• অন্যান্য

আল্ট্রাস সারদের ফেরা...

পোস্টটি ৪৭৫৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ultrassur88 

‘মাদ্রিদ সমর্থক? ওরা তো নিজেদের খেলোয়াড়দের নিজেরাই নিজ মাঠে ভর্ৎসনা করে। এমনকি ক্যাসিয়াস, রামোস, রোনালদোকেও ছাড়েনি। এত বড় একটা ক্লাব অথচ ফ্যানবেজটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট মানের’। মাদ্রিদ সমর্থকদের সম্পর্কে ফুটবলবিশ্বের অধিকাংশ অনুরাগীর চিন্তাভাবনাটা অনেকটা এরকমই। মাদ্রিদ সমর্থকেরাও যে এই অপবাদগুলো অস্বীকার করতে পারবে, সেই জো নেই। কারণ গত ৩-৪ মৌসুম ধরে দল এক ম্যাচ খারাপ খেললেই তাদেরকে নিজ সমর্থকেরাই রীতিমত ধুয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে নিজ মাঠেই অথচ যেখানে তাদের উচিত ছিল খারাপ সময়েও দলকে উৎসাহ জাগানো। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রতিকূল মাঠ। অনেকের মতে, সেসময়ের বার্নাব্যু ডর্টমুন্ডের ঘরের মাঠ সিগনাল ইদুনাকেও হার মানাতে পারতো। এর পেছনের মূল কারিগর ছিল রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে আবেগী ও সবচেয়ে বিতর্কিত সমর্থকগোষ্ঠী ‘আল্ট্রাস সার’। দীর্ঘদিন নিজ মাঠে নিষিদ্ধ থাকার পর যারা আবারো ফিরে আসছে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে।

 

আল্ট্রাস সার বা ‘দক্ষিণের চরম্পন্থীরা’ মূলত নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী বা জাতির না। মাদ্রিদ শহরে বসবাসরত মজুর থেকে শুরু করে উকিল, ব্যাবসায়ী- সবাই-ই ছিলেন এর মধ্যে। ১৯৮০ সালে অ্যান্তোনিও দিয়ারিওর মাথায়ই সর্বপ্রথম এমন একটি দল গড়ে তোলার চিন্তা আসে। যে ভাবা সে-ই কাজ, শুরুর দিকে নিজ বন্ধুরা যারা মাদ্রিদ সমর্থক ছিলেন, তাদের নিয়েই মাঠে গিয়ে প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটাতেন তারা। তাদের দর্শন ছিল সহজ; যদি রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক হও, অবস্থা যতই বেগতিক হোক, সমর্থনে যেন কখনোই টানা না পড়ে। সমর্থন হতে হবে একেবারে খাঁটি এবং হৃদয় থেকে আসা। সংখ্যায় কম হলেও মাঠে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও একত্রিত চ্যান্টিং, মাঠে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলা, আতশবাজি ইত্যাদি দিয়ে অচিরেই মাদ্রিদের অন্য সমর্থকদের মন কাড়েন তারা। সাধারণ সমর্থকেরাও একে একে আল্ট্রাসে যোগ দিতে থাকেন।

 

কিন্তু অন্য দলের সমর্থকদের সাথে তাদের প্রায়ই হাতাহাতি থেকে মারাত্মক সংঘর্ষ হওয়ায় আর ওইসময় মাদ্রিদের ‘সরকারের দল’ তকমা থাকার ফলে সংবাদমাধ্যম মাদ্রিদ এবং আল্ট্রাস সারদের বিপক্ষেই লিখতো বেশীরভাগ সময়। তবে বরাবরই আল্ট্রাসদের অভিযোগ ছিল, মিডিয়া তাদেরকে একঘরে করে ফেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধের সব ঘটনাকেই অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করতো। অবশ্য আল্ট্রাসরা যে একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা ছিল, এমন না। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বিপক্ষ দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য করে ‘বানর, বানর!’ বলে চিৎকার করা, জার্মান নাৎসি স্যালুট দেওয়া সহ আরো অনেক কাজকর্মের মাধ্যমে ক্লাবের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন তারা।

 

৮২-৮৩ মৌসুমে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে হারের পর ভ্যালেন্সিয়ার বাসে পাথর মারা, খেলোয়াড়দের দিকে রঞ্জন রশ্মি নিক্ষেপণ এবং ৮৪-৮৫ ও ৮৫-৮৬ মৌসুমে ইন্টার মিলান সমর্থকদের সাথে মাঠের বাইরে তুমুল সংঘর্ষ তাদের ইতিহাসের অন্যতম ন্যাক্কারজনক কাহিনী। ৮৬-৮৭ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স কাপের ম্যাচ চলাকালীন সময় বার্নাব্যুতে থাকা বায়ার্ন সমর্থকদের সাথে মারামারি ও বোমা ছুড়ে মারার কাহিনী দিয়েই মূলত বিশ্ব ফুটবল মিডিয়ার চক্ষুশূলে পরিণত হন তারা। অন্যান্য সমর্থকগোষ্ঠীর থেকে তাদের সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হত অ্যাতলেতিকোর সমর্থকদের দল ‘ফ্রেন্তে অ্যাতলেতিকো’ এবং বার্সার ‘বাইক্সো নোয়া’র সাথে। নব্বই দশকের পুরোটাই কেটেছে হানাহানি, গ্রেফতার, সরকারের সাথে ঝামেলায়। ১৯৮৮ সালে গিজনে ম্যাচ দেখতে যাওয়ার পর সেখানকার গিজন সমর্থকদের সাথে রীতিমত দাঙ্গা লেগে যায় তাদের। দাঙ্গার একপর্যায়ে স্প্যানিশ পতাকাকে অসম্মান করার পর থেকেই সমগ্র স্পেনের রোষানলে পড়েন তারা। অতঃপর ১৯৯৩ সালে প্রিয়ামো ভায়ালোঙ্গা স্প্যানিশ চ্যানেল ওন্দা সেরোতে আল্ট্রাসদের টি-শার্ট পড়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিচয় তুলে ধরেন ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ এবং ‘অ্যান্টি মাদ্রিদ’ সমর্থকদের বিপক্ষে।

 

আল্ট্রাস সাররা যে শুধু বিপক্ষের খেলোয়াড়, সমর্থকদের অপদস্ত করতো, এমন নয়। নব্বইয়ের দশকে মাদ্রিদের কেনা কৃষ্ণনাঙ্গ খেলোয়াড়দেরকেও অপমান করেছে তারা। রবার্তো কার্লোস, সিডর্ফরা মাদ্রিদে এসেই এধরণের অপমানের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি ফর্ম খারাপ গেলেও নিজ খেলোয়াড়দেরকে হুমকি দেওয়ার কথা নিজ মুখে স্বীকার করেছেন আল্ট্রাসের নেতারা। মাদ্রিদের মিডিয়া, নিজ সমর্থকদের থেকে আল্ট্রাসদের নিষিদ্ধ করার অসংখ্য দাবি আসলেও মাদ্রিদ বোর্ড তাদের নিষিদ্ধ করার চিন্তা করেনি। আল্ট্রাসদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও তাদের নিষিদ্ধ না করার মূল কারণ ছিল, আল্ট্রাস সারের সদস্যরা মাঠে দলকে যেভাবে সমর্থন ও আশা-উদ্দীপনা দিতে পারতো, তা মাদ্রিদের আর কোনো সমর্থকগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে সময় পুসকাস, ডি স্টেফানো বলেছিলেন, ‘আল্ট্রাসরা মাদ্রিদেরই অংশ। তাদের নিষিদ্ধ করলে মাদ্রিদের এই গর্ব করার মত সমর্থন মাঠে মারা যাবে’। আল্ট্রাসরা আসলে কট্টর মাদ্রিদ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু অন্য দলের সমর্থকরা তাদের দলের বিপক্ষে কিছু বললেই তাদের পাল্টা আক্রমণের মূল অস্ত্রই ছিল সহিংসতা। ৯২-৯৩ সালে তাদেরকে আজীবন নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র মাদ্রিদ শহর। কিন্তু দলের তারকা খেলোয়াড় জামরানো ও রোচাদের সমর্থন এবং মাঠের পরিবেশের অবস্থা চিন্তা করে এবারও তাদের ছেড়ে দেয় মাদ্রিদ বোর্ড।

 

এসব বাহ্যিক চাপ আল্ট্রাস সারদের কখনোই বিচলিত করতে পারেনি। তৎকালীন নেতা হোসে লুই ওচেইতাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পরেও ভারপ্রাপ্ত নেতা প্রিয়ামো ভিয়ালোঙ্গার অধীনে তাদের কাজকর্ম অব্যাহত থাকে। মাদ্রিদের যেকোন হোম ম্যাচের পরিবেশ ছিল শিহরণ জাগানীয়। টিফো, ড্রাম বাজানো, সমগ্র স্টেডিয়াম ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তোলা, আতশবাজি ফুটানো ছিল ম্যাচ দেখতে আসার আগেও ম্যাচের সময় তাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু মাদ্রিদ বোর্ডের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে ১৯৯৮ সালে ডর্টমুন্ডের সাথে যখন আল্ট্রাসদের সংঘর্ষ হয়। ম্যাচ শুরু হয় আসল সময়ের ৭৫ মিনিট পর। এরপর থেকেই মূলত মাদ্রিদ বোর্ড ও আল্ট্রাসদের মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু করে।

 

নিজেদের প্রিয় ক্লাবের প্রতি এরকম শর্তহীন সমর্থন দেওয়ার পরেও নিজ সমর্থকদের কাছ থেকেই দুয়ো পাওয়ায় আল্ট্রাসদের কেউই ঐ ঘটনার পরের কিছু সময় মাঠে যাননি। এরপর থেকে তাদের কিছু সংখ্যক সদস্য গেলেও তারা সাধারণ সমর্থকদের সাথেই থাকতেন, নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করা আলাদা প্রান্তে নয়। আল্ট্রাসদের অনুপস্থিতি কিছুদিন পর থেকেই টের পেতে থাকে মাদ্রিদ। মাত্র সেদিনের জীবন্ত বার্নাব্যুকে কেন যেন চির অচেনা এক মৃত্যুপুরী মনে হতে থাকে আগের মত চিৎকার চেঁচামেচি না থাকায়। এরপর ধীরে ধীরে আল্ট্রাসরা মাঠে গেলেও কখনোই আল্ট্রাস সারকে একত্রে দেখা যায়নি। পুরো মাঠেই বিক্ষিপ্ত ভাবে বিরাজমান ছিলেন তারা। হোসে মরিনহো মাদ্রিদের কোচ থাকাকালীন সময় ব্যাক্তিগত ভাবে আল্ট্রাস সারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন তাদের মাঠে আসার জন্য-এমনটিও শোনা গিয়ছিল স্প্যানিশ মিডিয়া থেকে তখন। অনেক ফুটবলবোদ্ধাই মনে করেন, বর্তমান মাদ্রিদ সমর্থকদের এই ‘প্রতারণামূলক’ মনোভাব আল্ট্রাস সার মাঠে থাকলে কখনোই হত না। কারন, আল্ট্রাসরা আর যা-ই করুক, কখনোই নিজ দলের ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়নি বরং খারাপ সময়ে সর্বদা সমর্থন দিয়ে গিয়েছে। অল্পদিনেই মাদ্রিদের প্রধান সমর্থকগোষ্ঠী হয়ে যাওয়ার পেছনে এটা ছিল অন্যতম বড় কারণ।

 

উলফসবার্গের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগ হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় লেগের আগে হঠাৎ করেই দীর্ঘ দশ বছর পর আল্ট্রাসদের স্টেডিয়াম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন পেরেজ। এর ফলে এখন আর বার্নাব্যুতে আসা নিয়ে কোন বাধাই থাকলো না তাদের। আল্ট্রাস সার কি পারবে তাদের জগদ্বিখ্যাত সমর্থন দিয়ে রিয়ালকে উদ্দীপ্ত করতে? উত্তরটা বুধবার মধ্যরাতেই পাওয়া যাবে। কিন্তু রিয়াল সমর্থকদের পাশাপাশি ফুটবলের জন্যও আল্ট্রাসদের ফিরে আসা এক বিস্ময়কর আনন্দের বিষয় বটে।

 

সময় মানুষকে বদলায়। সময় কি আল্ট্রাস সারকে বদলাতে পেরেছে? তারা কি এখনো আগের মতই সহিংস থাকবে নাকি নিজেদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে বুদ্ধিদীপ্ত অহিংস সমর্থকের মত সমর্থন জানাবে? আল্ট্রাস নিয়ে ফুটবল সমর্থকদের মাথায় ঘুরতে থাকা অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারবে।