• ক্রিকেট

১২ বছর আগের একদিন

পোস্টটি ১১৮৮৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ঠিক এরকমই একটা দিন ছিল। সকালটা শুরু হয়েছিল পৌষের কুয়াশায় মোড়া চাদরে। এরপর একটু একটু করে সেই চাদর সরে গেছে, আশার সূর্যটা গনগনে আঁচ ছড়াতে শুরু করেছে ভরদুপুরে। সময়টাও যেন ঘড়িতে এখনো আটকে আছে, ঠিক ১২টা বেজে ৫৪ মিনিট। এনামুল হক জুনিয়রের বলে সিলি মিড অফে ক্রিস পোফুর ক্যাচটা ধরলেন মোহাম্মদ আশরাফুল, এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে যেন একটুকরো বিস্ফোরণ। সেই “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” চিৎকার, একদল কিশোরের সেই উদ্বাহু নাচ, রফিক, এনামুলদের সেই ভিক্টরি ল্যাপ- সবই যেন ভাসছে চোখের সামনে। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতে দেখলাম, এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে এক যুগ। আসলেই এক যুগ!

সেই সকালটা ভোলা তো আসলেই কঠিন। তখন আমাদের টাই পরার বয়স, গায়ে লেগে থাকা কৈশোরের গন্ধটা প্রাণপণে তাড়ানোর বয়স। সবেমাত্র স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছি, “বেশ বড় হয়ে গেছি” ভাবনাটা কেবল মাথায় জেঁকে বসতে শুরু করেছে। খুব সম্ভবত তখন কলেজের প্রথম বর্ষের কোনো একটা পরীক্ষাও চলছিল। আগের দিন শেষ বিকেলেই বাংলাদেশ অলআউট হয়েছিল। পঞ্চম দিনের হিসেবটা সোজা, বাংলাদেশকে জিততে হলে নিতে হবে ৭ উইকেট। জিম্বাবুয়েকে জিততে হলে ৩০০র বেশি রান করতে হবে। আর ড্র করতে হলে কাটিয়ে দিতে হবে গোটা দিনটা। জিম্বাবুয়ের জয়টা একটু বেশিই কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছিল। বরং প্রথম আর তৃতীয় সম্ভাবনাটাই তখন সবচেয়ে বাস্তব।

পঞ্চম দিন সকালেই ঢুকে যেতে হয়েছিল পরীক্ষার হলে। ধূসর নিউরন ব্যস্ত দ্বিঘাত সমীকরণ মেলাতে, কিন্তু হৃদয় পড়ে আছে কিলোমিটার খানেক দূরের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে। পরীক্ষার সময় শেষ, ঘণ্টাখানেক পর খাতা জমা দিয়েই প্রথমেই রেডিওতে শুনে নিলাম স্কোর। তখনও মুঠোফোন কলেজপড়ুয়াদের জন্য আজকের মতো সহজলভ্য হয়নি, ওই রেডিওই ছিল ভরসা। কিন্তু যে সুসংবাদের অপেক্ষায় ছিলাম, সেরকম কিছুই হলো না। টেলর-মাসাকাদজা তখনো ব্যাটিং করে যাচ্ছেন। তারপরও ঠিক করে ফেললাম, জিতি আর নাই জিতি, আজ মাঠে যাবই।

কিন্তু বললেই তো হলো না, কলেজও ফাঁকি দিতে হবে। ক্লাস তখনও আরও দুইটি বাকি, পাক্কা দুই ঘন্টা মামলা। কিন্তু ততক্ষণ তো বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু মিলিটারি কলেজে সবাই হুট করে চলে গেলেও পরে দিতে হবে আক্কেল সেলামি। শেষ পর্যন্ত সাহস করে পাঁচজন বেরিয়ে পরলাম ব্যাগ নিয়ে। গেটটা যখন প্রায় পেরিয়েই যাচ্ছিলাম, তখনই যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হলো। “এই কোথায় যাচ্ছিস-” স্যারের ডাকটা না শোনার ভান করেই দিলাম দৌড়। এক ছুটে কলেজের বাইরে, পড়িমড়ি করে রিকশা নিয়ে সোজা স্টেডিয়াম।

এদিকে মাঠে গিয়ে দেখি আরেক কাণ্ড। গোটা শহর তখন টিকিটের খোঁজে সতর্ক, আমরা পায়ে পায়ে টিকিট খুঁজে মরি। সবাই বুঝে ফেলেছে, আজ কিছু একটা হতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত পাশের এক দোকানেই পেয়ে গেলাম সোনার হরিণ টিকেট, পড়িমড়ি করে ঢুকে পড়লাম মাঠে। ঢুকেই দেখলাম লক্ষণ খুব একটা সুবিধার নয়, ব্রেন্ডন টেলর-হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ঝটপট কয়েকটা চারও মেরে ফেললেন। খেলার চিন্তা বাদ দিয়ে পরের দিন কীভাবে স্যারের হাত থেকে পিঠ বাঁচানো যায় সেটা নিয়েই তখন দুশ্চিন্তা।

তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে গেলেন টেলর। আমাদের আশার পালে আরেকটু হাওয়া লাগল। তবে সত্যিই সত্যিই যে দিনটা বাংলাদেশের হবে, সেই আভাসটা একদম স্পষ্ট হলো কিছুক্ষণ পর। পুরো ম্যাচেই টাটেন্ডা টাইবুই সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছিলেন, সেই টাইবুই আউট। ততক্ষণে সকালবেলার ফাঁকা গ্যালারির অনেকটুকুই ভরে গেছে, আমরাও আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে পেয়ে গেলাম সঙ্গী হিসেবে। মাথার ওপর রোদ তখন তাঁতিয়ে উঠতে শুরু করেছে, গায়ে সোয়েটারটা পেঁচিয়ে নিলাম কোমরে। কে যেন কয়েকটা টিনও নিয়ে এলো (এখনকার মতো নিরাপত্তাব্যবস্থার কড়াকড়ি ছিল না তখন)। সেই টিন পিটিয়েই “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” স্লোগানটা চলতে থাকল সমানে। কিছুক্ষণ পর আউট হয়ে গেলেন মাসাকাদজাও। আমরা বুঝে গেলাম, জয়টা আজ শুধুই সময়ের ব্যাপার। মন বলছিল, এবার আর মুলতানের মতো কিছু হচ্ছে না।

এরপর একটা উইকেটের সাথে সাথে উল্লাসের হর্ষধ্বনি, জয়ের সূর্যটা একটু একটু করে দিগন্তের কাছাকাছি চলে আসা। শেষ পর্যন্ত এনামুলের বলে পোফুর আউটেই সব শেষ। ৩৫ টেস্ট, সাড়ে চার বছর পর ঘুঁচল অপেক্ষাটা। অথচ এখন মনে হচ্ছে, এই তো কেবল সেদিনের ঘটনা।

সময় কত দ্রুত ই না সবকিছু ভুলিয়ে দেয়!