• ক্রিকেট

ভিক্টর ট্রাম্পারঃ অস্ট্রেলিয়ার গ্রেটেস্ট এভার?

পোস্টটি ৪৫২৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

 

    ডেভিড ম্যাকলাকিয়ান একজন সফল বুকমেকার (জুয়াড়ি)। টাকাপয়সা ভালোই আছে ধরতে গেলে। এ কারণেই ক্রিস্টি নামক অকশন হাউজে অনুষ্ঠিত নিলামে তিনি ঝোঁকের মাথায় ভাস্কর্যটা কিনে ফেললেন। ভাস্কর্যটা একজন ক্রিকেটারের, সামনের পা এগিয়ে দিয়ে গায়ের জোরে শট খেলছেন এমন অবস্থায় গড়েছেন ভাস্কর। ভাস্করের নাম লুইস লোমেন। ব্রোঞ্জের তৈরী, উচ্চতা আড়াই মিটারের আশেপাশে হবে। নিচের বেজসহ ধরলে ২.৮ মিটার মোটামুটি।

    ভাস্কর্যটা কিনে ডেভিডের আফসোস হতে লাগল। কেন যে কিনতে গেলেন তিনি? এমন তো না যে তিনি ক্রিকেটের খুব ভক্ত। বন্ধুবান্ধব বাড়িতে এলে দেখাবেন। এটা কিনলাম, কেমন হয়েছে বলুন তো? দারুণ না?

    জিনিসটা বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করলেন ডেভিড। চেষ্টা সফল হলো না। এতো বড় জিনিস দিয়ে ঘরভর্তি করে ফেলবে, কার এতো দায় পড়েছে?

    দু’বার বিক্রির চেষ্টা করেও বিক্রি হলো না জিনিসটা। হতাশ হয়ে ডেভেলপার বন্ধু নেইল ব্রাইসনকে ধার দিলেন। ব্রাইসনের বাড়িতে জায়গা আছে কিছুটা, ছুটিছাটায়-উইকেন্ডে অতিথিরা আসলে ক্রিকেট খেলা হয় সেখানে। ভাস্কর্যটা দেখে অতিথিরা কথাবার্তা বললেন, প্রশংসাও করলেন। কিন্তু কেনার আগ্রহ দেখালেন না কেউ।

    সময় যায়। ব্রাইসন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। তার প্রোপার্টিও বিক্রি হয়ে গেল। ভাস্কর্যও আবার আগের মালিকের কাছে ফিরে গেল।

    আবার বিক্রির চেষ্টা করলেন ডেভিড। এবার সাড়া পাওয়া গেল মোটামুটি। সমস্যা হচ্ছে, যারা কিনবে, তারা আসলে সংগ্রহে রাখার জন্য কিনতে চাচ্ছে না। একজন তো তাকে বলেই বসল, ‘ভাস্কর্যের হাতে ছিদ্র-টিদ্র করে সুইমিংপুলের নিচে বসিয়ে দেব। পানির নিচে একজন ব্যাটসম্যান! ব্যাপারটা চিন্তা করেই তো অন্যরকম লাগছে।’

    শেষ পর্যন্ত জিনিসটা বিক্রির চিন্তা বাদ দিলেন ডেভিড। কারণটা তার মুখেই শোনা যাক।

   ‘কিছুদিন ভাস্কর্যটা নিয়ে আমি খুব বিব্রত ছিলাম। জিনিসটা বিক্রি থেকে কিছু টাকা আসুক, তা-ই চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু অনেকবার চেষ্টার পরেও বিক্রি করতে পারিনি। আমি এখন আর বিক্রি করতে চাইও না। কারণ, সত্যি কথা হলো, আমি জিনিসটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি।’

    ভাগ্যিস পড়েছিলেন। নইলে, ড্রাইভ করার চেষ্টারত ব্রোঞ্জের ভিক্টর ট্রাম্পারের আশ্রয় হতো কোন সুইমিংপুলের তলায়!

    ভিক্টর ট্রাম্পার! দ্য মোস্ট স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান এভার ইন অস্ট্রেলিয়া।

index

 

২.

 

    সিডনি মিউজিশিয়ান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লক ওয়ামসলেই। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মারা যান তিনি। ক্রিকেটের প্রতি গভীর অনুরক্তি ছিল তাঁর। মারা যাওয়ার আগে শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রামোফোনের ডিস্কে তাঁর কথা রেকর্ড করা হয়। তাঁর কথাগুলো ছিলঃ

    ‘ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আমি আমার কথা রেকর্ড করে রেখে যাচ্ছি। আমি তাদেরকে বলতে চাই, ভিক্টর ট্রাম্পার ছিলেন সবার থেকে সেরা ব্যাটসম্যান।’

    সি. বি. ফ্রাই দম্পতির কথা ধরা যাক। এই দম্পতি খুব ভক্ত ছিলেন ট্রাম্পারের, তাঁর একটা ছবিও ঝোলানো ছিল তাদের ঘরে। সি. বি. ফ্রাই ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ২৬ টেস্ট, নেতৃত্ব দিয়েছেন ৬ টেস্টে। জন্ম ১৮৭২ সালে, মৃত্যু ১৯৫৬ তে। ট্রাম্পার এবং ব্র্যাডম্যান দুজনের ব্যাটিঙই দেখেছেন। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের ব্র্যাডম্যানের এক সিরিজে ৯৭৪ রানের সাক্ষী তিনি। তারপরেও তিনি বলেছেন, ‘ব্র্যাডম্যান যত রানই করুন না কেন, মহাকালের বিচারে আগে আসবে ট্রাম্পারের নাম। এমনকি চিরশত্রু ইংল্যান্ডের মানুষের মনেও একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন এই ব্যাটসম্যান।’ আর তাঁর স্ত্রী বলেছেনঃ ট্রাম্পার আসলে প্যাগানিনির মতো একজন বেহালাবাদক, যার হাতে ব্যাট হয়ে ওঠে এক সুরেলা ভায়োলিন।

    যে টেস্টে ট্রাম্পারের অভিষেক হয়, সেই একই টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় ইংলিশ কিংবদন্তী উইলফ্রেড রোডসেরও। ১১ নাম্বারে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, পরে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেতে পেতে ওপেনিঙে স্যার জ্যাক হবসের পার্টনার হয়ে যান। একবার রোডসকে জিজ্ঞেস করা হয়, তার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান কে?, তাঁর উত্তর ছিল, ‘দেয়ার ওয়াজ অনলি ওয়ান। ভিক্টর ট্রাম্পার।’

 

৩.

    ট্রাম্পারের অভিষেক টেস্ট ছিল বিখ্যাত ইংলিশ বুড়ো ডব্লিউ. জি. গ্রেসের শেষ টেস্ট। সহজে কারও প্রশংসা করতে চাইতেন না, প্রশংসার ব্যাপারে রীতিমতো কৃপণ ছিলেন তিনি। কিন্তু ট্রাম্পার তাকে এমনই মুগ্ধ করলেন যে...

    সময়টা ১৮৯৯ সাল। প্লেন আবিষ্কার করে ফেলেছেন রাইট ব্রাদার্স, বুনো পশ্চিমের কাউবয়দের দিন শেষ হয়ে এলো বলে। দুনিয়ার আরেক প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের এক চরম প্রতিভাবান কবির কলম থেকে বের হয়ে আসছে গান, কবিতা, গল্প, একের পর এক। ফেলিক্স হফম্যান নামের এক জার্মান কেমিস্ট আবিষ্কার করে ফেলেছেন অ্যাসপিরিনের ফর্মুলা, আর কিছুদিনের মধ্যেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফ্রিকায় শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বোয়ের যুদ্ধ।

    অস্ট্রেলিয়া - ইংল্যান্ড সিরিজ ততদিনে পরিচিত হয়ে গেছে অ্যাশেজ নামে। প্রথম টেস্টে অভিষেক হলো ট্রাম্পারের, অভিষেকটা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকল তাঁর জন্য, দুই ইনিংসে করলেন ০ আর ১১।

    দ্বিতীয় টেস্টে পুষিয়ে দিলেন সুদে-আসলে। দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে করল ২০৬। জবাবটা দারুণ দিতে লাগল অস্ট্রেলিয়া, শুরুটা করলেন ক্লেম হিল, ১৩৫ করে যখন ফিরছেন তখন স্কোর ২৭১/৫।

     ট্রাম্পার নেমেছিলেন মন্টি নোবেল আউট হওয়ার পরে, স্কোর তখন ১৮৯/৪। ক্লেম হিল আউট হওয়ার পরেও যে অস্ট্রেলিয়া ৪২১ পর্যন্ত যেতে পারল, তার কৃতিত্ব প্রায় পুরোটাই ট্রাম্পারকে দিয়ে দেয়া যায়। দলের বাকি ৫ জন মিলে করল ৫০, ট্রাম্পার একা করলেন ১০০। লর্ডসের মাঠে খেললেন নিজের ইচ্ছেমতো, ড্রেসিংরুমে যখন ফিরছেন তখন তাঁর নামের পাশে অপরাজিত ১৩৫। সি. বি. ফ্রাই পরে বলেছিলেন ‘হি হ্যাড নো স্টাইল, ইয়েট হি হ্যাড অল স্টাইলস। দ্য মিনিমাম অফ ইফোর্ট, দ্য ম্যাক্সিমাম অফ ইফেক্ট।’

     এই ইনিংস খেলার পরে কোন কথাবার্তা ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিংরুমে হাজির হলেন আগের টেস্টে অবসর নেয়া ডব্লিউ জি গ্রেস। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি, ট্রাম্পার যে ব্যাট দিয়ে খেলেছেন সেই ব্যাটটা যেন তাঁকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়, ট্রাম্পার যেন তাতে সই করে দেন। প্রথমে রাজি হলেন না ট্রাম্পার। গ্রেসও নাছোড়বান্দা। অনেক গাঁইগুঁই করার পর ট্রাম্পার রাজি হলেন বটে, তবে একটা শর্তে। তিনিও গ্রেসের একটা ব্যাট চান।

    ট্রাম্পার দিলেন গ্রেসকে, গ্রেস দিলেন ট্রাম্পারকে। গ্রেস যখন ট্রাম্পারের হাতে ব্যাট তুলে দিচ্ছেন, তখন গ্রেস তাঁর সেই অমর উক্তি ছাড়লেন।

    ‘ফ্রম টুডে’স চ্যাম্পিয়ন টু দ্য চ্যাম্পিয়ন অফ টুমরো।’

 

৪.

 

    তবে ট্রাম্পার তাঁর সেরা সময়টা কাটিয়েছেন ১৯০২ সালে। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দেয়ার পরে সুযোগ মিলল আবার ইংল্যান্ডগামী অ্যাশেজ দলে। ৫ টেস্ট মিলিয়ে করলেন মাত্র ২৪৭ রান, কিন্তু এমনভাবে করলেন যে তাঁর সমসাময়িক সবাই-ই প্রায় মেনে নিলেন ট্রাম্পারই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।

    তখনকার দিনে উইকেট ঢাকার বালাই ছিল না, বৃষ্টি হলে খোলা পড়ে থাকত পিচ। একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে যখন রোদ উঠত, সেই পিচ হয়ে উঠত ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি।

    সেই বধ্যভূমি দেখেও টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং। ১৯০২  সালের অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট। স্ট্যানলি জ্যাকসন, বিল লকউড আর ফ্রেড টেটকে লেলিয়ে দিতে পারবেন ভেবে নেচে উঠল ইংলিশ ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেনের মন। বাকিটা যা হলো, তা ইতিহাস।

    ওপেনিঙে নামলেন ট্রাম্পার আর রেজিনাল্ড ডাফ। ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেই স্টিকি উইকেটে ট্রাম্পার করলেন ১০৪, মাত্র ১১৫ মিনিটে। লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি করার প্রথম রেকর্ড এলো ট্রাম্পারের হাত ধরে।

    সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল মাত্র ৩ রানে।

 

৫.   

    ১৯১৫ সালের ২৮শে জুন মারা যান ভিক্টর ট্রাম্পার। শরীরটা এমনিতেই শেষ কয়েক বছর ভালো যাচ্ছিল না তাঁর, তার উপরে কিডনীর সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৭ বছর।

    ট্রাম্পারের মৃত্যুর খবর সবাইকে বিমূঢ় করে দেয়। অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, ইংল্যান্ড পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায় এ খবর শুনে। তাঁর লাশবাহী গাড়ির পাশে কাঁদতেও দেখা গেছে অনেককে।

    আজ ২রা নভেম্বর। আজ থেকে ১৪০ বছর আগে আজকের দিনে জন্মেছিলেন এই ব্যাটসম্যান।

    শুভ জন্মদিন, ভিক্টর ট্রাম্পার।

    ট্রাম্পারের এই ছবিটি তুলেছিলেন তাঁরই সমসাময়িক একজন ক্রিকেটার এবং ফটোগ্রাফার জর্জ বেল্ডহ্যাম। ছবিটির নামঃ Jumping Out For a Straight Drive.

6f39b20baafa850dedb484e9e9e72242

 

৬.

    পাঠক, এই পর্যন্ত যদি আপনারা ধৈর্য ধরে পড়ে থাকেন, তবে আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই  পারে, ট্রাম্পারই যদি বেস্ট হন, তবে ব্র্যাডম্যান কোথায় যাবেন? ৯৯.৯৪ গড়ের একজন খেলোয়াড় সেরা না হয়ে ৩৯ গড়ের একজন কীভাবে সেরা হন?

    সমস্যা হচ্ছে, পরিসংখ্যান অনেক কিছুই বলে, আবার অনেক কিছুই বলে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, মিথ্যা ৩ রকম। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।

    মারাকানা নামের ফুটবল তীর্থে হোম আর অ্যাওয়ে দুই দলের জন্য দুটো ড্রেসিংরুম আছে। দুই ড্রেসিংরুমের নামই দুজন বিখ্যাত ফুটবলারের নামে। অ্যাওয়ে টিমের ড্রেসিংরুমের নাম, ‘পেলে’। আর হোম টিমের ড্রেসিংরুমের নাম?

    ‘গ্যারিঞ্চা’।

    গল্পটা কেন বললাম?

    ৩ বিশ্বকাপজয়ী পেলেকে ব্রাজিলিয়ানরা মাথায় করে রেখেছে নিশ্চয়, কিন্তু গ্যারিঞ্চা আছেন তাদের হৃদয়ে।

    ঠিক তেমনিভাবে ব্র্যাডম্যানকে অস্ট্রেলিয়ানরা মাথায় করে রাখলেও ট্রাম্পার তাদের হৃদয়েই রয়ে গেছেন।