ক্যাপ্টেন থেকে কমান্ডার, বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বযুদ্ধে
পোস্টটি ৪২০৩ বার পঠিত হয়েছে২৬ ডিসেম্বর, বক্সিং ডে, ১৯৪৪
মন্টরুজ দুর্গ, প্যারিস
ক্রিসমাসের পরদিন, বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। রাজনৈতিক আবহাওয়াও বেশ অনুকুলেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ফ্রান্স এখন স্বাধীন। মন্টরুজ দূর্গের কোর্টইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে এত শান্তির মাঝেও ফ্রেঞ্চ কমান্ডার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইদানিং প্রায় প্রতি সকাল বেলাতেই তার একটা করে ফায়ারিং স্কোয়াড ডিউটি থাকছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া অভাগাদের ফাইল একটু করে নেড়েচেড়ে দেখা কমান্ডারের একটা অভ্যাস, তবে আজ দেখার প্রয়োজন পড়ল না। কারণ আজকের অভাগা বেশ হোমরাচোমড়া নাৎসী,বাহিনীর অফিসার, একেবারে গেস্টাপো বাহিনীর।
ছেলেটা আফ্রিকান অভিবাসী, গেস্টাপোদের মাঝে যা খুবই বিরল। নাৎসি মহলে তার ডাকনাম "এসএস মুহাম্মদ"। 'ছেলে' বলা যাচ্ছে কারণ বয়স মাত্র ৩৯। এর মাঝেই তার কুকীর্তির লিস্ট দিয়ে একটা খাতা ভরে গেছে। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমান্ডার এগিয়ে গেলেন। ছেলেটার চোখ, হাত ঠিকভাবে বাঁধা হয়েছে কিনা পরখ করে আবার নিজ জায়গায় ফিরে এলেন। ছেলেটার গায়ে নাৎসী ইউনিফর্ম, বাহুতে 'এসএস' লেখা আর্মব্যান্ড। ভদ্রভাবে গলাটা সাফ করে নিয়ে রাইফেল ধরা সারিবদ্ধ ফ্রেঞ্চ সৈনিকদের উদ্দেশে আদেশ হাঁকালেন,
"প্রেজেন্তে আর্ম! অঁ জু! ফিউ!" (Ready! Aim! Fire!
এটাই ছিল আলেক্সান্ডার ভিলাপ্লাঁর জীবনের শেষ দিন।
বক্সিং ডে'র ৬ মাস পূর্বে
মুসিডান, ফ্রান্স
কিছুদিন আগে উত্তর ফ্রান্সের এক গ্রামে নাৎসী বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ - সব মিলিয়ে ৬৪২ জন মানুষ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে আছে গণকবরে। মুসিডান গ্রামের দায়িত্বে ছিল গেস্টাপো লেফটেন্যান্ট আলেক্সান্ডার ভিলাপ্লাঁ। অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকতে চাইল না সে, গ্রামের ৫২ জনকে নিয়ে গেল ফায়ারিং স্কোয়াডে।
বক্সিং ডে'র ১ বছর পূর্বে
মুসিডান, ফ্রান্স
মুসিডান গ্রামে টহল দিচ্ছে গেস্টাপোর লেফটেন্যান্ট ভিলাপ্লাঁ। আগেরমত তাকে এখন এতটা ভয় পায় না গ্রামবাসী। তারা জানে নরম্যান্ডিতে এর মাঝেই আমেরিকান সেনারা অবতরণ করছে, জার্মানরা পিছু হটছে প্রতিনিয়ত। যাকেই সামনে পাচ্ছে তার কাছেই ভিলাপ্লাঁ হাহুতাশ করছে,"কী দিনকাল এল দেখেছ। একজন ফ্রেঞ্চ হয়েও আমাকে জার্মান বর্বরদের ইউনিফর্ম গায়ে চরাতে হচ্ছে। ওরা আমাকে বাধ্য করছে খারাপ কাজ করতে।" কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছিল না, ভিলাপ্লাঁ একজন গ্রামবাসীকে পাকড়াও করল,"এই যে তুমি, তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও না? আমি তোমাকে বাঁচাব। আমি গত এক সপ্তাহে ৫৪ জনকে রক্ষা করেছি। তুমি হবে ৫৫তম ব্যক্তি।"
"তবে আমাকে রক্ষা করুন কমান্ডার।" ভয়ে ভয়ে গ্রামবাসী উত্তর দিল।
"৪ লাখ ফ্রাঁ, তোমার জীবনের দাম।"
বক্সিং ডে'র দেড় বছর পূর্বে
মুসিডান, ফ্রান্স
ফ্রান্সের উত্তর প্রদেশের মুসিডান গ্রাম দখল করে সেখান থেকে ফ্রেঞ্চ রেজিস্টেন্সের নেতা ইভান 'ইভিকা' বেক'কে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গেস্টাপো ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট ভিলাপ্লাঁকে। এত কম বয়সেই এমন গুরুদায়িত্ব ভিলাপ্লাঁকে কেন সঁপে দেওয়া হল তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই কারণ ইভিকাকে সবচেয়ে ভালভাবে জানে ভিলাপ্লাঁ। এই ইভিকা, ১৯৩০ এর প্রথম বিশ্ব ফুটবলের আসরে ইয়ুগোস্লাভিয়ার হয়ে তিনটি গোল করেছিল। এর আগেই ফ্রেঞ্চ ক্লাব সিতে'তে এই সেন্টার ফরোয়ার্ড ৪ বছর খেলেছে ভিলাপ্লাঁর সাথে, তার নাড়ি নক্ষত্র সব জানা আছে ভিলাপ্লাঁর।।ইভিকার খোঁজ মেলেনি তবে গ্রামের ১১ জন কিশোরকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে, সবাই ফ্রেঞ্চ রেজিস্টেন্সের সাথে জড়িত। ইভিকার ব্যাপারে সবার মুখে কুলুপ আঁটা। ভিলাপ্লাঁর অঙ্গুলিহেলনে ১১ জন কিশোরের গুলিবিদ্ধ লাশ জমা পড়ল তাদেরই খোঁড়া কবরে। তাদের মা-বাবাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দিয়ে চুরুট ধরিয়ে ভিলাপ্লাঁ ভাবতে লাগল কোথায় পাওয়া যেতে পারে তার পুরনো বন্ধুকে।
বক্সিং ডে'র ২ বছর পূর্বে
গেস্টাপো হেডকোয়ার্টার, লরিস্টন রোড, প্যারিস
ফ্রান্সের গেস্টাপো চীফ পিয়েরে বনি তার প্যারিসের অফিসে বসে কাগজপত্র ঘাঁটছিল। তার সামনে তার সাগরেদ হেনরি লাফন্ট। লাফন্ট লোকটাকে ভাল চোখে দেখে না পিয়েরে বনি, একসময় ছিঁচকে চোর ছিল লাফন্ট। বিশ্বযুদ্ধের গোলমালে চোরাকারবারি করে আর জার্মান অফিসারদের সাথে খাতির জমিয়ে ফ্রান্সের গেস্টাপো অফিসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে লাফন্ট। ফ্রেঞ্চ পুলিশের চীফ ছিল পিয়েরে বনি, এখন গেস্টাপোর চীফ - তবুও চোর-ডাকাতের ব্যাপারে তার মনোভাব খুব একটা পাল্টিয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে লাফন্টের সুপারিশেই প্যারিসের চোর-ছ্যাচ্চড়দের একটা বড় অংশ যোগ দিয়েছে গেস্টাপোতে। ব্যাপারতা মনপুতঃ না হলেও বনিকে স্বীকার করতেই হবে, শয়তান ইহুদী আর ফ্রেঞ্চ রেজিস্টেন্সের সৈন্যদের খুঁজে বের করবার ব্যাপারে এই ছিঁচকে চোরদের ব্রিগেড রেগুলার পুলিশের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী। লাফন্ট আবার একটা সুপারিশ নিয়ে এসেছে আজ তার কাছে, এক ফ্রেঞ্চ ছেলে আলেক্সান্ডার ভিলাপ্লাঁ না কী যেন নাম, সোনা চোরাচালান করতে গিয়ে বন্দরে ধরা পড়েছে গেস্টাপোর কাছে। লাফন্ট জানাল, ভিলাপ্লাঁ ছেলেটা বেশ কয়েকবছর ধরেই চোরাচালানের লাইনের সাথে যুক্ত, অনেক লাইন-ঘাট জানা আছে ছেলেটার, কাজে আসবে গেস্টাপোর। ছেলেটার ছবি দেখে ভ্রঁউ কুঁচকে গেল বনির, চেনা চেনা লাগছে কেন জানি। লাফন্ট সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হেসে ভিলাপ্লাঁর ফাইল এগিয়ে দিল বনির কাছে। এবার বনি বুঝতে পারলেন কেন চেনা চেনা লাগছে ছেলেটাকে। হাজার হলেও অনেক প্যারিসিয়ানের মতো তিনিও ফুটবলপ্রেমী। ভিলাপ্লাঁকে নিজের ব্যক্তিগত শোফার হিসেবে নিযুক্ত করলেন বনি।
বক্সিং ডে'র ১২ বছর পূর্বে
বোর্দো, ফ্রান্স
হিস্পানো-বাস্তিদিয়েন ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজার গিবসন তাঁর অফিসে বসে আছেন, তাঁর সামনে তাঁর পুরনো শিষ্য আলেক্সান্ডার ভিলাপ্লাঁ। অনেক ঘাটের জল খেয়ে পুরনো এই শিষ্য আবার তার কাছে এসে ভিড়েছে। এমন ছোট একটা ক্লাব যেখানে কারোই কোন বিষয়ে মাথাব্যথা থাকার কথা না, সেখানে ট্রেনিংএ ভিলাপ্লাঁর আচরণ আর অনুপস্থিতি নিয়ে নিয়মিত অভিযোগ আসছে। এ নিয়ে শুরুতে মৃদুভাবে কিছু কথা তুললেন গিবসন, কিন্তু ভিলাপ্লাঁ তেতে উঠল রাগে।
"আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারেন না। কিছুদিন আগেও আমি নিস এর মত ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলাম।"
"হ্যাঁ, আর নিস এখন রেলিগেটেড, সবাই তোমার দিকেই আঙুল তুলেছে এবং সে কারণেই তোমাকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া হয়েছে ওখান থেকে।" গিবসন শান্তভাবে জবাব দিলেন।
"আপনি ভুলে যাচ্ছেন এর আগেই আমি এন্টিবিসকে ফ্রেঞ্চ লিগ জিতিয়েছি। লিলে'র সাথে ঐ ফাইনালে- " রাগে মুখ বিকৃত করে কিছু বলার চেষ্টা করল ভিলাপ্লাঁ।
"আমি কচি খোকা নই আলেক্স। ম্যাচ পাতানোর ব্যাপারটায় লিলে'র ম্যানেজারের আজীবন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছে ফ্রেঞ্চ ফেডারেশন। কিন্তু সব কলকাঠি যে তুমিই নেড়েছে এটা সবাই জানে। কোন প্রমাণ নেই বলে তুমি এই যাত্রা বেঁচে গেছ।" গিবসন একইভাবে জবাব দিলেন।
"এসব ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই, আমি চললাম।" ভিলাপ্লাঁ প্রায় চেয়ারে লাথি মেরে উঠে দাঁড়াল।
"কোথায় যাচ্ছ, আজ বিকেলে ট্রেনিং আছে তোমার।"
"যাচ্ছি রেসকোর্সে, ওখানে আমার আয়ও আপনার এই ভাঙাচোরা ক্লাব থেকে বেশি আর মজাও।" ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল ভিলাপ্লাঁ।
বক্সিং ডে'র ১৪ বছর পূর্বে
১৩ জুলাই ১৯৩০
মন্টেভিডিও, উরুগুয়ে
প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে আজ। বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। রাজনৈতিক আবহাওয়াও বেশ অনুকূলে, উরুগুয়ের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তি হচ্ছে এই বছর। এস্তাদিও পসিতোসের শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় বসেও বিবিসির রেডিও ধারাভাষ্যকার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন থেকে প্রতি দিনই প্রচুর পড়াশোনা আর বকবকানি চালু রাখতে হবে বেশ কিছুদিন। প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ, ফ্রান্স বনাম মেক্সিকো। দুই দলই মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সের একটা ছেলেকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। ছেলেটা ইভিকা বেকের সাথে সিতে'তে খেলত না? হ্যাঁ, গত ক্রিসমাসে লন্ডনে সিতে'র ম্যানেজার ভিক্টর গিবসন তো এর প্রশংসাতেই পঞ্চমুখ ছিল।
ছেলেটা আফ্রিকান অভিবাসী, ফ্রেঞ্চ ফুটবলে তখনো বেশ বিরল। ফ্রেঞ্চ ফুটবলে তার ডাকনাম "মেশা মেক"। ছেলে বলা যাচ্ছে কারণ তার বয়স মাত্র ২১। এর মাঝেই তাকে নিয়ে যতগুলো ক্লাব টানাটানি করছে তার লিস্টি করলে খাতা ভরে যাবে। ফ্রান্সের লা ব্লুজ - নীল জার্সি তার পরণে, বাহুতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড। ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন সে, প্রথম আফ্রিকান বংশদ্ভূত ক্যাপ্টেনও। ভদ্রভাবে গলাটা সাফ করে, লাল বাতি জ্বলার অপেক্ষা করলেন ধারাভাষ্যকার, তারপর শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
"গ্রিটিংস লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান। ওয়েলকাম টু দ্য ফার্স্ট এভার ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ… "
এটাই ছিল আলেক্সান্ডার ভিলাপ্লাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।
- 0 মন্তব্য