• নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ
  • " />

     

    কফি, সিগারেট, শূন্য আর মার্টিন

    কফি, সিগারেট, শূন্য আর মার্টিন    

    ক্রিস মার্টিন লিখে গুগল করুন। 

    ডেনিস লিলির আদলে টেকো মাথাতেই হেডব্যান্ড পরা, দুই হাত প্রসারিত করে আবেদন বা আদতে প্রার্থনা করা সেই বোলারের ছবি, অথবা তার সেই বিখ্যাত ব্যাটিংয়ের অসাধারণ সব ক্লিপিংস- কিছুই পাবেন না। আপনি পাবেন এক ইংলিশ গায়ককে। মাইক্রোফোন সামনে দরদ দিয়ে গাচ্ছেন, ভিডিও সেকশনে গেলে পাবেন কারপুল ক্যারাওকে। অথবা হাইম ফর দ্য উইকএন্ড। কোল্ডপ্লের এই গায়ককে অবশ্য আমরা খুঁজতে আসিনি। 

    আমাদের ক্রিস মার্টিন গুগলে আলাদা করে জায়গা নিতে পারেননি। ক্রিকেট, নিউজিল্যান্ড, ব্যাটিং শব্দগুলো যোগ করতে হবে। আরও একটা কাজ করতে পারেন। ক্রিস মার্টিনের আগে-পরে ‘ডাক’ শব্দটা যোগ করে নিন। আপনি আমাদের কাঙ্খিত কিউই ভদ্রলোককে পেয়ে যাবেন। যার ব্যাটিংটা অনেক বড় এক আকর্ষণ। একটু ভিন্ন অর্থে। 

    যেমন এক ভদ্রলোক বেশ ভালই গান করেন। তার দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়েটা বড়, সেও ভাল গায়। আর ছেলেটা? ‘শুনতেই ভাল লাগে। একজন যে এতো খারাপ করে গান গাইতে পারে, সেটা শুনতেই আসলে ভাল লাগে!’ মার্টিন এভাবেই ব্যাটিংয়ের সমার্থক। তিনি ব্যাটিংয়ে বিনোদন দিতেন। কতো উপায়ে, কতো ভাবে বোল্ড হওয়া যায়, সেটা দেখাতেন। 

     

     

     

    ক্যারিয়ারে ৭১ ম্যাচে ৩৬টা ডাক আছে তার। তার বেশি আছে শুধু একজনের। কোর্টনি ওয়ালশ শূন্য রানেই আউট হয়েছিলেন ৪৩ বার, তবে সেজন্য ১৩২টি ম্যাচ খেলতে হয়েছিল তাকে, মার্টিনের প্রায় দ্বিগুণ। পেয়ার, মানে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হওয়া ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অবশ্য মার্টিনের ধারেকাছেও কেউ নেই। সাতবার তিনি পেয়েছেন ‘পেয়ার’। একবার বলেছিলেন, উঠতি বয়সে যখন অনুশীলনে যেতেন, ব্যাট নিতেন না সঙ্গে। গাড়ি ছিল না, বাইকে করে যেতেন বলে ব্যাট হয়ে উঠেছিল বাড়তি বোঝা। তবে তার এই ব্যাটিং অক্ষমতা নিয়ে নিজেই কৌতুক শুরু করেছিলেন। আর দশটা মানুষের মতো তিনিও অক্ষমতা নিয়ে বিব্রত হতেন, তবে সেটার আরেকটা দিক খুঁজে বের করেছিলেন নিজেই। চেষ্টা করতেন, বিভৎস ব্যাটিংটা একটু ‘সুশ্রী’ করতে। সেটা পারতেন না। ১০০ রান পূর্ণ করতে ৬০ ম্যাচ খেলতে হয়েছিল তাকে। ১০০তম রান নেওয়ার পর পুরো স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল, বাউন্ডারি মারলে উল্লাসে ফেটে পড়তো স্টেডিয়াম! মার্টিনের কাছে এসবও আগলে রাখার মতো স্মৃতি, তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে।

     

     

    ব্যাটিংয়ের জন্য আলাদা বুট থাকতো না তার। বাড়তি একজোড়া দিয়ে কাজ কী! ক্রিজে গিয়ে থাকবেনই বা কতক্ষণ! ৯ উইকেট যাওয়ার পরই তাই নিউজিল্যান্ড যেন অল-আউট হয়ে যেতো। 

    ইয়ান ও’ব্রায়েন তাই হতাশ হয়েছিলেন। নিজের ওপরই রাগ উঠেছিল। জেসি রাইডারকে ৯৮ রানে রেখে যে তার মতিভ্রম হলো। হারভাজান সিংকে তেঁড়েফুঁড়ে মারতে এসে স্টাম্পড হলেন ওভারের ১ম বলেই। বেসিন রিজার্ভে রাইডারের সেঞ্চুরি পূরণ তখন সুদূরে মিলিয়ে যেতে বসেছে। ৫টা বল বাকি ওভারের, আর বাকি ক্রিস মার্টিন! ড্রেসিংরুমে ফিরে এক কোণে লুকিয়ে ছিলেন ও’ব্রায়েন। সেখান থেকেই শুনলেন, পাঁচটা চিৎকার। মার্টিন পাঁচটা বল খেলে দিয়েছেন। 

    সেটাই প্রথম বা শেষবার নয়, সতীর্থের জন্য অপছন্দের ব্যাটিংটা ‘ঠিকঠাক’ করেছিলেন যেবার মার্টিন। একই ভেন্যুতে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সেঞ্চুরির সময় তিনি ছিলেন। গ্যাবাতে জ্যাকব ওরামের পাশে ছিলেন। ইডেন পার্কে স্কট স্টাইরিসকেও দেখেছেন সেঞ্চুরি করতে। ম্যাথু সিনক্লেয়ার ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন, রস টেইলর করেছিলেন ১৫০। মার্টিন ক্রিজে ছিলেন তাদের অভিনন্দন জানাতে। 

    আর সবার মতো সতীর্থদের কাছেও মার্টিন অতিপ্রিয় এক চরিত্রের নাম। এক কাপ কফি, একটা বিয়ার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারতেন। আর থাকবে সিগারেট। মার্টিনের খুব প্রিয় কাজগুলোর একটি এই ধূমপান। এমন না, অনেক কথা হবে সেসব আড্ডায়। ইয়ান ও’ব্রায়েনই যেমন, শুধু দেখতেন মার্টিনের কাজ-কারবার। কতো শান্ত, স্থির। উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। সমস্যা সমাধানে কতো দক্ষ। ড্রেসিংরুমেও আমুদে এক চরিত্র মার্টিন। 

    আর পেশাদার। কঠোর পরিশ্রম করতেন, জিমে ছিলেন বেশ সিরিয়াস। কখন বিশ্রাম নেবেন, ডায়েট (অবশ্যই সে ডায়েট তাকে ধূমপান থেকে বিরত রাখতে পারত না) কিভাবে হবে-সবকিছুই ছিল গোছানো। নিজের কাজটা করতেন নিজ দায়িত্বেই। 

     

     

     

    তার মূল দায়িত্ব ছিল বোলিং। 

    আড়াআড়ি রান-আপ। ক্রিজে ঢোকার আগে একটা লাফ। সাধারণ অ্যাকশন। হয়তো মেধা আর দক্ষতায় অসাধারণ কেউ ছিলেন না, তবে পরিশ্রম তাকে নিয়ে গেছে নিউজিল্যান্ডের রেকর্ড বইয়ের বেশ ওপরের দিকে। টেস্টে নিউজিল্যান্ড বোলারদের মাঝে তার চেয়ে বেশি উইকেট আছে শুধু স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও ড্যানিয়েল ভেট্টোরির। মার্টিনের গড় বা স্ট্রাইক রেট, দুইটিই আবার ভেট্টোরির চেয়ে ভাল। 

    ইডেন পার্কে ১১ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোয় মূল অবদান রেখেছিলেন। মার্টিনের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। ২০১২ সালে চার বলের মাঝেই আউট করেছিলেন তিন আফ্রিকান কিংবদন্তিকে। গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স। পরের দুইজন আবার ফিরেছিলেন শূন্য রানেই। ব্যাটিংয়ে শূন্যের সমার্থক মার্টিন তাই অনেক শূন্য ফিরিয়েও দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানদের! ২৩৩ টেস্ট উইকেটের মালিকের সীমিত ওভারে অবশ্য সেভাবে খেলা হয়নি। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্টদের কাছে পেস ব্যাটন ছেড়ে দিয়ে অবসর নিয়েছেন ২০১৩ সালে। সে বছরই ক্যানটারবেরি কোচিং স্টাফে যোগ দিয়েছিলেন। ‘যারই দরকার পড়ুক, আমি কথা বলতে রাজি সবসময়ই। একটা কফি বা বিয়ার সাথে নিয়ে আমার আলোচনা করতে সমস্যা নেই।’ 

    সিগারেটের কথা অবশ্য বলেননি আলাদা করে। কফি-বিয়ারে চাপা পড়ে গেছে সেটা। যেমন হয়তো ব্যাটিংয়ে চাপা পড়ে তার বোলিং রেকর্ড। চাপা পড়ে ড্রেসিংরুমের অসাধারণ এক চরিত্র। অসাধারণ পরিশ্রমী এক মানুষ। 

    গুগলে হয়তো সরাসরি তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে দুই-চারটা বাড়তি শব্দ তাকে সামনে হাজির করে। ইউটিউবে তার অনেক অনেক ব্যাটিং ক্লিপিংসের আশে পাশে ‘সাজেশন’ সেকশনে পাওয়া যায় তার বোলিং।