১৮ বছর পর আবার কোয়ার্টার ফাইনালে!
মার্গারেট অ্যারেনায় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মহিলা এককের চতুর্থ রাউন্ডের ম্যাচের একেবারে অন্তিম মুহূর্ত। যুক্তরাষ্ট্রের জেনিডার ব্র্যাডিকে সরাসরি সেটে হারানোর সাথে সাথে শিশুদের মতো কয়েকবার লাফ দিলেন। ম্যাচ জেতার পর এরকম উচ্ছ্বসিত কেউ হতেই পারে। তবে সাংবাদিকদের সামনে ম্যাচ পরবর্তী কথোপকথনের সময় হঠাৎই মিরজানা লুচিচের চোখটা ছলছল করে উঠল। দীর্ঘ ১৮ বছর পর কোনো গ্র্যান্ড স্ল্যামের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেন তিনি!
নাহ, ভুল পড়েননি। শেষ ১৬ তে ওঠার জন্য লুচিচকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সুদীর্ঘ ১৮ বছর! সেই ১৯৯৯ সালে উইম্বলডনের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন, সেবার কিংবদন্তি স্টেফি গ্রাফের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়। এরপর আর চতুর্থ রাউন্ডের বাধা পার হতে পারেননি। এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনটা তাই তাঁর কাছে একটু ‘বিশেষ’ই বলতে হয়।
১৯ বছর আগে এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেই নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ার লুচিচ। ১৯৯৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্রোয়েশিয়ান ‘লেডিস ওপেন’ জেতা লুচিচ পরের বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথমবারের মতো খেলতে আসেন। সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মার্টিনা হিঙ্গিসের সাথে জুটি বেধে সেবারই জিতে নেন দ্বৈত বিভাগের শিরোপা। এরপর সেই উইম্বলডনের সেমিতে ওঠা। সবাই ভেবেছিলেন, টেনিস নতুন এক হীরার সন্ধান পেয়ে গিয়েছে।
মার্টিনা হিঙ্গিসের সাথে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা হাতে লুচিচ
কিন্তু বিধি বাম। স্বপ্নযাত্রা শুরু হওয়ার অল্প কয়দিনের মাঝেই লুচিচের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মদ্যপ বাবা মারিনকো ছোটবেলা থেকেই লুচিচসহ বাকি ভাইবোনদের মারধোর করতেন, বাদ যেত না তাঁর মাও। অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেলে সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান লুচিচের মা। সেখানে গিয়ে দারুণ অর্থকষ্টে পড়েন, সাথে যোগ হয় লুচিচের নানা শারীরিক সমস্যাও। ২০০৩ সালের ইউএস ওপেনের পর স্বেচ্ছায় টেনিস থেকে একরকম নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কোনো গ্র্যান্ড স্ল্যামেও অংশ নেননি।
২০০৯ সালে অকল্যান্ডে এএসবি ক্লাসিকে অবাছাই খেলোয়াড় হিসেবে পুনরায় কোর্টে নামেন। তবে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় বলতে হয়। হয়তো সেবার ভেবেছিলেন, ফিরে এসে কি ভুল করেছেন? এরপর আবারো কিছুদিনের বিরতি। তবে ২০১১ সালে ড্যানিয়েল বারোনিকে বিয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে আশার আলো দেখতে পান। লুচিচকে বরাবরই সমর্থন করে এসেছেন ড্যানিয়েল, তাঁর অনুরোধেই ২০১৪ সালের কুবেক সিটি ওপেনে অংশ নিয়েই বাজিমাত করেন। প্রায় ১৭ বছর পর আবারো কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতেন লুচিচ।
বর্তমানে র্যাঙ্কিংয়ের ৭৯তম স্থানে থাকা লুচিচের অবশ্য নিজের জীবনের ‘ট্র্যাজেডি’ নিয়ে খুব একটা আফসোস নেই, “আমি নিজের জীবন নিয়ে গর্বিত। আমার ক্যারিয়ারটা অন্যরকম হতে পারতো, কিন্তু সেটা হয়নি। হয়তো এটাই আমার নিয়তি! তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব বেশি আনন্দিত, সেটা হচ্ছে মানুষকে ভুল প্রমাণ করতে পেরে। সবাই ভেবেছিল, এই বয়সে আর কতদূরই বা যেতে পারবো!”
অনেকেই তাঁর শেষ দেখে ফেলেছিলেন, হয়তো নিজেও একটা সময় এরকমটাই ভাবতেন। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যেতে চান লুচিচ, “শনিবারের ম্যাচের পর ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবছি। আরও বেশ কিছুদিন খেলা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, দেখা যাক কী হয়!”
ইচ্ছে থাকলেও হয়তো খুব বেশিদিন খেলাটা চালিয়ে যেতে পারবেন না ৩৪ বছর বয়সী লুচিচ। নিজের জীবনে তো অনেক চড়াই উতরাই পার করেছেন। এখন তাঁর একটাই লক্ষ্য, তরুণদের টেনিস শেখানো, “বয়স তো কম হলো না, অনেক কিছুই তো দেখলাম জীবনে। আমি চাই ভবিষ্যতে তরুণদের টেনিস কোচিং করাতে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কাউকে সাহায্য করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।”