• ক্রিকেট

কীভাবে হবেন জাতীয় দলের একনিষ্ঠ সমর্থক?

পোস্টটি ২২৮৮১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বাংলাদেশ দলের সাচ্চা একজন সমর্থক হতে চান? কীভাবে ২২ গজে না থেকেও দলকে জিতিয়ে দেওয়া যায় সেটা জানতে চান? তাহলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন, আপনি হতে পারেন দলের সবচেয়ে অন্তঃপ্রাণ সমর্থক। খেলোয়াড়েরা জিতবে মাঠে, আপনি জিতবেন ফেসবুকে।

 

১) প্রথমেই দেখে নিন, কাল আপনার দলের প্রতিপক্ষ কে। দেখে নিন, সেখানে কেউ এমন আছে কি না, ১২ বছর আগে যিনি বলেছিলেন, আপনার দলকে আরও অনেকদূর যেতে হবে। এই দলে কেউ না থাকলেও আগের দলগুলোতে খুঁজতে থাকুন, নিশ্চয় কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। এরপর তাঁকে নিয়ে একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস নিয়ে কালকের ম্যাচের আগে ফেসবুকটা (পড়ুন মাঠটা) গরম করে ফেলুন। 'ক্রিকেট একটা ভদ্রলোকের খেলা, এরকম অভদ্রদের জায়গা ক্রিকেটে নাই' এটা লিখে সঙ্গে দু চারটা গালি দিয়ে একটা ঢেঁকুর তুলে ফেলুন। পারলে একটা ছবির সঙ্গে 'এবার মাঠে পুঁতে ফেলব' জাতীয় দু চারটা লাইন লিখে একটা মিম বানিয়ে ফেলুন।

 

২) প্রতিপক্ষ বাদ দিলে এবার মন দিন দেশে। কবে তারা আপনার দেশকে কত বড় রানে হারিয়েছিল, সেসব মনে করে একটা 'প্রতিশোধ, প্রতিশোধ' ভাব এনে ফেলুন। আপনার দেশের কতটা ক্ষতি করেছে, কতটা উপেক্ষা করেছে এসব নিয়ে আরও একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিন। 'ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়, জীবনের ২২ গজ মানেই বদলা, প্রতিশোধ যত বড় ক্রিকেট তত বড় নয়' জাতীয় কিছু লাইন লিখে আরও একবার ঢেঁকুর তুলে ফেলুন। এরপর ওই দেশের একটা মারদাঙ্গা ছবি দেখে বা হিট গানের দুই কলি ভাঁজতে ভাঁজতে লাইক গুণতে থাকুন।

 

৩) প্রতিপক্ষ-খেলোয়াড় বাদ দিলে এবার আম্পায়ার। দেখে নিন, দুই দলের আম্পায়াররা আগে কোনো বার আপনার দলের কোনো ন্যায্য আউট দেয়নি কি না। ঘাঁটতে থাকলে একসময় নিশ্চয় এরকম কিছু পেয়ে যাবেন। এরপরেই আম্পায়ারদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে আরও কিছু লাইন লিখে ফেলুন। এই আম্পায়ারকে নিয়োগ দেওয়া আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, ক্রিকেটে লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড নেই এসবও লিখতে পারেন। বিপক্ষ দলের অধিনায়ককে আগে আউট হওয়ার পরও দুই আম্পায়ার আউট দেননি , সেটা পেয়ে গেলে তো পোয়াবারো। ম্যাচটা হারলে যে আম্পায়াররের জন্য হারবেন- সেটা আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে আধুনিক ক্রিকেটের পল দ্য অক্টোপাস হয়ে যেতে পারেন। (আম্পায়ারদের কোনো সিদ্ধান্ত পরে আপনার দলের পক্ষে গেলে এই স্ট্যাটাস ডিলিট করে দিতে ভুলবেন না যেন)

 

৪) এবার নজর দিক মাঠের দিকে। এই মাঠে ডান দিকে একটু ছোট, আপনার দলের খেলোয়াড়েরা ডান দিকে অতটা ভালো নয়, এটাও বলতে পারেন। আবহাওয়ার আপডেট দেখুন। বৃষ্টি থাকলে নিশ্চিত হয়ে যাবেন, আপনার দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ইচ্ছে করে এই সময়ে ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। আর এই মাঠে বিপক্ষ দল সবসময় ম্যাচ জেতে, এটা কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারলে তো কথাই নেই।

 

৫) খেলার দিন শুরু থেকেই আপনার চোখ টিভিতে। টসটা দেখুন মনযোগের সাথে। বলা যায় না, ম্যাচ রেফারি টাকা খেয়ে আপনার দলের পক্ষে যাওয়া সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারে। টসে জেতার পর তো কথা নেই, হারলে 'আজ টসের জন্যই ম্যাচটা হেরে গেলাম' জাতীয় আরও কিছু লাইন লিখে ফেলুন।

 

৬) এবার শুরু আপনার আসল কাজ। আপনার ব্যাটসম্যান কতটা ভালো খেলল, কী রেকর্ড হলো, কত ভালো বলে উইকেট পেল- এসবে আপনার মন দেওয়ার দরকার নেই। আপনার কাজ, আপনার দলের কাউকে আউট করার ওদের কেউ কীভাবে উদযাপন করল। যদি উদযাপনে কান বের হয়ে যায় তাহলে খুব দ্রুত গুগল করে ছাগলের একটা কান বের করা ছবির সঙ্গে কোলাজ বানিয়ে ফেলুন। 'সেই ছাগল, আর এই ছাগল' ক্যাপশন লিখে পোস্ট করে দিন ফেসবুকে। আরও একটু তেল থাকলে 'এই সব অভদ্রলোকের জন্য ক্রিকেট খেলাটা কলঙ্কিত হচ্ছে। এটা 'বাইসিসির' কোড অব কন্ডাক্টের বিরোধী' এসব লিখে নিজেকে ক্রিকেটবোদ্ধা হিসেবে আরও একটু জাহির করে ফেলতে পারেন। (কোড অব কন্ডাক্টের ধারাগুলো কষ্ট করে পড়ে আবার সময়ের অপচয় করতে যাবেন না যেন)। এবার খেয়াল করুন, আপনার দলের উদযাপন কীভাবে হচ্ছে। যদি কেউ কোনো অশ্রাব্য গালি দেয়, বা মুখের সামনে গিয়ে উদযাপন করে তাহলে 'সাবাশ, বাঘের ব্যাটা' লিখে একটা ছবি পোস্ট করে দিন। 'দেশ জিতছে মাঠে, আমরা জিতছি ফেসবুকে' জাতীয় কিছু লাইনও জুড়ে দিতে পারেন। হু হু করে শেয়ার হবে, নিশ্চিত থাকতে পারেন।

 

৭) দল জিতছে, এবার তাহলে কথা নেই। বিপক্ষ দল কতটা ফালতু, কয়েক বার তারা ভাগ্যের জোরে জিতেছে, এরপর প্রতিবারই আপনার দল জিতবে- এসব লিখে তাদের ক্রিকেট বোর্ডের ফেসবুক-টুইটার পেজে লিখে আসুন। সঙ্গে তাদের চৌদ্দগুষ্টি ধরে একটু গালাগাল করতে ভুলে যাবেন না যেন। 'আজকে আপনার দলেরই জেতার কথা ছিল' এসব লিখে আরও একটা ঢেঁকুর তুলে নিন। মনে রাখবেন যত বেশি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিতে পারবেন, আপনি তত বড় দেশপ্রেমিক।

 

৮) আপনার দল হারলেও কোনো সমস্যা নেই। মাঠে হারছে তো কী হয়েছে, ফেসবুকে তো আর হারছে না। হারলে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত নিয়ে চুলচেরা করা শুরু করে দিন। নিশ্চয়, আর যাই হোক,  একটা প্রাপ্য ওয়াইড দেননি তাঁরা। সেই ওয়াইড পেলে ম্যাচের ভাগ্য বদলে যেত, সেটা লিখে ফেলুন চট করে। আর তৃতীয় আম্পায়ার নিশ্চয় কোনো না ভুল করবেনই। সেটা পাওয়া গেলে তাঁর শাপশাপান্ত করেও একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলতে পারেন। মনে রাখবেন, 'পার্ট অব গেম বলে কিছু নেই, সবই মিডিয়ার সৃষ্টি।'

আম্পায়ারদের যদি কিছুই পাওয়া না যায় তাহলে নজর দিন অন্যদিকে। খেলা ঠিক সময়ে শুরু হলো কি না, বিরতিটা ঠিক সময়ের হলো কি না এসব হিসেব করুন। বিরতি কম হলে আপনার দলের মনযোগ নষ্ট করার জন্যই এটা করা হয়েছে, এরকম কিছু লিখে ফেলুন।

 

সেটাও যদি পাওয়া না যায় তাহলে দলের ক্রিকেটারদের দিকে নজর দিন। তাদের মধ্যে কাউকে না কাউকে তো পাওয়া যাবেই। কেন তাদের বার বার খেলানো হচ্ছে, প্রতি ম্যাচেই তারা উইকেট দিয়ে আসে, তাদের বলে কোনো ধার নেই- এসব লিখে কিছু অশ্রাব্য শব্দ ঢুকিয়ে দিন। অধিনায়ক এই ওভারের আগে তমুককে আনা উচিত ছিল, ওই সময় ও নামলে হতো না- এসবও লিখতে পারেন। আর তিন জন নির্বাচকের চেয়ে তো চৌদ্দ কোটি লোক কম বোঝে না- এটা লিখলে কিছু বাড়তি লাইক পাওয়া যেতে পারে। 'ইশ, আজকে যদি ও থাকত, ওকে দলে নিলে এমন হতো না'- এমন কিছুও লিখলে হিট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মনে রাখবেন,' ক্রিকেট খেলুন আর নাই খেলুন, নির্বাচক, কোচ, অধিনায়ক সবার চেয়ে আপনি অনেক অনেক বেশি বোঝেন। ওই খেলোয়াড়কে কেন দল থেকে বাদ দেওয়া উচিত, সেটা দাবি করে স্টেডিয়ামের সামনে একটা মানববন্ধনের ইভেন্টও খুলে ফেলতে পারেন। তবে সামনা সামনি সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ফেসবুকে ১০ হাজার গোয়িং দিলেই আপনার উদ্দেশ্য সার্থক।

 

৯) এতেও যদি আপনার ক্রোধ প্রশমিত না হয় তাহলে আরও সৃজনশীল কিছু করতে পারেন। প্রথমেই প্রতিপক্ষের কয়েকজনের ছবি নামিয়ে নিন। এবার মনের মাধুরী মিশিয়ে সেগুলোকে চুল ছেটে বা কান কেটে দিতে পারেন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল একপাল ছাগল বা ভেড়া। বা বিপক্ষ দলের অধিনায়কের বান্ধবীর সঙ্গে কোনো ছবি পেলে তাঁর জায়গায় ছাগলের মুখ বসিয়ে দিতে পারেন। সেটা এরপর শেয়ার দিলেই কেল্লা ফতে। সঙ্গে আপনার দেশের বোর্ডের ফেসবুক-টুইটারে আরও কিছু গালি দিয়ে আসতে ভুলবেন না।

 

১০) কিন্তু আপনার দল যদি না খেলে তাহলে কী করবেন? প্রথমেই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসে ঘোষণা দিয়ে রাখতে পারেন, অন্য কারও খেলার প্রতি আপনার আগ্রহ নেই।  সেটা টাইপ করতে করতেই অন্য দলের খেলার খবরটা চেক করে নিন। দুই দলের কাউকেই সমর্থন করবেন না, দুই দলই কতটা প্রতারক, তারা কীভাবে জোচ্চুরি করে এতদূর এসেছে- সেটা নিয়ে আরও একটা স্ট্যাটাস দিন।

 

ওপরের ধাপগুলো পার হয়ে আসতে পারলে আপনিও হতে পারবেন একজন গর্বিত সমর্থক। তো, আর দেরি কেন...