• ফুটবল

হান্স-ডিয়েটর ফ্লিক: দ্য আনসাং হিরো অফ বাভারিয়া

পোস্টটি ১৯৭১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বার্সেলোনা-বায়ার্ন মিউনিখের মধ্যকার অদ্ভুতুড়ে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ শেষ হয়েছে প্রায় ১৭-১৮ ঘণ্টা আগে। প্রায় পুরোটা সময়ই বায়ার্নের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স চাপা পড়ে গেছে বার্সাকে নিয়ে ট্রল-মিম, ঠাট্টা-বিদ্রূপের নিচেই। গতকালের দুর্দান্ত ফলাফলের পর চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল দাবিদার ধরা হচ্ছে বায়ার্নকেই। বাহবা পাচ্ছেন রবার্ট লেভানডফস্কি, থমাস মুলার, ফিলিপ কুতিনিয়োরা। কিন্তু পাদপ্রদীপের আলো নেই একজনের ওপর, যার দুর্ধর্ষ ট্যাকটিক্সে রীতিমত খোলনলচে বদলে গেছে বাভারিয়ানরা। যার অধীনে ধুঁকতে থাকা বায়ার্ন ফিরে পেয়েছে চিরাচরিত দুর্ধর্ষ রূপ। মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানে ভঙ্গুর এক দলকে যিনি নিয়ে গেছেন নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় ট্রেবলের সামনে। মানুষটা আর কেউ নন, তিনি বায়ার্নের বর্তমান ম্যানেজার, হান্স-ডিয়েটর ফ্লিক।

ফ্লিকের সাথে বায়ার্নের সম্প্রীতির বন্ধনের শুরুটা আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, যখন ১৯৮৫ সালে তিনি বায়ার্নে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জার্মান ফুটবল ভক্তদের কাছে হয়তো তিনি তেমন পরিচিত নন, কিন্তু ফ্লিক নিজের পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন জার্মান ফুটবলের সাথে। সাবেক বায়ার্ন মিউনিখ ফুটবলার ২০১৪ বিশ্বকাপের সেই ৭-১ এর ম্যাচেও ছিলেন বিজয়ী ডাগআউটে, জোয়াকিম লোয়ের সহকারী হিসেবে। তখন পাদপ্রদীপের আলো দূরে থাক, তাকে হাতেগোনা মানুষও চিনতেন কি না- তা বলা মুশকিল। একটা ফ্যাক্ট বলি এখন যা অনেকেই হয়তো জানেন না। ফ্লিক শুধু ২০১৪ নয়, ২০০৬ এবং ২০১৪ বিশ্বকাপেও ছিলেন জার্মানির সহকারী ম্যানেজার, ছিলেন ২০০৮, ২০১২ ইউরোতেও। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জার্মানি জাতীয় দলের স্পোর্টিং ডিরেক্টরের পদে। 

 

 

দ্য কাম বিফোর দ্য জার্মান স্টর্ম ইন বেলো হরিজন্তে (২০১৪)

 

এই মৌসুম শুরুর আগে বায়ার্ন নিকো কোভাচকে নিজেদের নতুন কোচ নিয়োগ দেওয়ার সময় ফ্লিককেও সহকারী ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয় বায়ার্ন। কিন্তু ২০১৮-১৯ মৌসুমে ফ্রাঙ্কফুর্টকে নিয়ে চমক দেখানো কোভাচ একেবারেই থিতু হতে পারেননি আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে। টটেনহামকে ৭-২ গোলে উড়িয়ে দিলেও বুন্দেসলিগায় শীর্ষ ৪-এ থাকতেই হিমশিম খাচ্ছিল বায়ার্ন। হফেনহেইমের কাছে গত বছর নভেম্বরে ৫-১ গোলে হারের পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় বায়ার্নের হর্তাকর্তাদের। বরখাস্ত হন কোভাচ। পচেত্তিনো, আলেগ্রি, এমনকি আর্সেন ওয়েঙ্গারের নামও শোনা যাচ্ছিল বায়ার্নের নতুন ম্যানেজার হিসেবে। হুট করেই দায়িত্ব পেয়ে যান ফ্লিক।

বেশিরভাগ বড় ম্যানেজারদের যেখানে নতুন দায়িত্ব পেয়ে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে, সেখানে ফ্লিক তার সামর্থ্যের জানান দেওয়া শুরু করলেন প্রথম থেকেই। প্রথম ম্যাচে অলিম্পিয়াকোসকে হারালেন ২-০ গোলে, যা নিজেদের মাঠে বায়ার্নের জন্য ছেলেখেলা। কিন্তু ফ্লিক নিজের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের প্রমাণ দিলেন বায়ার্ন ম্যানেজার হিসেবে বুন্দেসলিগায় নিজের প্রথম ম্যাচে। ৯ নভেম্বর বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে ৪-০ গোলে দুমড়েমুচড়ে দিল ফ্লিকের দল। যে ডর্টমুন্ড প্রেসিং এবং গতিতে কাবু করে প্রতিপক্ষকে, সেই ডর্টমুন্ডকে তাদেরই বিষে কুপোকাত করলেন ফ্লিক। বায়ার্নের অসাধারণ গতি, পাসিং, প্রেসিংয়ের জবাব যেন নেই কারো কাছেই।

এরপর কেটে গেছে প্রায় মাস পাঁচেক। ফ্লিকের অধীনে বায়ার্ন সমর্থকদের মনের ঈষাণকোণে জমে থাকা মেঘের বদলে এসেছে রৌদ্যজ্জ্বল অপার সম্ভাবনা, যা কাঁপুনি যোগায় যেকোন প্রতিপক্ষের মনেই। তার অধীনে বায়ার্ন ফিরে পায় বুন্দেসলিগার শীর্ষস্থান, শেষ পর্যন্ত লিগ এবং কাপ- দুটোই জিতেছে ফ্লিকের দল। স্মিত হাসি হাসা এই জার্মানের নেতৃত্বে নিজেদের সেই ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’ ফিরে পেয়েছে বায়ার্ন, আর তাতেই মিলেছে কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে এবং বায়ার্ন বোর্ড থেকে ৪ বছরের চুক্তি। রবার্ট লেভানডফস্কি কোভাচের অধীনেও ছিলেন দুর্ধর্ষ, ফ্লিকের অধীনে যেন চলে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, পরিসংখ্যান যেন ফিফা গেমকেও হার মানায়।

 

বায়ার্নের হয়ে খেলোয়াড়ি জীবনে ফ্লিক

 

এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৪৫ ম্যাচে করেছেন ৫৪ গোল, ম্যাচ প্রতি তার গোল সংখ্যা ১.২। চ্যাম্পিয়নস লিগে এই মৌসুমে ১৪ গোল করেছেন তিনি, আর ৩ গোল করলেই ধরে ফেলবেন ইউসিএল-এ এক মৌসুমে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড (১৭, ২০১৩-১৪)। তবে ২০১৩-১৪ চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদো খেলেছিলেন ১১ ম্যাচ। করোনাভাইরাসের কারণে নতুন ফরম্যাটের চ্যাম্পিয়নস লিগে লেভানডফস্কি ১৪ গোল করেছেন মাত্র ৮ ম্যাচে। বছর তিনেক আগেও ওয়েস্ট ব্রমের বেঞ্চ গরম করা সার্জ গ্নাব্রি এই মৌসুমে গোল করেছেন ২২টি। তবে কোভাচ পরবর্তী যুগে ফ্লিকের সবচেয়ে বড় অবদান খুব সম্ভবত গোলমুখে লেভানডফস্কি নির্ভরতা কমানো। এই মৌসুমে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বা রাইটব্যাক হিসেবে খেলা জশুয়া কিমিচ গোল করেছেন ৭টি। ডিফেন্সিভ মিড হিসেবে খেলা লিওন গোরেৎস্কাও জাল খুঁজে পেয়েছেন ৮বার। পিছিয়ে নেই ফিলিপ কুতিনিয়োও।

গতরাতের বিশাল ব্যবধানের হারে বার্সা সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি যে ব্যপারটা পোড়াবে, সেটা হয়তো বায়ার্নের হয়ে বার্সা থেকেই ধারে যাওয়া কুতিনিয়োর ২ গোল, ১ অ্যাসিস্ট। গতরাতের ম্যাচের কথা যখন এসেই পড়ল, তখন থমাস ‘রমডয়টার’ মুলারের নাম নিতেই হয়। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর অনেকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন তাকে। লো তো বলেই দিয়েছেন, জার্মানিতে আর সুযোগ মিলবে না তার। সেই মুলারও জ্বলে উঠেছেন ফ্লিকের জাদুতে, এই মৌসুমে করেছেন ১৪ গোল। আবারও দেখা মিলছে ডিবক্সে বা মাঠের যেকোনো জায়গায় সুযোগসন্ধানী মুলারের, যে ভূমিকায় তার চেয়ে অনন্য হয়তো নেই আর কেউ।

পরিসংখ্যানের কথা টানলে আসলে স্পষ্ট বোঝা যায় ফ্লিক আসলে কতবড় বিপ্লব ঘটিয়েছেন বায়ার্নে। ফ্লিকের অধীনে খেলা ৩৪ ম্যাচে ১১১ গোল করেছে, হেরেছে মাত্র ২টি। বুন্দেসলিগায় তার অধীনে খেলা ২৪ ম্যাচে ৭৪ গোল করেছেন লেভানডফস্কিরা, হজম করেছেন মাত্র ১৬টি; যেখানে ফ্লিক আসার আগে কোভাচের অধীনে এই মৌসুমে লিগের প্রথম ১০ ম্যাচেই ১৬ গোল খেয়েছিলেন বোয়াটেং-আলাবারা। চ্যাম্পিয়নস লিগে ফ্লিকের বায়ার্ন আরও দুরন্ত। ৬ ম্যাচে তার অধীনে তারা গোল করেছে ২৬টি। চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে দলগতভাবে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডের দিকেও এগিয়ে আসছে ফ্লিকের দল। ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ৪৫ গোল করা বার্সেলোনার থেকে মাত্র ৬ গোল পিছিয়ে বায়ার্ন (৩৯)। তবে সেবার বার্সা খেলেছিল ১৬ ম্যাচ, আর এবার ৩৯ গোল করতে বায়ার্নের লাগল মাত্র ৯ ম্যাচ।

 

লিগ শিরোপা জয়ের পর বায়ার্নের ভালবাসায় সিক্ত ফ্লিক

 

এক মৌসুমে দলগতভাবে ম্যাচপ্রতি গোলগড়ের দিক দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসেরই সেরা ফ্লিকের বায়ার্ন (ম্যাচপ্রতি ৪.৩৩ গোল), নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ২০১৩-১৪ মৌসুমে কার্লো আনচেলত্তির ‘লা ডেসিমা’ জয়ী রিয়াল মাদ্রিদ (৩.১৫) পিছিয়ে আছে এক গোলেরও বেশি ব্যবধানে। এসব কিছুই ফ্লিককে তেমন একটা স্পর্শ করে না। সবসময়ই বলে এসেছেন; দল গোল করছে, জয়ের দেখা পাচ্ছে- সেটাই তার কাছে অনেক।

নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে এখনও নিজেকে একজন ছাত্র হিসেবেই ভাবেন- জানিয়েছেন বুন্দেসলিগার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটকে। সেই সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কেমন লাগে ব্যাপারটি যে আপনি যতই ভাল করছেন, মিডিয়া তারপরও পচেত্তিনো-আলেগ্রিদের কথা বলে যাচ্ছে?’ নিজের সেই চিরাচরিত স্মিত হাসি হেসে ফ্লিক জানান, ‘পৃথিবীতে সবাই নিজের কাজটাই করছে। তাদের লক্ষ্য সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ানো, আমার লক্ষ্য বায়ার্নকে সম্ভাব্য সব শিরোপা জেতানো। এখানে দোষের বা খারাপ লাগার কিছু নেই।’

নিজের কাজের প্রতি এই বিশ্বাস, এই কমিটমেন্টের জোরেই বাভারিয়ান হটসিটটা নিজের করে নিয়েছেন ফ্লিক। তার বায়ার্ন এখন আক্রমণের দিক দিয়ে ইউরোপের সবচেয়ে বিধ্বংসী দল। রক্ষণ কিছুটা নড়বড়ে হলেও আপনার ফরওয়ার্ড লাইন যখন গোল করাকে প্রতি ম্যাচেই ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলে, সেখানে হয়তো রক্ষণ নিয়ে চিন্তাটাও তেমন থাকার কথা না ফ্লিকের।

 

'আইজ অন দ্য প্রাইজ'

 

নভেম্বরে অস্থায়ীভাবে বায়ার্নের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গতরাতে বার্সেলোনাকে ধসিয়ে দেওয়া- এই দশ মাসে বায়ার্ন ফিরে পেয়েছে সব। সব বাহবা পাচ্ছেন লেভানডফস্কি-মুলার-গ্নাব্রিরা, পাদপ্রদীপের আলোয় আসছে কুতিনিয়ো, থিয়াগো, ডেভিস, গোরেৎস্কা সহ দলের প্রায় সবাই-ই। শুধু ডাগআউট থেকে যিনি কলকাঠি নেড়ে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নীলনকশা সাজাচ্ছেন প্রতি ম্যাচে- সেই ফ্লিককে নিয়ে উন্মাদনা নেই একেবারেই। তবে তাতে যে ফ্লিকের কিছু আসে যায় না, সেটা নিজেই জানিয়েছেন আগেই।

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন সিনেমায় মেয়েদের ওয়াশরুমে দানবটির কাছে জিম্মি  হারমায়োনি গ্রেঞ্জারকে বাঁচাতে রন উইসলি ‘উইঙ্গার্ডিয়াম লেভিওসা’ ম্যাজিক স্পেলটি ব্যবহার করেছিলেন ‘সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক’ টেকনিকের সাহায্যে। একই টেকনিকে যেন জাদুবলে বদলে দিয়েছেন ফ্লিক। ফাইনালে যাওয়ার পথে খুব সম্ভবত ম্যানচেস্টার সিটিকেই টপকাতে হবে বায়ার্নের। ২৩ আগস্টের ফাইনাল শেষে ফ্লিকের বায়ার্নের দ্বিতীয় ট্রেবলের স্বপ্ন সত্যি করতে পারবে না- এ বিষয়ে অন্তত গতরাতের পর বাজি ধরার লোকের সংখ্যা হয়তো একেবারেই কম।

হয়তো হবে সেটাই, লিসবনে ২৩ আগস্ট ট্রফি উঁচিয়ে বিজয়ের হাসি হাসবেন ফ্লিক। কিন্তু সেদিন থেকেই হয়তো আবারও পাদপ্রদীপের আড়ালে চলে যাবেন তিনি, মিডিয়া মাতবে লেভানডফস্কিদের বন্দনায়। কিন্তু ফ্লিক জানেন, তিনি যেভাবে এই দলকে বদলে দিয়েছেন, সেজন্য অন্তত বায়ার্ন সমর্থকরা তাকে ভুলবে না কোনোদিন।