ইস্তানফিল্ড
পোস্টটি ১৭৭০ বার পঠিত হয়েছে
তারিখঃ ৫ মে, ২০০৫। স্থানঃ ইস্তানবুল, তুরষ্ক। লিভারপুল বনাম এসি মিলান। অনেকের মতেই সর্বকালের সর্বসেরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। ৩-০ তে পিছিয়ে পড়ে ফাইনাল জেতা, তাও আবার মালদিনি-পিরলো-কাকা নিয়ে সাজানো দলের বিপক্ষে, আসলেও অচিন্তনীয় বিষয়টা। কথায় আছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাহলে গতকাল কি তা-ই হল? প্রায় ১১ বছর পর কি ফিরে এল ‘ইস্তানবুলের বিস্ময়’? গুরুত্ব বা জয়ের মাহাত্ম্যের বিচারে ক্লপের শিষ্যরা গতকাল যা দেখালো, তা কখনোই ইস্তানবুলের সমতুল্য হতে পারবে না কিন্তু চিরকাল বেঁচে থাকবে লিভারপুল ও ফুটবল অনুরাগীদের মনে। এ যেন অ্যানফিল্ড নয়, ইস্তানফিল্ড!
ডর্টমুন্ডের মাঠ সিগনাল ইদুনা পার্কে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র করে মূল্যবান অ্যাওয়ে গোল নিয়ে অ্যানফিল্ডে নামে লিভারপুল। কিন্তু লিভারপুলের নড়বড়ে ডিফেন্স এবং ডর্টমুন্ডের আক্রমণে রয়েস, মিখিতারইয়ান, ওবামাইয়াংদের উপস্থিতিতে প্রায় সবাই-ই অনুমান করেই রেখেছিল, ডর্টমুন্ড গোল করবেই; লিভারপুলকে সেমিতে যেতে হলে অবশ্যই কমপক্ষে আরো একবার বল জালে জড়াতে হবে। ম্যাচের আগে হিলসবোরো ট্র্যাজেডির সাতাশ বছর পূর্তিতে সেদিন প্রাণ হারানোদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
ক্লপের শিখিয়ে যাওয়া ‘হাই-টেম্পো’ ফুটবল দর্শনে দর্শিত বর্তমান ডর্টমুন্ড কোচ ও একসময়ের ক্লপের অ্যাসিস্ট্যান্ট থমাস তুকেলের শিষ্যরা শুরু থেকেই চড়াও হয় লিভারপুলের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ম্যাচের মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় লিভারপুলের ‘অ্যাওয়ে গোল অ্যাডভান্টেজ’ উড়িয়ে দলকে ম্যাচে ও টাইয়ে লিড এনে দেন মিখিতারইয়ান। এই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই ৮ মিনিটে আবারো আঘাত হানে ডর্টমুন্ড। এবার গোল আসে এই মৌসুমে তাদের সেরা গোলস্কোরার পিয়ের-এমেরিক ওবামাইয়াংয়ের পা থেকে। আট মিনিটের ঝড়ে লন্ডভন্ড লিভারপুল তখনো মনোবল হারায় নি। কারণ? তাদের যে আছে এক ইউর্গেন ক্লপ। সাইডলাইনে তার আকার-ইঙ্গিত, ‘কপাইট’ দের উৎসাহিত করা-সব মিলিয়ে লিভারপুলের খেলোয়াড় ও সমর্থক– কেউই ন্যূনতম বিচলিত হননি। আস্তে আস্তে ম্যাচে ফিরতে শুরু করে অলরেডরা। যদিও প্রথমার্ধে ওরিগি, মরেনো ও কৌতিনহোর বিচ্ছিন্ন দুই-তিনটি আক্রমণ ছাড়া প্রথমার্ধে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই করতে পারেনি তারা।
‘হাফটাইম টীমটক’ টা যে খেলোয়াড়দের তাতিয়ে দিয়েছে জেতার জন্য, তা লিভারপুলের দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধের মাত্র তিন মিনিটেই ডিভক ওরিগির গোলে দারুণভাবে ম্যাচে ফেরত আসে লিভারপুল। অ্যানফিল্ডে উপস্থিত ৪৫ হাজার দর্শকের উৎসাহে ডর্টমুন্ডকে চাপ দিতে থাকে লিভারপুল। কিন্তু দ্বিতীয় গোল শোধের জন্য আক্রমণ করতে থাকা লিভারপুলের ডিফেন্স ফাঁকা পেয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে আবারো ব্যাবধানটা দুই গোলের করে নেন মার্কো রয়েস। সেমিতে জায়গা করে নিতে হলে মাত্র ৩৩ মিনিটে লিভারপুলের দরকার ছিল তিন তিনটি গোল। হতাশ না হয়ে আবারো পুরোদমে আক্রমনের পর আক্রমণ দিয়ে ডর্টমুন্ডের ডিফেন্স নাড়িয়ে দিতে থাকে লিভারপুল। ম্যাচের ৬৬ মিনিটে জেমস মিলনারের সাথে ওয়ান-টু করে ডান পায়ের বাঁকানো শটে দর্শনীয় এক গোল করে আশার প্রদীপে আবারো আলো জ্বালান কৌতিনহো। মাঠে লিভারপুল খেলোয়াড়দের প্রেসিং, আর স্ট্যান্ডে কপাইটদের শিহরণজাগানীয় সমর্থনে ডর্টমুন্ড একেবারেই খেই হারিয়ে ফেলে। ৭৭ মিনিটের সময় কৌতিনহোর বাঁ প্রান্ত থেকে করা কর্ণারে মাথা ছুঁইয়ে সমতা আনেন মামাদু সাখো। ম্যাচ ৩-৩ এবং অ্যাগ্রিগেটে ৪-৪ হলেও অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে তখনও ডর্টমুন্ডই যেত সেমিতে।
নির্ধারিত ৯০ মিনিটে শত চেষ্টা করেও চতুর্থ(টাইয়ে পঞ্চম) গোলের দেখা পায়নি লিভারপুল। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত চার মিনিটের প্রথম মিনিটেই ফ্রিকিক পায় লিভারপুল। ক্রস না করে ডানপ্রান্তে স্টারিজের সাথে বল আদান-প্রদান করে ডি-বক্সের মধ্যে বল পেয়ে চিপক্রস করেন মিলনার। আর তাতেই লাফিয়ে উঠে মাথা ছুইঁয়ে বল জালে জড়ান ক্রোয়েশিয়ান দেয়ান লভরেন, ডিফেন্সিভ ভুলের জন্য যাকে এই মৌসুমে যথেষ্ট নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ৪৫০০০ সমর্থকের গগনবিদারী চিৎকারে এবং বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে সমগ্র লিভারপুল শহর। তারা প্রমাণ করে, অসম্ভবকে শুধু অনন্ত জলিল নয়, তারাও সম্ভব করতে পারে!
এই মৌসুমে নরউইচের সাথেও নিশ্চিত ড্র থেকে ম্যাচ জিতে আসে লিভারপুল। সেই স্মৃতি টাটকা থাকতেই আবারো এমন এক অবিস্মরণীয় জয়। ক্লপের হার না মানা দর্শনে পুষ্ট এই লিভারপুল থেকে আরো অসাধারণ কিছু তাই প্রত্যাশা করতেই পারে লিভারপুল সমর্থকেরা।
- 0 মন্তব্য