পাকিস্তানে এক ওয়েলসের 'আগন্তুক'
উত্তর আয়ারল্যান্ডের চিরায়ত এক বিষণ্ণ, মনমরা বসন্তের দিন। বেলফাস্ট সিটি বিমানবন্দরের বাইরে বৃষ্টি, রীতিমতো জমাট-বাঁধা ঠান্ডা। ইনস্টোনিয়ানস ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক নেইল রাসেল নিতে এসেছেন পাকিস্তানী এক পেশাদার খেলোয়াড়কে, লিগে তাঁর দলের হয়ে খেলবেন তিনি। সানগ্লাস চোখে বেরিয়ে এলেন সেই ক্রিকেটার, বেলফাস্টের আবহাওয়া সম্পর্কে তিনি যে খুব একটা ওয়াকিবহাল, সেটা বোঝার উপায় নেই। তবে রাসেল তাঁর মুখে আবহাওয়া সংক্রান্ত কিছু শুনলেন না, বরং শুনলেন, ‘স্কিপার, আমি পাকিস্তানের হয়ে শীঘ্রই খেলবো, দেখে রেখো। এই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।’ রাসেলের মনে হয়েছিল, ‘আচ্ছা, এখন যাই চলো’। সেই ক্রিকেটার কিন্তু ঠিকই বলেছিলেন।
****
দুই শহরের মাঝের দূরত্ব প্রায় মাইল চল্লিশেক। সোয়ানসি আর কার্ডিফ, দুই শহরের মাঝে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাবও আছে। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনসে ইমাদ ওয়াসিম যখন ওইন মরগানের ফিরতি ক্যাচটা নিলেন, সোয়ানসি কি ভুলে গেল এ শহরের সাথের ‘বৈরীতা’? গ্যালারিতে পাকিস্তানের পতাকার ভীড়ে কি আলাদা করে চোখে পড়লো সোয়ানসি আর কার্ডিফের দেশ ওয়েলসের পতাকা? এত তাৎপর্যপূর্ণ সংকেত খোঁজার একটা উপলক্ষ্য তো আছে নিশ্চয়ই! ওই যে, ইমাদ ওয়াসিম। মরগানের ক্যাচটা নিয়ে ওয়েলসের মাটিতে জন্ম নিয়ে এখানেই উইকেট নেয়া প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার যে হয়ে গেছেন তিনি! কার্ডিফে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজের শেষ ওয়ানডে খেলতে নামা ইমাদের জন্ম যে সোয়ানসিতে!
তবে ওয়েলসের কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব গ্ল্যামারগনের ড্যাফোডিল বা ইংল্যান্ড বোর্ডের তিন সিংহের লোগোওয়ালা জার্সি গায়ে তোলা হয়নি ইমাদের। ব্যাট-বল হাতে নেয়ার বয়স হওয়ার আগেই যে তাঁর বাবা-মা ওয়েলস ছেড়েছেন, ইমাদের ‘জন্মটাই শুধু ওয়েলসে হয়েছিল’।
ইনস্টোনিয়ানসের হয়ে খেলার সময়
বাবা প্রকৌশলী ছিলেন, তাঁর চাকুরির সুবাদেই ইমাদের ওয়েলসে থাকা। চাকরী শেষে আবার ফিরেছেন পাকিস্তানে। মেডিসিনে পড়াশুনাটা প্রায় শুরুই করে দিয়েছিলেন ইমাদ, পাকিস্তানের বয়সভিত্তিক দল থেকে ডাকটা আসে তখনোই। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন, পরের আসরে দলকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন।
নামের মিল থাকার সুবাদে হোক, বা কৈশোরের উন্মাদনা, ইমাদও হতে চাইতেন ‘ওয়াসিম’ এর মতোই। আকরামের মতো বাঁহাতি হলেও হাতে পেস যে ছিল না খুব একটা! ইমাদ তাই স্পিনার হয়ে গেলেন। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনে পেলেন সাফল্যও। সাথে মিডল অর্ডারের ব্যাটিং, ইমাদের স্বপ্ন ছিল, তার চেয়েও বেশী ছিল আত্মবিশ্বাস!
বয়সভিত্তিক দল থেকে সরাসরি যে জাতীয় দলে তা নয়, ইমাদের গড়ে ওঠা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট দিয়ে। ২০০৭ সালে ইসলামাবাদের হয়ে অভিষেকেই ফিফটি, ২০১৩ সালে ইনিংসে নিয়েছিলেন আট উইকেট। ২০১৪ সালে করেছেন ডাবল সেঞ্চুরি।
****
ইমাদ নিজের জন্মস্থান ‘যুক্তরাজ্যে’ ফিরেছেন এর মাঝে। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলেছেন বার্নলি ও অ্যাক্রিলিংটনের হয়ে। তবে সবচেয়ে বড় উপকারটা করেছিল আয়ারল্যান্ডের লিগ। বেলফাস্টে ইনস্টোনিয়ানস ক্লাবের হয়ে লিগ জিতেছিলেন, এক মৌসুমে ১৯.৩৮ গড়ে ২১ উইকেটের পাশাপাশি করেছিলেন ৪২ গড়ে ৬০৮ রান।
কোনো এক বসন্তের দিনে বেলফাস্ট বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে রাসেলকে যা বলেছিলেন ইমাদ, দুই বছরের মাথায় তা ফলেছে, এখন পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটারদেরই তো একজন তিনি! ইংল্যান্ডের সঙ্গে চার ম্যাচে করেছেন ১৫৭ রান, একবারও আউট হননি বলে গড়টা বের করা যাচ্ছে না। চারটি উইকেট নিয়েছেন, আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজের আগে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে এক ম্যাচেই নিয়েছেন পাঁচ উইকেট!
সেই আয়ারল্যান্ড, ২০১৪ সালে এখানেই খেলতে এসেছিলেন ইমাদ; রাসেলদের দলে। শুরুতে মানিয়ে নিতে পারেননি সহজে, সপ্তাহ তিনেক লেগেছিল; বেলফাস্টের ক্রিকেট পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। তবে একবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর ইমাদের আসল ‘চরিত্র’টা বেরিয়ে এসেছিল খেলার মাঠে, দলের ড্রেসিংরুমে, কিংবা অপেক্ষাকৃত তরুণদের সহায়তায়। রাসেলের মতে, ‘ইমাদ হচ্ছেন শতভাগ ‘টিমম্যান’।’ ইনস্টোনিয়ানসের সবাই ইমাদের এই দিকটাই সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতেন।
‘ব্যাটিংয়ে একটা সহজাত সামর্থ্য আছে, বোলিংয়ে আছে নিয়ন্ত্রণ। চতুর একজন ক্রিকেটার, ক্রিকেট মস্তিস্ক বেশ তীক্ষ্ণ। ব্যাটসম্যানকে দ্রুত পড়ে ফেলার একটা ক্ষমতা আছে, আমার দেখা সেরা আর্ম বলটা সে করতে পারে। সিআই-এর সঙ্গে তার ১১৪ রানের ইনিংসটা আমাদের ক্লাবকে ষাটের দশকের পর প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতিয়েছিল!’
বিমানবন্দরে নেমেই রাসেলকে সেই যে ‘স্কিপার’ ডাকা শুরু করেছিলেন ইমাদ, তা বহাল আছে এখনও। সে সম্মানটা বজায় আছে ইমাদের, রাসেলের প্রতি। হয়তো হোয়াটস অ্যাপে কথা হচ্ছে সন্ধ্যাবেলায়, ইমাদ কথা শুরু করেন, ‘গুড ইভিনিং, স্কিপার’ বলে।
বেলফাস্টের এক লিগ খেলা ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ, ব্যাপারটা কি চমকপ্রদ? ‘ইনস্টোনিয়ানস ছাড়ার পর থেকে ইমির ক্যারিয়ারে সে যা করেছে, এটা দেখতে পারা দারুণ। কিন্তু এটা কি আমাদের কাছে চমকপ্রদ ছিল? নাহ, কোনোভবেই না। আমার মনে হয়, আমরা সবাই জানতাম, সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেই। কিছু খেলোয়াড়ের মধ্যে এই ব্যাপারটা থাকে, ‘এক্স-ফ্যাকটর’। ইমির এটা প্রচুর ছিল।’
পরের সপ্তাহেই ম্যানচেস্টারে পাকিস্তানের ইংল্যান্ডের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। রাসেলের সঙ্গে ইমাদের দেখা হবে সেখানেই। রাসেল উচ্ছ্বসিত, ‘তার নাগাল পেতে আমার তর সইছে না। ও হ্যাঁ, আমার ওয়ালেটটার ধুলো ঝেড়ে রাখতে হবে। সে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হতে পারে, সিপিএল খেলা ক্রিকেটার হতে পারে, কিন্তু ডিনারের বিল সে দেবে, এটা হতে পারে না!’
****
সাঈদ আজমল যখন চাকিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ, ইমাদ সুযোগ পেয়ে গেলেন তখন। কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওয়ানডে অভিষেকের আগেই টি-টোয়েন্টিতে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে অভিষেক হয়ে গিয়েছিল ইমাদের। পাকিস্তানের এ প্রজন্মের একটা আক্ষেপ থাকতে পারে দেশের মাটিতে না খেলার, তবে পাকিস্তানে জন্ম না নিয়েও ইমাদের অভিষেক হয়েছিল তাঁর দেশের মাটিতেই! অনেক নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে যে সেবার জিম্বাবুয়েকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পাকিস্তান।
এরপর ১১টি টি-টোয়েন্টি ও ১০টি ওয়ানডে খেলা ইমাদ ওয়াসিম ফিরলেন ওয়েলসে। তাঁর জন্মস্থানে। ১১তম ওয়ানডে খেলতে। ২০০৮ সালে সোফিয়া গার্ডেনসের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছিল, এরপর থেকে ওয়েলসে জন্মানো কোনো ক্রিকেটার এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি। যিনি খেলবেন, তিনিও যে ইংল্যান্ডের হয়ে না খেলে খেলবেন পাকিস্তানের হয়ে, সেটা কে জানতো!