• ক্রিকেট

দুঃসাহসী এক ক্রিকেটার!!!

পোস্টটি ৪৮৪০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.   

   ‘হেই, বব। আমি কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় উঠতে যাচ্ছি। শুনেছি, দারুণ এক জায়গা। তুমি যাবে আমার সাথে?’

   বব বন্ধুর দিকে তাকালেন। তানজানিয়াতে যে কাজে তিনি এসেছিলেন সেটা হয়ে গেছে, এখন অন্য কোথাও যাওয়াই যায়। একমুহূর্ত চিন্তা করে বন্ধুকে বললেন, ‘ল, যাইগা’।

   মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ,  তানজানিয়াতে অবস্থিত কিলিমাঞ্জারোর উচ্চতা ১৯,৩৪১ ফুট। এরকম একটা জায়গাতে যেতে হলে প্রস্তুতি লাগে অনেক। কিন্তু ববের কথা শুনে মনে হলো, তিনি আসলে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠতে যাচ্ছেন না, কোথাও পিকনিকে যাচ্ছেন!!!

   সময়টা ১৯৩০ সাল। এভারেস্ট তখনও পদানত হয়নি মানুষের, কে-টুও রয়ে গেছে অচেনা। নানারকম সরঞ্জামাদিসহ ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সামিট করেন পর্বতারোহীরা। সেই অবস্থায় কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়া কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় ওঠার সিদ্ধান্ত নিলেন বব।

   অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তারা দুজন চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছেও গেলেন। চূড়া আর কয়েক শ ফুট বাকি, এইসময় একটা দুর্ঘটনা ঘটল, ববের বন্ধুর পা মচকে গেল।

   ‘বেচারা।’ বিড়বিড় করলেন বব। তারপর বন্ধুকে বললেন, ‘তুমি একটা কাজ করো। আমার পিঠে ভর দাও দেখি। তোমাকে পিঠে করেই চূড়ায় উঠি।’

   বন্ধুকে পিঠে করে কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় উঠলেন বব। দুজন মিলে কিছুক্ষণ হাসিতামাশা করলেন। তারপর বন্ধুকে বললেন, “চলো, ফেরা যাক।”

   কিন্তু বন্ধুর পা যে মচকে গেছে? চিন্তা কি, বব আছেন না? বন্ধুকে আবার পিঠে তুলে নিয়ে নামতে লাগলেন। দুর্গম গিরি পার হয়ে নিচে নেমে তবেই বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন বব।

   ববের বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। এরপরে আরও একবার কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় উঠেছেন তিনি। দুবার কিলিমাঞ্জারো জয় করা একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার বব নামের মানুষটি।  

   দুঃসাহসী এই মানুষটির নাম রবার্ট ক্রিস্প। আমরা তাকে ডাকব বব ক্রিস্প নামে।

 

২.

 

    ১৯১১ সালের ২৮ মে। অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় জন্ম হলো একটি শিশুর। ক্রিস্প পরিবার তার নাম রাখল রবার্ট জেমস ক্রিস্প।

    ভারতে জন্ম হলেও বেশিদিন সেখানে থাকা হয়নি তাঁর। অল্পবয়সেই চলে যান রোডেশিয়াতে (বর্তমান জিম্বাবুয়ে), পরে দক্ষিণ আফ্রিকাতে বেড়ে ওঠেন । ১৮ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন বব। বোলার ছিলেন মুলত। ৩-৪ বছর ফার্স্টক্লাস ক্রিকেট খেলে ৬২ ম্যাচে ২৭৬ উইকেট নেন, সেই সাথে গড়েন পরপর চার বলে চার উইকেট নেয়ার এক অনন্য কীর্তি। এই কীর্তি বাংলাদেশের মাহমুদউল্লাহ্‌ও গড়েছেন, তবে ক্রিস্প আলাদা এই কীর্তি দু’বার গড়ার কারণে। ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটের পারফরম্যান্সের পরে তাঁর দিকে চোখ পড়ে নির্বাচকদের; ১৯৩৫ এর ইংল্যান্ড সফরের দক্ষিণ আফ্রিকা দলে ডাক পান তিনি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে তার তেমন কোনও কীর্তি নেই। ৯ টেস্টে ২০ উইকেট নেয়া একজন বোলারের তা থাকার কথাও নয়।

    ক্রিস্পের আরেকটা ‘গুণের’ কথা বলা যাক। ক্রিস্প ছিলেন চরমমাত্রায় রমণীমোহন, ইংরেজিতে যাকে বলে লেডিকিলার। মেয়েরা তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেই প্রেমে পড়ে যেত। তার সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত ছিল, বলতে গিয়ে আমি বেশ বিব্রতবোধ করছি, কিন্তু না বললেই নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ইংল্যান্ড ট্যুর চলেছিল প্রায় ৩ মাস ধরে, এবং সেই ৩ মাসে তিনি প্রায় ১০০ জন নারীকে নিয়ে বিছানায় গিয়েছিলেন!!!

   গডফ্রে ইভান্সের কথাই ধরুন। ভদ্রলোক ছিলেন উইকেটকিপার, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৯১ টেস্ট। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ দেখার জন্য ছেলে জোনাথন ক্রিস্পকে নিয়ে এমসিজিতে যান বব, তার বয়স তখন ৮১। সেখানে জোনাথনের সাথে দেখা হয় ইভান্সের এবং কথায় কথায় জানতে পারেন ববও সেখানে উপস্থিত। জোনাথনের সাথে ইভান্সের কথোপকথন শোনা যাক।

   ইভান্সঃ তোমার বাবা এখানে? ওহ, গড! তাঁর সাথে দেখা করতেই হবে আমাকে। হি ইজ মাই হিরো।

   জোনাথনঃ বাবা তো খুব আহামরি কোনও ক্রিকেটার ছিলেন না। খেলেছেন মাত্র ৯ টেস্ট। আর আপনি সেখানে খেলেছেন ৯১ টেস্ট। তিনি আপনার হিরো হলেন কীভাবে?

   ইভান্সঃ কারণ তিনি একমাত্র ক্রিকেটার যিনি একসফরে সেঞ্চুরি করেছেন।

   ইভান্সের এই কথায় বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন জোনাথন। মানে কী? তিনি বললেন, “কী বলছেন? এক সফরে সেঞ্চুরি তো অনেকেই করেছেন।”

   ইভান্স বললেন, “বাছা, আমি রানের কথা বলছি না।” 

 

৩.

 

    ১৯৩৯ সালে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পোল্যান্ডে বোমা ফেলতে লাগল জার্মানসেনারা। হিটলারের কার্যক্রমে মহাবিরক্ত বব ক্রিস্প ঠিক করলেন, হিটলারের বাহিনীকে একটা শিক্ষা দেবেন।

    ব্যস!! ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন বব। তার পোস্টিং হলো মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে, ৩য় রয়্যাল ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের আন্ডারে। সেখানে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল তার দিন, কারণ আলেকজান্দ্রিয়াতে তখনও বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ লাগা শুরু করেনি।

    একবছর পরে তাকে সরিয়ে নেয়া হলো যুগোশ্লাভিয়াতে, সেখানে চরম আকার ধারণ করেছে যুদ্ধ। তাকে দেয়া হলো ট্যাঙ্ক কমান্ডারের পদ। পদ পেয়ে তিনি সরাসরি প্যাঞ্জার ডিভিশনের বিরুদ্ধে নেমে গেলেন এবং একাহাতে জার্মানদের ৩টা ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিলেন।  

    একাহাতে বলা যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। তিনি নিজেও বেশ ভালোরকমের আহত হন, স্প্লিন্টার ঢুকে যায় মাথায়। তবে তার মতো দুঃসাহসী মানুষকে কি আর তাতে দমানো যায়?

    ক্রিস্পের আরেক দুঃসাহসিক কাজের নমুনা দেয়া যাক। এক জার্মান বোম্বার প্লেন বোমা ফেলতে এগিয়ে এসেছিল তার বাহিনীর দিকে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি অন্য একজনের ট্রাক নিয়ে রওনা দেন এবং প্লেনের কাছাকাছি হতেই ট্রাক থেকে মেশিনগান চালানো শুরু করেন। বলাই বাহুল্য, মেশিনগানের গুলিতে সেই বোম্বার ধ্বংস হয়ে যায়।

    ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তার লেখা বই ‘দ্য গডস ওয়্যার নিউট্রাল’ এবং ‘ব্র্যাজেন চ্যারিয়টস’এ। এরমধ্যে ব্র্যাজেন চ্যারিয়টসকে মনে করা হয় ট্যাঙ্ক ওয়ারফেয়ারের উপরে লেখা অন্যতম সেরা বই।

Brazen-Chariots

    যুগোশ্লাভিয়ার এই সাফল্যের পরে তার পোস্টিং হলো উত্তর আফ্রিকাতে। উত্তর আফ্রিকা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ‘ডেজার্ট ফক্স’ ফিল্ড মার্শাল রোমেল।

    উত্তর আফ্রিকাতে পোস্টিঙের পরে ২৯ দিনে ধ্বংস করেন ৬টি জার্মান ট্যাঙ্ক। আর এমন একটি কাজ করেন যা কিনা সিদি রেজেগের রূপকথা হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়। সিদি রেজেগের সেই যুদ্ধে তিনি নিজের ১টি ট্যাঙ্ক দিয়ে জার্মানদের ৭০টা ট্যাঙ্ককে আটকে দেন। এই ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার না। ১টা ট্যাঙ্ক দিয়ে কীভাবে ৭০টা ট্যাঙ্ককে আটকানো যায় সে ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। তার লেখা বই পড়লে হয়তো ব্যাপারটা বোঝা যেত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বইটি আমার কাছে নেই।

   যুদ্ধ শেষ হলে সিদি রেজেগের সেই অসীম সাহসিকতার কারণে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সম্মান ভিক্টোরিয়া ক্রসের জন্য মনোনীত হন। তবে বাধ সেধে বসেন ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারি। শৃঙ্খলা মানেন না এমন অভিযোগ তুলে ভিক্টোরিয়া ক্রসের লিস্ট থেকে বাদ দেন বব ক্রিস্পের নাম। সর্বোচ্চ সম্মান না পেলেও মিলিটারি ক্রস ঠিকই পেয়ে যান বব।

   মিলিটারি ক্রস দেয়ার সময় রাজা ষষ্ঠ জর্জের জিজ্ঞাসা ছিল বব আর ক্রিকেট খেলতে পারবেন কিনা। ববের চটপটে উত্তর ছিল, ‘শিওর। অনলি মাই হেড ওয়াজ ইঞ্জুরড। ’

 

৪.

   

    যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বব বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের নিয়ে পত্রিকা, ড্রাম (DRUM)। উইজডেনে লিখেছেন, সম্পাদকের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চাকরি ছেড়েছেন, এমনকি একটা মিঙ্কের খামারও করেছেন। তারপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে গ্রীসে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন।

    গ্রীসে থাকতেই তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। শেষ অবস্থা তখন, বাঁচার কোনও আশা নেই বললেই চলে। তবুও গ্রীসের স্থানীয় ডাক্তাররা তাকে কিছু ওষুধ দিলেন, শরীরে মালিশ করার জন্য। বব ওয়াইনের সাথে মিশিয়ে সেই ওষুধ গিলে ফেললেন!!

    আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এরপরে তার ক্যান্সার পুরোপুরি সেরে যায়। ৬০ বছর বয়সে ক্যান্সার ধরা পড়ার প্রায় ২৪ বছর পরেও বেঁচে ছিলেন তিনি। ক্যান্সার থেকে বব সুস্থ হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য ডাক্তাররা চমকে যান। টার্মিনাল ক্যান্সারের রোগীর সুস্থ হয়ে যাওয়াটা রীতিমতো মিরাকল মনে হয় তাদের কাছে। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পরে তারা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ববকে যে ওষুধটা দেয়া হয়েছিল তা ছিল কেমোথেরাপির এক আর্লি ভার্শন।

    ১৯৯৪ সালের ৩রা মার্চ ঘুমের মধ্যে বব মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি ক্রিকেট ম্যাচে প্রিয় দলের পক্ষে ২০ পাউন্ড বাজি ধরেছিলেন, সেই বাজিতে হেরে যান তিনি।

    জীবননদীর ওপারে থাকা বব ক্রিস্পের কিছু তাতে কিছু যায় আসেনি। সারাজীবন সবকিছুকে যিনি বুড়োআঙুল দেখিয়ে চলেছেন, সামান্য ২০ পাউন্ডে তার কী-ইবা এসে যায়!!

 

৫.

 

    লেখাটা শেষ করছি বব ক্রিস্প সম্পর্কে বলা অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়াসাংবাদিক গিডিয়ন হেইয়ের ‘সাইলেন্ট রেভ্যুল্যুশন’ বইয়ের একটা অংশ কৌট করে।

    ‘মেনি লাইভস ইন ওয়ান, অল অফ দেম ওর্থ লিভিং।’