দায়িত্বটা এবার নিলেন আমির। ইউনুস মঈনকে দ্বিতীয় ছয়টা মারেন। ইউনুসের রান ১৯৩ হয়ে যায়। আমির খেলে ফেলেন ২২টি বল। আমিরের কোনোই রান নেই! যেন সব আগলে ইউনুসের ডাবল সেঞ্চুরিটা করিয়েই ছাড়বেন! দুজন মিলে সিঙ্গেলসকে ডাবলস বানান। ইউনুস ১৯৫ রানে পৌঁছান। ডাবল সেঞ্চুরি থেকে একটা স্কোরিং শট দূরে দাঁড়িয়ে।

     

    ****

     

    ইউনুস দাঁড়িয়ে থাকেন না। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। মঈন আলিকে উড়িয়ে মারেন। লন্ডনের আকাশ চিড়ে ওভালের গ্যালারিতে গিয়ে পড়ে বল। উঠে দাঁড়ায় গোটা ওভাল। ছয় মেরে ডাবল সেঞ্চুরি, নাম্বার ছয়। ইউনুস খান, ওভালের করতালিতে সিক্ত। ড্রেসিংরুমে একেকজনের হাসি ঠিকরে পড়ছে, হাসছেন মিসবাহ্‌, হাসছেন এই টেস্টে না খেলা মোহাম্মদ হাফিজ। হাসছেন ইন্তিখাব আলম। শুধু নির্বিকার মাঠের ওই মানুষটা। যাঁকে ঘিরে এত হাসি। সেঞ্চুরির মতোই হেলমেটটা খোলেন। ব্যাটটা তোলেন। লুটিয়ে পড়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেন। ইউনুস আবার ব্যাটিং শুরু করেন।

     

    এবার সঙ্গী হন আমিরও। আগের ২৩ বলে যিনি কোনো রান নেননি, হুট করেই মঈনকে ছক্কা মেরে বসেন! ইউনুসের ডাবল সেঞ্চুরি যে হয়ে গেছে! আমির এরপরের চার বলে মারেন আরও দুই চার! আমিরও খেলেন, ইউনুস খেলেন। অবশেষে ইউনুস খান থামেন।

     

    এই ইউনুসই পাকিস্তানকে টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন। শেষ যেবার দেশের মাটিতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেবার তাঁর একটা ট্রিপল সেঞ্চুরি ছিল। তিনি দেশ থেকে ক্রিকেট নির্বাসনে যেতে দেখেছেন। সতীর্থদের জেলে যেতে দেখেছেন। প্রতিপক্ষের বাসে সন্ত্রাসী হামলা দেখেছেন। তিনি অন্ধকার থেকে দেশের ক্রিকেটকে তুলে এনেছিলেন, তাঁর দেশের জন্যই তিনি ২০ থেকে ৫০ রানে গিয়ে আবার শূন্যে পৌঁছান। আবার শুরু করেন। ব্যাট করতে থাকেন। সেই ক্রিকেটারের নিশ্চয়ই অধিকার আছে এটা জানার, তাঁর দল চেষ্টা করেছিল, এক নম্বরে ওঠার। সারাজীবন ইউনুস এ জিনিসটাই করে এসেছেন। তাঁর দেশ আর দেশের ক্রিকেটকে টেনে তোলার দায়িত্বটা পালন করা।

     

    সরফরাজ, রিয়াজ, আমিররা যেন সেটাই আরেকবার জানান দিলেন, তাঁদের ‘মাস্টার’কে সম্মান দিতে তাঁরা জানেন। নিজে আক্রমণ করে, নিজে চুপটি মেরে থেকে। ইউনুসকে খেলতে দিয়ে। ইউনুসকে ডাবল সেঞ্চুরি করতে দিয়ে।

     

    ****


    অ্যান্ডারসনের ‘অফস্পিন’-এ কাবু হন। প্যাডে লাগে বল, মারাই এরাসমাস আউট দেন। আমিরের সঙ্গে আলোচনা করে রিভিউ নেন, বলটা যে বাইরের দিকে যাচ্ছিল লেগস্ট্যাম্প দিয়ে। পরে আবার শ্যাডো করেন, কিভাবে খেলা উচিৎ ছিল। বড় স্ক্রিনে রিপ্লে দেখে নিজেই হাঁটা দেন। ইংলিশ ক্রিকেদারদের জমায়েত থেকে তালি আসে, গোটা ওভাল আরেকবার উঠে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের ড্রেসিং রুম উঠে দাঁড়ায়। এ যুগের এক ব্যাটিং-মাস্টারের এক মাস্টারক্লাস ইনিংসকে অভিনন্দন জানাতে। ইউনুস সেই করতালিতে মিশে যান। ওভালের ড্রেসিংরুমে। তারপর এক শূন্যতায়।

     

    যে শুন্য থেকে আবার শুরু করবেন ইউনুস।

    যে শুন্য দিয়ে গড়বেন আরেকটা মাস্টারক্লাস, যে শুন্য দিয়ে পূর্ণ করবেন পাকিস্তানের ক্রিকেটকে। বিশ্ব ক্রিকেটকে।