• ফুটবল

আমি ন্যু ক্যাম্প দেখেছি

পোস্টটি ১৭৯৩১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।


২৭ মে, ১৯৯৯। তখন আমাদের হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরার বয়স, বড় হতে চাওয়ার বয়স। ইউরোপিয়ান ফুটবলের অন্ধিসন্ধির খবর রাখার সময় তখনো হয়নি, রাত জেগে খেলা দেখার অনুমতি মেলেনি তখনও। তেমন এক সকালে পত্রিকা খুলে একটু থমকে গেলাম। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নামের একটা দল নাকি শেষ মুহূর্তের দুই গোলে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। নামগুলো তখনো ঠিক জিভে সড়গড় হয়ে ওঠেনি, ইউনাইটেডের জেতার মুহূর্ত কল্পনা করাটাও একজন অপোগণ্ড বালকের জন্য একটু বাড়াবাড়িই। ইউটিউব দূরে থাক, ইন্টারনেট নামের বস্তটাই তখন চিনতাম না। সেই জয়ের মাহাত্ম্যটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নামটা কেন যেন গেঁথে গিয়েছিল মাথায়। সেই শুরু...


ঠিক ছয় বছর পরের কথা। ২৫ মে, ২০০৫। তখন আমাদের কেবল সাবালক হতে চাওয়ার বয়স। ফুটবলের সঙ্গে গাটছড়া তখন পোক্ত হয়েছে ভালোমতোই। রাত জেগে খেলা দেখার অভ্যাসটা রপ্ত হয়েছে। পরের দিন কলেজের বার্ষিক পরীক্ষা, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালটাও পড়ে গেল একই সঙ্গে। কিন্তু খেলা তো আর মিস দেওয়া যায় না। টিভি খুলতে না খুলতেই চমক, এসি মিলান শুরুতেই দিয়ে দিল এক গোল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিরতির আগে এগিয়ে গেল ৩-০ ব্যবধানে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের মাহাত্ম্য তখন সবে টের পাওয়া শুরু করেছি, কিন্তু এই ম্যাচ তো আর দেখার কোনো মানে হয় না। দ্বিতীয়ার্ধ দেখে আর কী হবে, এদিকে সকালে উঠেই আবার বই নিয়ে বসতে হবে। সেদিন কোন কুক্ষণে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভাবলে এখনো হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে। সকালে উঠে লিভারপুলের ফিরে আসার গল্পটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। যে গুটিকয়েক বন্ধু খেলা দেখেছে, তাদের কাছ থেকে শুনেও ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছিল না। এভাবেও তিন গোলে পিছিয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যায়? এও কী সম্ভব?


এরপর পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। আগের বারের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে। জেনেছি, শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত শেষ বলে কিছু নেই। ২০০৮ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে জন টেরির পেনাল্টি গোল থেকে চেলসির জয়টা তখন সময়ের ব্যাপার, কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে তাকিয়ে ছিলাম টিভি স্ক্রিনের দিকে। কী অবিশ্বাস্য, সেই পেনাল্টি নিতে গিয়েই টেরি পা হড়কালেন। হারতে হারতেও জিতে গেল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। নয় বছর আগে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বলেছিলেন , "ফুটবল, ব্লাডি হেল"। কথাটার মর্ম তখন অনেকটাই বুঝতে শিখে গেছি।



এরপর পেরিয়ে গেছে আরও কত সময়। সময়ের জোয়ারভাটায় থিতিয়ে এসেছে উত্তেজনা, তারপরও ফুটবল মানেই তো অন্তহীন রোলার কোস্টার। শেষ মুহূর্তে অবিশ্বাস্য এক গোল দিয়ে যখন সার্জিও রামোস রিয়াল মাদ্রিদকে লা ডেসিমা জেতান, অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই কথাই মনে পড়ে। সেই ইস্তাম্বুলের মতো অ্যানফিল্ডেও যখন লিভারপুল ঘুরে দাঁড়িয়ে ডর্টমুন্ডকে হারায়, আবারও বুঝতে পারি ফুটবল কতটা অননুমেয়। সার্জিও আগুয়েরো যখন শেষ মুহূর্তের গোলে ম্যান সিটিকে শিরোপা এনে দেন, বুঝে পারি ফুটবলের মতো রোমাঞ্চকর আর কিছু নেই। কিন্তু কে জানত, দেখার আরও অনেক কিছুই বাকি।


এই লেখা যখন লিখছি, তখনও ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছিল না। যা দেখলাম, সেটা কি আসলেই সত্যি? মনে হচ্ছিল, কিছুক্ষণ আগে যা দেখলাম, তার সবই বিভ্রম। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই ঘোর কেটে যাবে। বার্সেলোনার বাদ না পড়াটা যেখানে শুধু গাণিতিকভাবে সম্ভব ছিল, সেখানে তারা আসলেই শেষ আটে উঠে গেছে? তাও আবার শেষ ছয় মিনিটে তিন গোল দিয়ে? নেইমারের ফ্রিকিকের পর মনে হয়েছে, এটা তো সান্ত্বনাই হয়ে থাকবে। পেনাল্টি থেকে নেইমার গোল পাওয়ার পরও মনে হয়েছে, একটু বেশিই বোধ হয় দেরি হয়ে গেল। কিন্তু ফুটবল ঠিক করে রেখেছিল, আরও একবার যেন আমার ভুল ভাঙাবে। শেষ মুহূর্তে সার্জি রবার্তোর চিলের মতো এগিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেওয়া, লুইস এনরিকের ওই পাগুলে দৌড়, ন্যু ক্যাম্পের বিহবল দর্শকদের চোখের চিকচিকে অশ্রু- এসবই তো এখনও যেন রূপকথার কোনো গল্প মনে হচ্ছে। গোল হতে একটা মুহূর্তই লাগে, তারপরও তো সেই গোল বলে কয়ে আসে না। কিন্তু এভাবে ফিরে আসার গল্প কি কোনো অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রেও দেখা সম্ভব? সত্যি যে কল্পনার চেয়েও কঠিন, এই ম্যাচের পর সেটা নিয়ে কি আর তর্ক করা যায়?


আপাতত অবশ্য ওসব কিছু ভাবছি না। ইতিহাস নিজের চোখের সামনে দেখেছি, এই মুহূর্তে এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে? এই ন্যু ক্যাম্পেই ১৮ বছর আগে যা হয়েছিল, সেটা যেন ফুটবলের সঙ্গে গড়ে দিয়েছিল বন্ধনহীন গ্রন্থি। এরপর ইস্তাম্বুল দেখতে না পারার দুঃখ তাড়া করে বেরিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু এই ম্যাচের পর আগের সব দুঃখই অনেকটা ধুয়েমুছে গেছে। ন্যু ক্যাম্প তো আরও একবার চোখে আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে, হারার আগে হার মানা যাবে না, শেষ বলে কিছু নেই। কল্পনার রবার্ট ব্রুসের উদাহরণ দিয়ে আমরা অধ্যবসায়ের শিক্ষা নিই, কিন্তু ফুটবলের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কোথায় থাকতে পারে? নাতিপুতিদের গল্প করার মতো একটা রসদ পাওয়া তো কম কথা নয়!
কে জানে, একদিন হয়তো এই ন্যু ক্যাম্পের চেয়ে আরও অবিশ্বাস্য কিছু দেখব। খেলাটা যে ফুটবল!