রোনালদোর কাছে খোলা চিঠি
পোস্টটি ১৫৪৪১ বার পঠিত হয়েছেপ্রিয় ক্রিস্টিয়ানো,
প্রথমেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। দেখতে দেখতে ৩৬! আপনার ঠিক কী মনে হয় জানি না; কিন্তু আমি এখনো ভাবি, আরে এই ছোকড়াকে তো সেদিনই দেখলাম ক্লেবারসন ও স্যার অ্যালেক্সের পাশে ইউনাইটেডের লাল জার্সি হাতে স্মিত হাসি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। চুলে কি হালকা পাক ধরতে শুরু করেছে? অবশ্য এখনকার প্রসাধনী সামগ্রীর যুগে বয়স লুকোনোটা তেমন কঠিন কিছু নয়। বাহ্যিক বয়স বোঝা না গেলেও শরীরটা কিন্তু ইদানিং ঠিকই জানান দিচ্ছে, এখন আর আগের মত চলতে পারছে না সে। চিতার মত ক্ষীপ্রগতিটা আজ যেন ইতিহাস, আগেকার সেই চোখ-ধাঁধানো কারিকুরির স্বাদ মেটাতে হয় আজকালের এক দুটো হুটহাট ড্রিবল দিয়েই। ফ্রিকিক পাওয়ার পর বলটা বসিয়ে দু-তিন পা পিছিয়ে দীর্ঘশ্বাস, পা ফাঁকা করে দাঁড়ানো ‘ট্রেডমার্ক স্টান্স’- সবই আছে আগের মতই, নেই কেবল একদা দক্ষ তীরন্দাজের মত অব্যর্থ নিশানাভেদের নিদর্শন। হোক তা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পেটানো ‘সিক্স-প্যাক’ বিশিষ্ট শরীর, রক্ত-মাংসেই তো গড়া নাকি! মনকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও বেরসিক শরীরটা যে কখনোই মানে না...
ওপরের কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে; আপনার প্রতি ভালবাসা, সমর্থনে বোধহয় টান পড়েছে। আসলেই, আবেগটা আগের মত নেই, কারণ তা বেড়েছে কয়েকশ’ গুণ। বিশ্বস্ততা বরাবরই আমার অন্যতম প্রিয় শব্দ। যার খেলা মন্ত্রমুগ্ধের মত গিলেছি তার সোনালী দিনগুলোয়, তাকে ভুলে যাওয়াটা আর যার হোক, আমার মধ্যে নেই। ইউনাইটেডে প্রথম ব্যালন ডি’অরটা যখন জিতলেন, ফুটবল দেখার পর থেকে ঐদিনের মত গর্ববোধ করেছি খুব কম সময়ই। এ বছরের শুরুতে যখন পঞ্চমবারের মত বিশ্বসেরা হলেন, আনন্দের পাশাপাশি কিছুটা বিষণ্নও ছিলাম। কে জানে, হয়তো এবারই শেষ...
পাঁচবারের বিশ্বসেরা হওয়ার গল্পের শুরুর দিকে চলে যাই। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেই ০৩-০৪ মৌসুমে বোল্টনের বিপক্ষে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে নিকি বাটের বদলি হিসেবে যখন নামলেন, পুরো স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছিল তখনকার সবচেয়ে দামী টিনএজারের জন্য, কৈশোরের গন্ধটা যার গায়ে তখনো দিব্যি। স্পোর্টিং-এ থাকাকালীন সময় ইউনাইটেডের বিপক্ষে খেলা বিশ্বখ্যাত সেই প্রীতি ম্যচটাই তো বদলে দিল সবকিছু। স্যার অ্যালেক্সের মত ঝানু ম্যানেজারও এমনই মন্ত্রমুগ্ধ হলেন যে ম্যাচ শেষেই সিদ্ধান্ত নিলেন, “এই ছেলেকে আমার চাই-ই চাই”। স্পোর্টিং-এ ২৮ নম্বর জার্সিটা পড়তেন। ইউনাইটেডে এসেও সেই জার্সিটারই আবদার করলেন। কিন্তু ‘পিতৃতুল্য’ স্যার অ্যালেক্স আগে থেকেই জানতেন, এই ছেলে বিশেষ কিছু।
ফলশ্রুতিতে মাত্র ১৯ বছর বয়সে আপনার গায়ে উঠলো ইউনাইটেডের বিখ্যাত ৭ নম্বর জার্সি। তখনকার সবচেয়ে দামী টিনএজার, তার ওপর এরিক ক্যান্টোনা, জর্জ বেস্ট, ডেভিড বেকহামদের মত কিংবদন্তীদের সরাসরি ‘উত্তরাধিকারী’ হওয়ার চাপ- প্রত্যাশার পারদটা ক্যারিয়ারজুড়েই ছিল একেবারে শৃঙ্গউচ্চতায়। ইউনাইটেডের হয়ে প্রথম গোলটার জন্য অপেক্ষা করা লাগলো মাস তিনেক, বাকিটা ইতিহাস। জর্জ বেস্টের প্রায় দশক চারেক পর ’০৮-এ ম্যানচেস্টারের লাল শিবিরের কেউ জিতলেন ব্যালন ডি’অর।
ইউনাইটেডের দিনগুলোতেই খেলা দিয়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন জর্জ বেস্টেরও। বেস্ট স্বয়ং একবার বলেছিলেন, “ইউনাইটেডে একাধিক খেলোয়াড়কে ‘নতুন জর্জ বেস্ট’ বলা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু এবারই প্রথম তুলনাটা আমার জন্য সম্মানজনক”। ‘রেড ডেভিল’দের হয়ে প্রথম গোলটা করেছিলেন ফ্রিকিক থেকে, শেষ গোলটাও আসলো সেই ফ্রিকিক থেকেই। একাধিক রূপকথায় ঠাসা ইউনাইটেড অধ্যায়ের শেষটা অবশ্য ‘হ্যাপি এন্ডিং’ ছিল না একেবারেই। ’০৯ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালটা হারলেন চিরপ্রতিদ্বন্দী লিও মেসির কাছে, মেসি গোল পেলেও খালি হাতেই ফিরতে হল আপনাকে। ম্যাচ শেষে যখন আপনার শূণ্যদৃষ্টিটা দেখলাম, ইউনাইটেড সমর্থক না হয়েও পরাজিত হওয়ার চরম অপমানটা ছুঁয়ে গিয়েছিল আমাকেও...
ইউনাইটেডে যখন ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন, আমার ফুটবলবেলার সূচনাটাও হয়েছিল প্রায় ঐ সময়েই। ঐ সময়কার আর দশজনের মতই জিদান, রাউল, ‘ফেনোমেনন’ রোনালদোদের প্রেমে পড়েই রিয়াল মাদ্রিদকে সাপোর্ট করা শুরু করি। আপনার খেলা অবশ্য শুরু থেকেই ফলো করতাম। রোম ফাইনালের পর ইউনাইটেড ছেড়ে যখন রিয়ালে পাড়ি জমালেন, সেদিনের অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পেরেজ যেদিন আপনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাদ্রিদ সমর্থকদের সাথে, সেদিন বার্নাব্যুতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। একজন খেলোয়াড়কে দেখার জন্য ৮০, ০০০ লোকের সমবেত হওয়াটা এখনো অভূতপূর্ব। লাঠিতে ভর করে ডন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো যখন রিয়ালের জার্সিটা আপনার হাতে হস্তান্তর করছিলেন, মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছে ঐ মুহূর্তের মাহাত্ম্য ভাষাতীত। রিয়ালের আক্রমণভাগের ব্যাটনটা যেন আপনার হাতেই দিয়ে গেলেন ‘দ্যা ব্লন্ড অ্যারো’...
একভাবে চিন্তা করলে ডি স্টেফানোর মত রাউলেরও উত্তরসূরি আপনিই। রাউলকে অশ্রুসিক্ত বিদায় দেওয়ার পর রিয়ালের ৭ নম্বর জার্সিটা উঠলো আপনার হাতেই। ২০১০ থেকে আজ অব্দি- রিয়ালের ৭ নম্বর জার্সিটাকে একেবারেই ভিন্ন এক উচ্চতায়ই নিয়ে গেছেন। হুয়ানিতো, রাউলদেরও ছাড়িয়ে গেছেন বেশ আগেই। আপনার আগে রিয়ালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন রাউল। আচ্ছা, রাউলের চেয়ে প্রায় চার শতাধিক ম্যাচ কম খেলে গত মৌসুমে যখন রেকর্ডটা নিজের করে নিলেন, রাউলের কেমন লাগছিল তখন? তিনি কি আদৌ ভেবেছিলেন, যার হাতে ৭ নম্বর জার্সিটা তুলে দিলাম, সে এত কম সময়ে রেকর্ডটা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে?
ইউনাইটেড, রিয়াল- আপনার গোলবন্যা থেকে বাঁচতে পারেনি কোন প্রতিপক্ষই। ভূরি ভূরি গোল, অ্যাসিস্ট দিয়েও নিন্দুকদের মন জয় করা যায়নি। অবশ্য তাদের যুক্তিও যে একেবারে ফেলনা নয়! ক্লাব পর্যায়ের রোনালদো যতটা অসাধারণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রোনালদো যে ঠিক ততটাই 'সাধারণ' গোছের! ’০৩-এ অভিষেকের পর পরের বছরই গ্রিসের কাছে নিজেদের মাঠে ইউরো ফাইনাল না হারলে আন্তর্জাতিক শিরোপাটা এক যুগ আগেই ধরা দিত। সেদিনের ‘শিশু’ রোনালদোর কান্নাটা আজো নাড়া দেয় পর্তুগাল সমর্থকদের। ভাগ্যদেবীও অবশ্য মুখ তুলে তাকাননি খুব বেশিবার, নাহলে ’১২ ইউরো তো পর্তুগালের পাওনাই ছিল।
ক্লাব অঙ্গনেও যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, এমন নয়। মেসির সমান তালে গোল দিলেও দলীয় শিরোপার দৌড়ে রিয়াল ও রোনালদো যেন বার্সা ও মেসির সাথে পেরেই উঠছিল না। এক্ষেত্রেও মূল ‘আসামী’টা বানানো হয় আপনাকেই। ০৯-১৭ এই সময়টায় রিয়ালের জার্সিতে গোল করেছেন প্রায় চার শতাধিক, কিন্তু লিগ জিতলেন মাত্র একবার! শিরোপা না জিততে পারলে গোল অর্থহীন- ফুটবলের চিরাচরিত এই যুক্তিতে কাটা পড়লো ফর্মের তুঙ্গে থাকা রোনালদোর ম্যাচের চেয়েও গোলের সংখ্যা বেশি হওয়ার বিরল রেকর্ড। গোলের অভাব না হলেও শিরোপার খাতাটা ঠিক মনঃপূত হয়না- আপনি যে ভাল এক উভয়সংকটেই পড়ছিলেন বারংবার, তা বলাই যায়...
কিছুটা বিস্ময়কর হলেও ২০১৬ সালটাই একইসাথে নিয়ে আসে শিরোপা, গোলের ফুলঝুড়ি। বিতিকিচ্ছিরি ভাবে শুরু হওয়া বছরটাই যেন মুছে দেয় সব অপূর্ণতা। লিগটা মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য হাতছাড়া হলেও জিদানের অধীনে ‘ভাঙ্গাচোরা’ রিয়ালকে জেতান ‘লা উনদেসিমা’। এরপর আসলো ক্যারিয়ারের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পর্তুগালের জার্সিতে অবশেষে আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পেলেন আপনি। অথচ টুর্নামেন্টের শুরুতে কেউ গণায়ই ধরেনি দলটিকে। ক্ষুদে আইসল্যান্ডের সাথে ড্রয়ের পর অস্ট্রিয়ার সাথেও ড্র। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসলো ম্যাচের শেষদিকে আপনার পেনাল্টি মিস। হাঙ্গেরীর সাথে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার ম্যাচে দু গোল করলেন, পর্তুগালও বেঁচে গেল অন্যতম সহজ গ্রুপ পেয়ে প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ার অপমান থেকে। এরপর একে একে ক্রোয়েশীয়া, পোল্যান্ড, ওয়েলসকে হারিয়ে ফাইনালে চলে গেল পর্তুগাল। ’০৪-এর কান্নার হিসাব বরাবর করার সুযোগ আসলো আপনার সামনে। ক্যারিয়ারের বয়সটা এক যুগের বেশি হওয়ার পরও সবচেয়ে বড় ম্যাচটা আসলো ত্রিশের কোঠাতেই।
ফাইনালটা কিন্তু সহজ ছিল না একেবারেই। একে তো প্রতিপক্ষ গ্রিয়েজম্যানের ফ্রান্স, তার ওপর ‘লা ব্লুজ’রা ফাইনাল খেলবে নিজেদের মাঠে। ম্যাচ শুরুর দিকেই যখন পায়েটের ভয়ঙ্কর ট্যাকেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আপনি, কোটি কোটি রোনালদো ভক্তের মত হার্টবিটটা বেড়ে গিয়েছিল আমারও। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ম্যাচে নিজের জন্য, সমর্থকদের জন্য সেবা-শুশ্রূষা নিয়ে মাঠেও ফিরেছিলেন, কিন্তু দীর্ঘদিনের হাঁটুর বেরসিক ইঞ্জুরিটার কাছে হার মানতে হল এবার। দুহাতে মুখ ঢেকে যখন স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়ছিলেন, তখন সমগ্র ফুটবলবিশ্ব দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল 'পরাজিত' এক গ্ল্যাডিয়েটরকে, এমনকি নিন্দুকরাও...
চাইলেই ডাগ আউটে বসে থাকতে পারতেন বাকিটা ম্যাচ। কিন্তু আপনি যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো! মাঠে থাকতে না পারলেও মাঠের বাইরে থেকে অনুপ্রেরণার মূল উৎস ছিলেন আপনিই। এমনকি যেই এডারের গোলে ফাইনাল জিতলো পর্তুগাল, সেই এডারও ম্যাচ শেষে বলছিল, “নামার আগে রোনালদোই আমাকে বলেছিল, জয়সূচক গোলটা তুমিই করবে”। দেশের জন্য আপনার ভালবাসা, আত্মত্যাগের কথার জানান দিতে ‘১৪ বিশ্বকাপে পায়ে বরফের পট্টি বেঁধে প্র্যাকটিস করার ছবিটিই যথেষ্ট।
ক্যারিয়ারজুড়েই ‘স্বার্থপর’ অপবাদটা লেগে ছিল এবং আছে। ছেলেবেলায় আন্দোরিনহার ট্রায়ালের সেই বন্ধু ফন্ত্রাওকে বাড়ি, গাড়ি দিয়ে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচানো দিয়ে শুরু করে সুনামী আক্রান্ত মার্টুনিসকে স্পোর্টিং একাডেমীতে জায়গা পাওয়ায় সাহায্য করা- খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি কাউকেই। ফুটবল মাঠে স্বার্থপরতার কথাটাও ভুল প্রমাণ করা যায় অ্যাসিস্টের কেতাবী পরিসংখ্যান দিয়ে। মাঠে মাঝেমধ্যে মেজাজ হারানোয়ও কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু সেই রাগান্বিত রোনালদোর পেছনে ছিল জেতার তীব্র ইচ্ছা, ছোটবেলার পাড়ার মাঠ থেকে যা আজকের ক্রিস্টিয়ানো হওয়ার অন্যতম চালিকাশক্তি।
‘স্বার্থপর’ এর পাশাপাশি আরো একটি অপবাদ আজীবন ছিল আপনার, আপনি নাকি অহংকারী! রাখঢাক রেখে কথা বলাটা কখনোই আপনার মধ্যে ছিল না। মিডিয়ায় একাধিকবার অপ্রিয় কথাগুলো অকপটে বলার কারণে ফুটবলবিশ্বের ‘শূলে’ও চড়তে হয়েছে আপনাকে। গোল, ব্যক্তিগত ও দলীয় অর্জন- কমতি নেই কোনো কিছুতেই। নিন্দুকদের মুখটা এখনো চলছে আগের মতই, চলতেই থাকবে। আপনাকে ছোট করার জন্য নিত্যনতুন যুক্তি আবিষ্কার করাই যে তাদের কাজ! মজার ব্যাপার কি জানেন? অবসরের পর আপনাকে সমর্থকদের মত মিস করবেন আপনার নিন্দুকেরাই। দশ/বিশ বছর পর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে মানুষজন মনে বে দুর্দান্ত প্রতিভাধর ও অসম্ভব অধ্যবসায়ী এক কিংবদন্তী হিসেবে, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে যিনি ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন ফুটবলবিশ্বে। টানা চার চারবার হারের পরও যিনি হাল ছেড়ে দেননি, যার ধ্যানজ্ঞান সব ব্যাপিয়া ছিল বিশ্বসেরা হওয়া, যার মূল চিন্তা ছিল কিভাবে নিজেকে ও নিজের দলকে অভূতপূর্ব এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়।
২০১৪, ২০১৫, ২০১৬- টানা তিন বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোয় আমাদের মূল কারিগর ছিলেন আপনিই। গোলের পর গোল করে বাঁচিয়েছেন একাধিকবার। দুর্দান্ত সব অকল্পনীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। উদযাপনের প্রত্যেকটি এখনও স্মৃতিপটে অমলিন। সেই আপনিই কিয়েভে ইউসিএল-এর হ্যাটট্রিক হওয়ার রাতে আভাস দিলেন, রিয়াল ছাড়ছি এবার। এমনটি করেছিলেন আগেও। গায়ে লাগাইনি এবারও। রোনালদো ছাড়বে রিয়াল মাদ্রিদ? অসম্ভব। অন্তত তা-ই ভাবতাম আগে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে বুঝ দিচ্ছিলাম, আরে না! রোনালদো রিয়ালেই থাকবে। এমনকি টুইটারে যখন আপনার তুরিনে পা রাখার ছবি ভাইরাল হয়ে গেল; তখনও নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম, হয়ত অবকাশ যাপনেই গেছেন। কিন্তু জুভেন্টাস এবং রিয়ালের পেজে অফিশিয়াল বিবৃতি দেখে চোখজোড়া আটকে গেল স্ক্রিনে, হৃৎপিণ্ড যেন থেমে গেছে কয়েক মুহূর্তের জন্যই। আমাদের 'আপন' রোনালদো এখন 'পর'। বিস্ময়করভাবে, কেন যেন ঠিক তখনি কান্না আসল না। রাউল, ক্যাসিয়াস, গুতিদের বিদায় দেখেছি; রোনালদো তো যেতেই পারেন।
কিন্তু রিয়াল নিজেদের পেজ থেকে যখন আপনাকে বিদায় জানিয়ে সাড়ে ছয় মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করল, তখন আর আটকে রাখতে পারলাম না নিজেকে। ঝড়ঝড় করে বেয়ে আসল অশ্রুধারা। কেন যেন খুব এতিম মনে হতে লাগল। মনে হচ্ছিল, হৃদয়ের একটা অংশ যেন সাড়াশব্দ জানানো বন্ধই করে দিয়েছে। কত এম্বাপ্পে, নেইমার, হ্যাজার্ডের নাম শুনলাম; আসল না কেউই। হয়ত আসবে আগামী গ্রীষ্মে। কিন্তু যে-ই আসুক, আমি জানি; আমাদের মাদ্রিদিস্তাদের মনে রোনালদোর জন্য যে দেবতুল্য সম্মান, ভালবাসার জায়গা আছে; তা দখল করতে পারবে না কেউই। নয় বছরে আপনি আমাদের যা দিয়েছেন, তা দিয়েই কাটিয়ে দিতে পারি নিজের ফুটবল দর্শনের জীবন। ঠিক কতটা কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, কখনও কোনো মাদ্রিদ সমর্থক বোঝাতেপারবে না।
তবে স্পোর্টসের চিরাচরিত উক্তি, দ্যা শো মাস্ট গো অন। ইতালিতে শুরুটা করেছেন স্বরূপেই। প্রথম মৌসুমেই এখনও সিরি আ-এর সর্বোচ্চ গোলদাতা আপনিই। জুভেন্টাসকে ৫ বছর পর জেতালেন ইতালিয়ান সুপারকাপ, গোল করলেন ফাইনালেও। ইতালিতে শুরুটা ঠিক রোনালদো সুলভ হয়নি। কিন্তু কীভাবে ফিরে আসতে হয়, তা তো একটা গোটা প্রজন্মকে শিখিয়েছেন আপনিই। ২০২০-এর শুরু থেকে আবারও দেখা মিলছে সেই রোনালদোর। আন্দ্রেই শেভচেঙ্কোর পর দ্রুততম সময়ে ইতালিতে ৫০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করলেন।
স্পেন, ইংল্যান্ড তো আপনার হুঙ্কার শুনেছেই। এবার শুনছে ইতালি। জুভেন্টাসের হয়ে ইতালিতে জিতেছেন সবই, অপেক্ষা কেবল চ্যাম্পিয়নস লিগের। কেউ যদি তুরিনের বুড়িদের পরম অরাধ্য শিরোপার স্বাদ এনে দিতে পারে, তাহলে তা আপনার চেয়ে ভাল আর কেইবা হতে পারে? বয়স ধীরে ধীরে চল্লিশের দিকে এগুচ্ছে, এমন সময় যখন কিংবদন্তীদের অনেকেই অবসরে যান বা কাতার/এমএলএল-এ পাড়ি জমান, সেখানে আপনি এই বয়সে এই ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়ে ফেললেন। রিয়াল মাদ্রিদের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে আপনাকে শুভেচ্ছা জানানো টুইটে গর্ব হয়েছে যেমন, বুকের ভেতরটাও কেমন যেন হুহু করে উঠেছে এক অপূর্ণতায়, যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।
ভবিষ্যতে যখন আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে আপনার কীর্তির কথা গল্পচ্ছলে জানাবো, তখন হয়তো আমাদের চোখজোড়া কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসবে। কিন্তু গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো, আমরা বেঁচে ছিলাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সময়ে। যার মত অধ্যবসায়ী কেউ কখনো আসেনি, আর কখনো আসবেও না।
ভাল থাকবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দস সান্তোস অ্যাভেইরো। জেতার তীব্র ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম এবং সর্বোপরি সাফল্যের ফুলঝুড়ি- ক্যারিয়ারের সায়াহ্নের পথটা শুরু হয়ে গেলেও এসবে যেন টান না পড়ে, এই আশায়ই থাকলাম।
ইতি,
আপনার একনিষ্ঠ একজন ক্ষুদ্র ভক্ত।
- 0 মন্তব্য