• ক্রিকেট

জীবনের রঙে রঙিন ক্রিকেট নাকি ক্রিকেটের রঙে রঙিন জীবন?

পোস্টটি ৪৪৬৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মাহেন্দ্র সিং ধোনির জীবন থেকে নেওয়া সত্য ঘটনার অবলম্বনে নির্মিত “এম এস ধোনি দ্যা আনটোল্ড স্টোরি” সিনেমার মাধ্যমে অনেকেই জেনেছেন পেশাদার ক্রিকেটে নাম লেখানোর পূর্বে ধোনির টিকেট কালেক্টর জীবনের কথা। মি. ৩৬০, ডি ভিলিয়ার্সের ক্রিকেটকে গুরুত্ব সহকারে নেবার আগের অলরাউন্ড খেলোয়াড়ি জীবনের কথাও আমাদের অনেকেরই জানা। এদের ছাড়াও আরও অনেক খেলোয়াড় আছেন যারা খেলায় আসার আগে বা খেলা ছেড়ে দেবার পর ক্রিকেট ভিন্ন সম্পূর্ণ অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করেছেন। তেমন কিছু খেলোয়াড়ের সেই ব্যতিক্রমী জীবনের গল্পগুলোই আজ আপনাদের মাঝে তুলে ধরা যাক।

ক্রিকেটের ভূত পাকাপাকিভাবে মাথায় চেপে বসবার আগে

ইয়ান চ্যাপেলঃ অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত চ্যাপেল ভাইদের বড়জন পুরো ক্রিকেট ইতিহাসেই স্মরণীয় হয়ে আছেন তার অসাধারণ নেতৃত্ব গুনের কারণে। অথচ উনিই টেস্ট দলে ডাক পাবার পূর্বে বেসবল মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন।

ian chappel_espncricinfo

ব্র্যাড হজঃ ভুল সময়ে জন্ম নেওয়া ক্রিকেটারদের তালিকাটা আরও দীর্ঘায়িত করবার জন্যই হয়ত অজি এই ক্রিকেটারের জন্ম হয়েছিল। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালাদের একজন এই হজ ৪২ বছর বয়সে এসেও ব্যাট হাতে বোলারদের চোখের পানি, নাকের পানি এক করে বেড়াচ্ছেন। বিগ ব্যাশ লীগের সর্বশেষ আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তার নামটা সাত নম্বরে ছিল। অথচ এই হজ ক্রিকেটে আসার আগে স্থানীয় এক পেট্রোল পাম্পে চাকরি করতেন।

Brad Hodge

এডো ব্র্যান্ডেজঃ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালি সময়কার এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সাদা বলে হিথ স্ট্রিকের এক সময়কার সঙ্গী এই ব্র্যান্ডেজ আগে নিজের মুরগির খামারে খামারি হিসেবে কাজ করতেন। ব্র্যান্ডেজকে ক্রিকেটভক্তরা যতটা না তার খেলার জন্য মনে রাখবেন তার থেকে ঢের বেশি মনে রাখবেন অজি পেসার ম্যাকগ্রার সাথে হওয়া স্লেজিংয়ের কারণে।

Eddo Brandes

দীপক চুদাসামাঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওগুলো যারা দেখে থাকেন তাদের কাছে নামটা হয়ত পরিচিত মনে হতে পারে, কারণ ব্লুপ আইসক্রিমের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ইয়ামিন খান দীপক চুদাসামার নাম ব্যবহার করে একটা মজার ভিডিও বানিয়েছিলেন। কেনিয়ান ক্রিকেটার এই চুদাসামা, কেনেডি ওটিয়েনোকে সাথে নিয়ে উদ্বোধনী জুটিতে ২২৫ রান করেছিলেন যা কিনা সেই সময়কার উদ্বোধনী জুটির রেকর্ড ছিল। আর রেকর্ডটা হয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষেই। তো এই চুদাসামা টেবিল টেনিসে জাতীয় পর্যায়ে কেনিয়ার প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন। তিনি আবার পুরোদস্তুর দন্তচিকিৎসকও বটে।

rsz_dipak_chudasama_gettyimages

ফ্রেড ট্রুম্যানঃ ৩০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক স্পর্শকারী প্রথম বোলার হিসেবে নাম লেখানো ট্রুম্যান জাতিতে ইংলিশ ছিলেন। ২২ গজী পিচটায় গতির ঝড় তুলে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলতে সমর্থ হলেও দর্শকদের মাঝে হাসির ঝড় তোলায় তিনি নিতান্তই ব্যর্থ ছিলেন। আর এজন্যই ক্রিকেটে আসার আগে ও ক্রিকেট ছাড়ার পড়ে কৌতুক অভিনেতা হবার চেষ্টা করেও বেশি দূর আগাতে পারেন নি।

trueman_digitalmode

ক্রিকেটাররা ক্রিকেটে আসার আগে সবচেয়ে বেশি যেই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন তা হল “পুলিশ”। কিউই স্পিডস্টার শেন বন্ড থেকে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেলডন কটরেল কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপের বিখ্যাত চরিত্র ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্থূল ক্রিকেটার বারমুডিয়ান ডুয়েন লেভেরেক ও পুলিশ ছিলেন। ডুয়েন লেভেরেক অবশ্য নেশাকে পেশা না করে পুলিশ হিসেবেই জীবনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমান অজি টেস্ট স্কোয়াডের সদস্য নাথান লায়ন ছিলেন মাঠ পরিচর্যাকারি দলের সদস্য। ২০১৫ বিশ্বকাপে খেলা আরব আমিরাত অধিনায়ক মোহাম্মাদ তৌকির  ছিলেন ব্যাংকার। সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে কাজের সাথে জড়িয়ে ছিলেন অজি কিপার হ্যানসন কার্টার, যিনি ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পরিচালনাকারীর দায়িত্ব পালন করতেন। ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ডাব্লিউ জি গ্রেসের ক্রিকেটার পরিচয়ের আড়ালে তার চিকিৎসক পরিচয়টা একদম হারিয়েই গিয়েছিল।

ক্রিকেটকে পাকাপাকিভাবে বিদায় দেবার পর

জ্যাক রাসেলঃ জাতিতে ইংলিশ এই কিপারকে প্রায়শই দেখা যেত দ্রুত গতির বোলাদের বোলিংয়ের সময় সামনে এগিয়ে যেয়ে কিপিং করতে। অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতির এই কিপারকে ইংলিশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা কিপার হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষে রাসেল পুরোদস্তুর চিত্রশিল্পী বনে যান। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে ঝোঁক থাকা এই ক্রিকেটার চিত্রশিল্পী হিসেবে ক্রিকেটারের থেকেও বেশি খ্যাতি অর্জন করেন।

jack russell

কলিন ক্রফটঃ ক্যারিবিয়ান এই পেসার ক্রিকেট বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে দীর্ঘায়িত করতে ব্যর্থ হন। খেলা ছেড়ে দেবার পর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উড়োজাহাজ চালনার ওপর সনদ নিয়ে উড়োজাহাজ চালনাতেই তিনি মনোনিবেশ করেন।

colin croft_cricket country

বিল উডফুলঃ ক্রিকেট ইতিহাসে বিতর্কিত বডিলাইন সিরিজে অস্ট্রেলিয়া দলকে নেতৃত্ব দানকারি বিল উডফুল ছিলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। ৩৪ টেস্টের ক্যারিয়ারে সাতবার শতক হাকানো উদ্বোধনী এই ব্যাটসম্যান তার বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

rsz_1bill_woodfull_gettyimages

ক্রিস হ্যারিসঃ কিউই এই স্পিনিং অলরাউন্ডার তার ক্রিকেট জীবনের অন্যতম স্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছিলেন ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের হাজারো দর্শককে সাক্ষী রেখে। ১৯৯৮ সালে প্রথম বারের মত অনুষ্ঠিত হওয়া আইসিসি নকআউট ট্রফির (আইসিসি নকআউট ট্রফিই ২০০২ সাল থেকে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে) প্রিলিমিনারি বা কোয়ালিফাইং ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জেতার জন্য শেষ দিকে যখন কোন জাদুর কাঠির পরশের প্রয়োজন মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনি ২১ বলে ১৭৬ স্ট্রাইক রেটে অপরাজিত ৩৭ রানের এক অতিমানবীয় ইনিংস খেলে দক্ষ নাবিকের মত দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। সেই সময়ে ১৭৬ স্ট্রাইক রেটে রান করাটা দানবীয় কিছুই ছিল। ২৫০ ওয়ানডে আর ২৩ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে তিনি মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে চিকিৎসা শাস্ত্রে নাম লেখান।

Harris Points_Hussain Out_NZ

মাইক ব্রিয়ারলিঃ ইংলিশ এই ক্রিকেটার যতটা না খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত তার থেকে বেশি পরিচিত তার নেতৃত্বগুণ এবং খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারার ক্ষমতার কারণে। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে তিনি মনস্তত্ত্ব গবেষক এবং অনুপ্রেরণাদায়ি বক্তা হিসেবে নাম লেখান।

eaece18988757cb72143456129180a30

২০০৭ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী ভারত দলের সদস্য এবং ফাইনালের শেষ ওভার করা যোগিন্দার শর্মা এখন হরিয়ানা পুলিশের ডিএসপি পদে কর্মরত আছেন, ইংলিশ অলরাউন্ডার ফ্লিনটফ বক্সিং রিংয়ের উত্তাপ কিছুটা গায়ে মেখে এসেছেন, ভারতীয় শ্রীসান্থ আর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলা সদাগোপান রমেশ সিনেমা জগতে পা রেখেছিলেন। অপরদিকে পাকিস্তানি স্পিনার আরশাদ খান খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ক্যাব চালানোকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন।

flintoff

ফ্লিনটফ যখন বক্সার

joginder sharma_cricbuzz

যোগিন্দার শর্মা যখন পুলিশ

ক্রিকেটারদের এই ব্যতিক্রমী পথ পরিক্রমায় কেও হয়ত সফল হয়েছেন, আবার কেও হয়ত ব্যর্থ। কেও হয়ত নাড়ির টানে আবার ক্রিকেটেই ফিরেছেন ক্রিকেটের সাথে থাকবেন বলে। কেও হয়ত একরাশ অভিমান বুকে চেপে দূরে থাকাকেই শ্রেয় হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তবুও জীবন থেমে থাকে নি, থাকবেও না কখনো। জীবন মানেই বহমান স্রোতধারা।