প্রিমিয়ার লিগে বিকেএসপিতে একদিন

‘কাম-অন মোহামেডান, কাম-অন!’
চিৎকারটা শুধু শুনে থাকলে আপনার অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে কে কিভাবে চিৎকার করছেন, এটা দেখে থাকলে একটু অবাকই হবেন। পানি-পানের দ্বিতীয় বিরতিটা মাত্র শেষ হয়েছে। গাজী গ্রুপের নাসির হোসেন ও পারভেজ রসুলের চতুর্থ উইকেট জুটিটা ভাঙার আশা তখন মিলিয়ে যাচ্ছে, মেহেদী হাসান মিরাজ লং-অফে ফিল্ডিং করতে আসতেই আসতেই করছেন চিৎকার। আসার পথেই মুখ তুলে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আসসালামু আলাইকুম।’ কলাবাগানের কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীকে দেখতে পেয়েছেন মাঠের পাশে রাস্তার ওপরে। রাস্তার ওপাশের মাঠে তখন প্রাইম ব্যাংকের চতুর্থ উইকেট জুটিটা ভেঙেছে, তাইবুর রহমান-উন্মুক্ত চাঁদের। এ জুটিই এতক্ষণ ভুগিয়েছে কলাবাগানকে। তিন ও চার নম্বর মাঠের সব উত্তেজনা শেষ হয়ে এসেছে ওই চতুর্থ উইকেট জুটিতেই!
****
বিকেএসপিকে এতোদিন মুখ বাড়িয়েই দেখেছি শুধু। দিনাজপুর যাওয়া-আসার পথে পড়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাস্তার ধারেই একটা ক্রিকেট মাঠ, নজর আরেকটু বাড়ালে ইনডোর ক্রিকেট-সেন্টারটাও চোখে পড়ে। এবার গন্তব্য চার নম্বর মাঠ। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে কলাবাগান-প্রাইম ব্যাংকের খেলা সেখানেই।
শাহবাগ থেকে বাসে উঠেছি। বন্ধুদের বলে দেয়া বাসে। তবে রাস্তা যেন ফুরোতেই চায় না এরপর! গাবতলি-নবীনগর-সাভার-বাইপাইল-ইপিজেড। এরপর জিরানী বাজার, বাস নামিয়ে দিল বিকেএসপির গেটেই। সেখান থেকে যে ভ্যান পাওয়া যায়, জানতামই না! এবার ফুরোতে চায়না হাঁটা পথ! এক মালির দেখিয়ে দেয়া পথে ‘শর্টকার্ট’ মারা গেল। বিকেএসপির ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকদের মাঝে চলছে বর্ষবরণের তোরজোর। সবাই মিলে আঁকছেন আল্পনা, তাঁরা শুধু খেলতে পারেন না, আঁকতেও পারেন! দুই বছর আগে কার্জন হলের রাস্তায় আল্পনা করেছিলাম, সেই দিন ফুরিয়ে গেছে সেই কবেই! বিকেএসপিতে আমি ‘সাংবাদিক’, আল্পনার সাজসজ্জা দেখে নস্টালজিয়াই শুধু আক্রমণ করে বসতে পারে!
‘আরেকটা’!
উইকেট না, চার-ছয়ও না। রহমত শাহর ‘জীবন’ হিসাব করছিলেন দর্শকরা।
মোহামেডান-গাজী গ্রুপের খেলা চলছে তিন নম্বর মাঠে। চার নম্বর মাঠে যাওয়ার উদ্দেশ্য আমার, থমকে দাঁড়াতে হলো এই খেলা দেখে। ডানদিকে তাকিয়েই নজরে এলো ব্যাপারটা, বিকেএসপির তিন ও চার নম্বর মাঠটা যে একেবারে পাশাপাশি! দুই মাঠের বিভাজন তৈরী করেছে শুধু একটা পিচের রাস্তা। শুরু হয়ে গেল দোটানা, কোন ম্যাচ ছেড়ে কোনটা দেখি!
একদিকে মাসাকাদজা-তুষার ইমরান কলাবাগানকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন, আরেকদিকে মিরাজ-রহমত শাহর চেষ্টা মোহামেডানকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা। সৌম্য সরকার বোলিংয়ে এলেন এদিকে। সৌম্য ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি যে মিডিয়াম পেস করেন, সেটা তো জানা কথা! তবে ২৩ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সৌম্য সাকুল্যে বোলিং করেছেন ১১ ওভার। প্রাইম ব্যাংকের হয়ে এ ম্যাচেই করলেন ৯ ওভার। উইকেট নিলেন দুইটা। মাসাকাদজা-তুষার, দুজনকেই করলেন বোল্ড!
বোল্ডের নেশায় মেতেছিলেন রুবেল হোসেনও। ‘অতিরিক্ত ফ্ল্যাট’ উইকেটেই রুবেলকে পড়তে পারছিলেন না কলাবাগানের ব্যাটসম্যানরা, তিনটা বোল্ডের সঙ্গে তিনটা ক্যাচ; রুবেল হোসেন খবর হয়ে গেছেন প্রথম ইনিংসের পরপরই!
****
‘আরেকটা’!
উইকেট না, চার-ছয়ও না। রহমত শাহর ‘জীবন’ হিসাব করছিলেন দর্শকরা। ঠিক দর্শক নন, ক্লাবের কর্মকর্তা, সাংবাদিক আর বিকেএসপির অভ্যন্তরীণ কিছু মানুষ। রহমত শাহ একের পর এক ক্যাচ তুলে দেন, স্ট্যাম্পিংয়ের সুযোগ দেন, গাজী গ্রুপ বেহাত করে সেগুলোই! ‘মিরাজ, ওকে বুঝাও’, ক্লাব কর্তারা প্রথম প্রথম হাহাকারই করছিলেন যেন! এতো জীবন পেয়ে মোহামেডানের রহমতই সর্বোচ্চ স্কোরার। ৭৮ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যাওয়া মোহামেডার স্কোর একসময় ২৫০ পেরিয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছিল মিরাজ-রহমতের ব্যাটিংয়ে! তবে চার রানের ব্যবধানেই ফিরলেন দুজন। প্রথমে অনেক জীবন পাওয়া রহমত, যে একটা উপায়ে তাঁর আউট হওয়ার সুযোগ ছিল তখন অবস্থার প্রেক্ষিতে, তিনি হলেন সেই রান-আউটই! মোহামেডান আটকে গেল ২২০ রানেই।
ওপাশের মাঠে তখন 'একাল-সেকালের প্রতিনিধি'র চেষ্টা চলছে। মেহরাব হোসেন জুনিয়রই সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন সনজিত সাহাকে, কলাবাগানের ইনিংসটা যদি একটু যুৎসই হয়! হলো না। মেহরাব ফিরলেন, শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে সনজিত ফেরার সময়ও বল বাকি ২২টা। ১৮৪ রানের বেশি হলোও না তাই।
****
পাশাপাশি দুইটা মাঠ। আলাদা করা কঠিন, অবস্থান বাদ দিলে। মাঠের পাশে একটা করে বিল্ডিং। দুইপাশে দুইটা ড্রেসিংরুম, মাঝে ম্যাচ অফিশিয়ালদের। ওপরে কাঁচঘেরা জায়গা, হয়তো ভিআইপিদের জন্য। স্কোরারও বসেন তার পাশে। মাঠের একদিকে স্কোরবোর্ড, তবে সেখানে শুধু রান উইকেট আর ওভার! কোন ব্যাটসম্যান কতো রান করলেন, সেটা খুঁজতে আপনার ভরসা অফিশিয়াল স্কোরার অথবা ইন্টারনেট!
মাঠে যত্নআত্তির ছাপ স্পষ্ট। বাউন্ডারি ছোট অবশ্যই। মাঠের পাশ দিয়ে সব গাছ, ওই দূরে বিকেএসপির সীমানার বাইরে সব ছোট-বড় বিল্ডিং। একটাতে আবার ফিলিস্তিনের মতো করে একটা পতাকা উড়ছে। কেন, কে জানে! তিন নম্বরের দৃষ্টিসীমার ওপর দিয়ে একসময় একটা বিমান উড়ে গেল। কুইন্সটাউনের ঠিক পাশ দিয়েই ‘টেক-অফ’ করতে থাকা একটা বিমানের ছবির কথা মনে পড়ে যায়! মোবাইল ফোনের দূর্বল ক্যামেরায় বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠ আর বিমান একই ফ্রেমে আসে, তবে বিমান সেখানে ছায়া!
ইনিংস ব্রেকে ছুটতে হলো খাবারের সন্ধানে। মিরপুরের প্রেসবক্সে মিডিয়ার অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধার ছিঁটেফোটাও নেই এখানে, ভাগ্যিস সঙ্গে করে পানি নিয়ে গিয়েছিলাম! মাঠের পাশের গ্যালারিতে একটু বসার সুযোগটাও মিলিয়ে গেল, দুপুরের কড়া রোদের রাজত্ব তখন ওই ছোট্ট গ্যালারিতে! সাইটস্ক্রিনের পাশে গাছের ছায়ায় দাঁড়ানোই তখন ভরসা!
****
ওপাশে জহুরুল-মুমিনুল ফিরেছেন। মোহামেডান ফিরেছে ম্যাচে, খুব তাড়াতাড়িই। গাজী গ্রুপের ড্রেসিংরুমের সামনে মোহামেডানের তামিম ইকবাল। ব্যস্ত কোচ সালাহউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলতে। টি-শার্ট পরা তামিম এ ম্যাচে নিষিদ্ধ, খেলবেন তাই পরের রাউন্ড থেকে।
ওপাশে সৌম্য-মেহেদী মারুফ প্রাইম ব্যাংককে একটা ভাল শুরু এনে দেয়ার চেষ্টায় মশগুল। এ ম্যাচ দিয়েই প্রিমিয়ার লিগে ফেরা মোহাম্মদ আশরাফুল বোলিংয়ে আনলেন তাঁর অন্যতম প্রধান অস্ত্র সনজিতকে। সেই কবে, সনজিত যখন শুধুই দিনাজপুরে শখের বশে খেলে বেড়ানো এক কিশোর, তখন তাঁর বোলিং দেখেছিলাম বয়সভিত্তিক একটা টুর্নামেন্টে। মাঝে অ্যাকশন নিয়ে ঝামেলায় পড়া সনজিত গতবারও প্রিমিয়ার লিগ খেলেছেন, তবে দেখা হয়নি। নতুন অ্যাকশনের সনজিতকে দেখার একটা রোমাঞ্চ ছিল। সনজিত সেটা মেটালেন। প্রথম ওভারেই সৌম্যকে করলেন মেডেন।
উড়তে থাকা মারুফকে এলবিডাব্লিউ করলেন পরের ওভারেই। সাব্বির এলেন। মাটি ছুঁয়ে দুইবার প্রণাম করলেন সনজিত, প্রতি ওভারের শুরুতে, বা উইকেট পাওয়ার পর আবার বোলিং শুরু করতে সনজিত এই কাজটা করেন। পরে কথা বলে জেনেছি, সেই বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময় থেকেই এই অভ্যাসটা আছে তাঁর! সাব্বির ফিরলেন সনজিতের বলে বোল্ড হয়েই। তার আগেই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে একটা, উইকেটের পর শর্ট মিড-উইকেটে অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের উল্লাস দেখে মনে হলো উইকেটটা পেয়েছেন তিনিই!
****
‘হাউজ্যাট, হাউজ্যাট নাদির ভাই’!
কট-বিহাইন্ডের আবেদনটা নাকচ করে দিয়েছেন আম্পায়ার নাদির শাহ। মাত্রই পঞ্চম উইকেট গেছে, প্রাইম ব্যাংককে শেষবার চাপ দেয়ার কাজটা অনেকখানি এগিয়ে যেতো নাদির আউটটা দিলেই! সে কারণেই কিনা কলাবাগান ক্রিকেটারদের আর্তনাদটা শোনা গেল বেশী করে! নাদিরকে গলানো গেল না, ম্যাচেও আর ফেরা হলো না কলাবাগানের। তবে এর আগেই বেশ কয়েকটা সুযোগ পেয়েছিল তারা, সহজ-কঠিন ক্যাচগুলো নিলে ম্যাচের চেহারা বদলে যেতো সহজেই! সনজিতের বলেই অন্তত দুইটা ক্যাচ মিস হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে স্ট্যাম্পিংয়ের সুযোগও! আশরাফুলের বলে আরও দুইটা ক্যাচ ছেড়েছেন তাসামুল-আবুলরা। উন্মুক্ত চাঁদ নড়বড়ে ছিলেন বেশ, থিতু হয়ে ম্যাচ জেতানোর কাজটাও সেরেছেন তিনিই।
‘হাউজ্যাট, হাউজ্যাট নাদির ভাই’!
ওপাশে তখন অপেক্ষা নাসিরের সেঞ্চুরির। তাইজুলকে মাঝে এক ওভারে পরপর তিন বলে ছয় মেরেছেন, নাসিরের আগ্রাসী মনোভাব মিলিয়ে গেল যেন ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে। সেই চিরন্তন চাপ এসে ভর করলো তাঁর ওপর, ৬টা ডট বল খেললেন সেখানেই! অবশেষে ‘টাক’ করে একটা সিঙ্গেল, নাসিরের মুখটা এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও হাসিটা চোখে পড়েই! সেই হাসির পেছনে হয়তো ছিল শুধুই আরেকটা সেঞ্চুরির উল্লাস! তিন নম্বর মাঠের খেলাই শেষ হলো আগে, অথচ খেলার গতিপথ একসময় বলছিল সময় লাগবে সেটারই বেশি!
ওদিকে নাসির, এদিকে রুবেল; দুই ম্যাচের দুই ম্যাচসেরা। জাতীয় দলের একসময় নিয়মিত দুইজন, ফিরবেন কি ফিরবেন না করে যারা আলোচনায়! স্পন্সরের বোর্ডটা আসে, একটা ডামি চেক আর ট্রফি। ট্রফির ওপরের বলটা কেন লাল, প্রশ্নটাও উঁকি দিয়ে যায়! টুর্নামেন্টটা তো সাদা বলের!
খেলা শেষ হয়, গ্রাউন্ডসম্যানরা মাঠে ঢোকেন শীঘ্রই। একাদশের বাইরের ক্রিকেটাররা নেমে পড়েন বাড়তি একটু অনুশীলনে।
***
আবার ভ্যানের অপেক্ষা। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় সেই ভ্যান। বিকেএসপির ‘অফিশিয়াল’ ভ্যান এগুলো। শুধু তাঁদেরই গেটের ভেতরের ঢোকার অনুমতি। জিরানি বাজার। আবার সেই ভাঙ্গাচোড়া রাস্তা, ধুলো।
ঢাকায় ফেরার বাসে চড়ে বসা। জ্যামের শঙ্কা।
আর মনে মনে হয়তো বলা, ‘কাম-অন প্রিমিয়ার লিগ, কাম-অন’!