আমার 'গানার'বেলা
পোস্টটি ২৫০২ বার পঠিত হয়েছে‘৯৮ বিশ্বকাপ, কোয়ার্টার ফাইনাল। টিভির সামনে বসে আঙ্গুল কামড়াচ্ছি, কারণ নখের বংশ নির্ব্বংশ করে দিয়েছি আরো আগেই। ৯০ মিনিট হয়ে এল বলে, এখনো টিভির বেরসিক পর্দায় স্কোর দেখাচ্ছে ১-১। ক্যাটকেটে কমলা জার্সি পরণের খেলোয়াড়রা কি খায় কে জানে, ১টা মানুষ কম নিয়েও ব্যাটারা এখনো আমার ছোটবেলার ‘ম্যান ক্রাশ’ বাতিস্তুতাকে আটকে রেখেছে কিভাবে তখনো বুঝে উঠতে পারছি না। এমন না যে ফুটবল খুব বুঝি কিন্তু যেখানে গোটা বাসার বাপ-চাচা-মামারা সব ব্রাজিলের সমর্থক আর একটু পরপর আর্জেন্টিনাকে দুয়োধ্বনি দিচ্ছে সেই তুমুল বৈরী পরিবেশে উপরে ঈশ্বর আর নিচে বাতিগোল ছাড়া কেউ যে আমার মান ইজ্জত বাঁচাতে পারবে না তা স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম ঐ বয়সেও। ওই যা! এর মাঝে আবার ওর্তেগা লাল কার্ড খেয়ে গেল, চারপাশে হাসি ঠাট্টার কলরোল। হাতে মুখ গুঁজে খেলা দেখছি, টাইব্রেকারে ম্যাচ গড়ালে খবরই আছে। এইতো গতকালই ইতালি-ফ্রান্সের ম্যাচটা টাইব্রেকারে গেল, কোন দলকে সমর্থনও করি না তবুও মাঠের শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা যেন তখনি বজ্রমুষ্টি করে আমার বুকের খাঁচার ভেতরের ধুকপুকানির যন্ত্রটাকে কষে ধরে রেখেছিল। আজ যদি আর্জেন্টিনার খেলাটাও টাইব্রেকারে গড়ায়, নির্ঘাৎ শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে খাটিয়ায় করে আমাকে নিয়ে যেতে হবে । ঘড়ির কাঁটা ৯০ মিনিট ছুঁয়েছে, কমলা জার্সির খেলোয়াড়রা দুলকি চালে বল খেলাচ্ছে নিজেদের অর্ধে। হঠাৎ নিজের হাফ থেকেই এক বেকুব বেমক্কা একটা জোরসে লাথি মারল বলে, ব্যাটার পায়ে জোর আছে, বল মনে হচ্ছে ঐপারের গোললাইন পার হয়ে যাবে। কই নাতো, বল মোটে ঐ প্রান্তের ডি- বক্সের ডান কোণায় গিয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। ওমা ওখানে দেখি আরেক কমলা জার্সি ঘুরঘুর করছে বাস্তুঘুঘুর মতন, খুব যেন উড়ন্ত বলটা ধরে ফেলবে এমন ভাব। হাসতে যাব তখনি সোনালী চুলের কাঠখোট্টা চেহারার লোকটা স্বর্গের বলটা চুম্বকের মতো পায়ে লাগিয়ে মর্ত্যে নামিয়ে ফেলল। সে যাকগে, গায়ে গা লাগিয়েই আমার আকাশী সাদা এক রক্ষণ সৈনিক আছে… হুঁ হুঁ বাবা এত সোজাও নয়। ওমা পরের টাচেই সে সেন্টারব্যাককে কীভাবে যেন কোন জাদুমন্ত্রবলে গায়েব করে দিল। আরে ব্যাপার না কীপার এখনো শেয়ালের মতো ওঁত পেতে আছে, আরে শট মারবেটা কোথায়, ওই ডি-বক্সের কানা গলি থেকে তো গোলের সিকিভাগটাও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না… আমার সব ধারণা আর স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে জুয়েল আইচের ভেল্কিবাজির মতো খেল দেখিয়ে সোনালী চুলের লোকটা বুটের কানা দিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দিল। তার পায়ের তিনটা স্পর্শেই শেষ হল আর্জেন্টিনা আর ঐ ছোট্ট আমার বিশ্বকাপ। বেশ বড় একটা দাগা খেয়েছিলাম সেবার, কিন্তু এত চমৎকার গোল দেখে গালি দিতেও কেমন যেন লাগছিল। পরে খেয়াল করে দেখলাম লোকটার নাম ডেনিস বার্গক্যাম্প। সব ভুলে টুলে যেতেও বেশি সময় লাগে নি, এর মাঝে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতে নিল, ভুলে গেলাম ফুটবল।
তিন টাচের ভেলকিবাজি
প্রথম আর্সেনালের খেলা দেখি ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে, সরাসরি ছিল নাকি পুনঃপ্রচার তা এখন আর মনে নেই। তবে কানু নামের একজন অমাবশ্যা রঙা খেলোয়াড় ম্যাচের শেষ ১৫ মিনিটে হ্যাট্রিক করে ম্যাচ জিতিয়ে এনেছিল এটুকু মনে আছে। মনে থাকার কারণ ছিল, কারণ ঐ ম্যাচে আর্সেনালের পাসিং ছিল স্বপ্নের মতো। স্বপ্নের যেমন কোন ঠিকঠিকানা নাই, ঐ ম্যাচে আর্সেনালের পাসেরও কোন গ্রাম-পরিচয়-ঠিকানা বোঝা যাচ্ছিল না। এর মাঝেও কানুর শেষ গোলটা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল, আর্সেনালের প্রতি ভালবাসা তখনো আসে নি তবে প্রিমিয়ার লিগের প্রতি একটা আকর্ষণ চলেই এসেছিল তা বলাই বাহুল্য। এই আকর্ষণের কারণেই মাঝে মাঝে কিছু পড়াশোনা করার বিনিময়ে টিভি দেখবার অনুমতি মিললে খেলার চ্যানেলে চলে যেতাম, খুঁজে দেখতাম কেউ বলে লাথি মারছে কিনা। এভাবেই একদিন দেখলাম সেই বার্গক্যাম্প নামের লোকটা খেলছে লাল-সাদা জার্সি পরে। এই ম্যাচেও সে একই রকম জাদু দেখাল, পায়ের স্পর্শে ডিফেন্ডারদের হাওয়া করে দেওয়া, আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। আর্সেনালের খেলোয়াড়গুলোকে খেয়াল করে দেখা গেল অনেককেই চিনি, ১৯৯৮ বিশ্বকাপের বদৌলতে। জার্সিটাও দেখতে খারাপ না, তবে খেলোয়াড়গুলো দেখতে বড়ই বদখত, সে যাকগে আর কোন দলের কাউকে তো চিনি না। ওদিকে স্কুলে সবাই আবার হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল বা মাদ্রিদের ভক্ত - তো বলা যায় একটু ভিন্ন চিন্তাভাবনা থেকেই আর্সেনালের খেলা দেখবার সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুসমাজে তখনো ঘোষনা দেই নাই সাপোর্টের। দিলেই বা কি, তখনো সবাই ফুটবলের দিকে এতটা ঝুঁকে নাই, গুটি কয়েক পোলাপান জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে পত্র পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে দেখা কিছু নাম আওড়ায়। আমিও তাল মিলিয়ে পত্র পত্রিকায় আর্সেনালের নাম দেখা গেলে আগ্রহী হয়ে পড়া শুরু করলাম, জানলাম আর্সেন ওয়েঙ্গার নামের এক ফরাসী ভদ্রলোক নাকি আর্সেনালের খোল নলচে বদলে দিয়েছেন, অত আমি আর কি বুঝি। পরের বছরের মাঝামাঝি দেখলাম আর্সেনাল লীগে ২য় হয়েছে, খারাপ কি! যাঃ সেই এক কালান্তক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে আর্সেনালের সমর্থক হয়ে যাব। প্রথম দাবী হিসেবে বাপের কাছে(মায়ের মাধ্যমে) দরখাস্ত পাঠানো হল, জার্সি কিনে দিতে হবে। হিতে বিপরীত হল, বাপ এই আকাশ কুসুম দাবী শুনে আকাশ থেকেই পড়ল এবং আমার টেলিভিশনের সাথে ডেটিং টাইম অর্ধেক করে দেওয়া হল।প্রথমবারের মতো আর্সেনাল সমর্থক হিসেবে ত্যাগ স্বীকার করলাম।
আর্সেনাল সমর্থক হিসেবে আমার প্রথম মৌসুমে আমার ‘সুন্দর’ খেলোয়াড় দেখবার ইচ্ছে পূরণ করলেন ওয়েঙ্গার। রবার্ট পিরেস নামের এক নায়কোচিত ভদ্রলোক এসে ভিড়ে গেলেন লন্ডনে। ঐ মৌসুমে আরো একজন মনে দাগ কাটলো, ফ্রান্সের এক হ্যাংলা পাতলা থিয়েরি অরি নামের যুবক। ছেলেটা দেখলাম প্রচুরই গোল করে! নজরে আসতে থাকল রাগী চেহারার ফ্রেডি লিউংবার্গ, দানবীয় প্যাট্রিক ভিয়েরা আর সল ক্যাম্পবেল, বুড়ো টনি এডামস, রে পার্লার, উইং এর বিদ্যুৎ গতির অ্যাশলি কোল। সেবারো আর্সেনাল দ্বিতীয় হল, ইউনাইটেডের পেছনে থেকে। স্কুলে লাল সমর্থকেদেরতো পোয়া বারো, আমি একাই আর্সেনাল সমর্থক মুখ কাঁচ্যমাচু করে বসে থাকি আর বিভিন্ন শ্লীল অশ্লীল মন্তব্য শুনি।
'সুদর্শন' পিরেসের আগমন
ট্রফি জেতা হল অবশ্য পরের মৌসুমে, কিন্তু ততদিনে আগের স্কুল ছেড়ে নতুন জায়গায় আমি। ইউনাইটেডের শালার ব্যাটাদের জবাবটা দেওয়া হল না। এবার সবই হল - লিগও জিতল, এফএ কাপ বলে আরেকটা কি যেনও জিতে নিল আবার অরি ছোকরাটা প্রচুর প্রচুর গোল করে সেরা গোলস্কোরারও হল। কিন্তু ঝামেলা হল নতুন স্কুলের নতুন বন্ধুবান্ধবদের খেলাটেলা দেখবার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ নেই। বলে কয়ে কয়েকজনকে খেলা দেখানো শুরু করালাম, স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে আর্সেনাল ছাড়া অন্যান্য দল সাপোর্ট করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছিল, প্রতিপক্ষ না থাকলে খেলা দেখে মজাটা কি বলুন? বুদ্ধিটা ভাল ছিল, কারন আশেপাশে নব্য লিভারপুল, ইউনাইটেড সাপোর্টাররা গড়ে পিটে নিয়ে জোশে নিয়ে আসতে আসতেই চলে এল ২০০৩-’০৪ মৌসুম। বর্তমানের যেসকল আর্সেনাল সমর্থক একজন গানার হিসেবে এই আর্সেনালের খেলা দেখেনি তাঁদের জন্য কেবল আমার করুণা। এর আগের মৌসুমেই ইউনাইটেড আবার শিরোপা কেড়ে নিয়েছে, আমার তৈরী করা নব্য লাল সমর্থকেদের ব্যাপক আনন্দ এবং আত্মম্ভরীতা। যে জায়গাতেই যাই সেখানকার ইউনাইটেড সমর্থকেরা এরকম কেন কেবল উপরে ঈশ্বর আর নীচে স্যার ফার্গিই জানেন! সে যাকগে সকলের মুখে চুনকালি দিয়ে আমি দেখতে থাকলাম গানারদের বিজয় রথ। পরের বছর এসএসসি পরীক্ষা, বাসায় ভীষণ কড়াকড়ি। বাপের রক্তচক্ষু আর শক্ত হাতের পরোয়া না করে আর্সেনালের খেলা নিয়ে মজে থাকলাম গোটা বছর। আর্সেনাল দলটি ৫০০০ মাইল দূরে বসে থাকা এই ভক্তটির মনের টান নিশ্চয়ই টের পেয়েছিল, নয়তো কীভাবে তারা কোন ম্যাচ না হেরে বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করল আপনারাই বলুন? অঁরি ওবার ৩০টি গোল দাগলেন গুণে গুণে।আর টেস্ট পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার বিনিময়ে দজ্জাল বাপ করুণার ভাবমূর্তি হয়ে কিনে দিলেন প্রথম আর্সেনালের জার্সি। আসলে আর্সেনালের জার্সি ছিল না, দেখতে খানিকটা ওরকম, বাপ নানা ভুজুং দিয়ে গছিয়ে দিয়েছে, তাও আমি খুশি।
অজেয় আর্সেনালঃ ২০০৩-'০৪
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পা রাখি তখন আর্সেনাল পড়তির দিকে। সুন্দর ফুটবলের গর্বটাই আছে কিন্তু পেটে ভাত বা বগলে ট্রফি কোনটাই নেই। এর মাঝে আবার আমার প্রথম স্কুলের যন্ত্রনাদায়ী ইউনাইটেড সাপোর্টাররা আবার ফিরে এসেছে জীবনে, এদের একটা আবার আমার রুমমেট। যাহোক পরের ইতিহাস কেবলি দীর্ঘশ্বাস, মাথা চাপড়ানো আর চুল ছেঁড়ার। চোখের সামনে ওয়েঙ্গার ব্যাটা বুড়ো হয়ে গেল কিন্তু আর উল্লাস করার সুযোগ এনে দিল না। আগে অঁরি, বার্গক্যাম্পদের খেলা দেখতাম এখন দেখি জিরু, ওয়েলবেকদের। খুব একটা আশা করি না এখন আর। অনেকদিন হল, এখন ভাবটা বুঝে গিয়েছি। এই কয়েকবছর আগেও যখন আর্সেনাল বড়দিনের আগে আগে শীর্ষে চলে যেত তখন মাটিতে পা পড়তো না আর ঐ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো মৌসুমের শেষে অন্যান্য সাপোর্টারদের জুতোর তলা দেখেই। এখন মৌসুমের শুরুতেও চুপচাপ থাকি, আর্সেনাল নতুন কাউকে খরিদ করলেও(যদি করে আর কি!) রা কাড়ি না, এফএ কাপটাপ কালেভদ্রে জিতে গেলেও নির্বিকার থাকার চেষ্টা করি। এখন আর "ওয়েঙ্গার আউট" রব তুলি না আবার "ইন ওয়েঙ্গার উই ট্রাস্ট" বলে চেঁচামেচিও করি না। আমি এখন ভদ্র গানার।
আর হ্যাঁ, এখন আমি লিভারপুলের ভক্তকুলের দুঃখ বুঝি!
- 0 মন্তব্য