• ফুটবল

ভোলা দা, জিজি বুফন ও একটা ক্যারিয়ার

পোস্টটি ১৩৪৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.
আচ্ছা, দর্শকের ক্যারিয়ার বলতে কিছু আছে? অভিষেক, অবসর। শুরু, শেষ। বা বিদায়?


২.
ভোলা দা মাছের ব্যবসা করতেন। বাজারে একটা টিনের ছাউনির নিচে, দুইপাশে উঁচু কংক্রিটের পাটাতন। একটা বসার আসন, সে আসনেই ড্রয়ার। সেটাই ক্যাশবাক্স। ভোলা দাকে আমি সেভাবে দেখেছি। ওটা তার পেশা ছিল। এখন অবশ্য পৌরসভায় কাজ করেন। আর একটা নেশা আছে তার, ফুটবল। সাদা-কালো চর্মগোলকটা তাকে টানে। ম্যাচের দিন, খেলা শুরুর ঘন্টাখানেক আগে ভোলা দাকে মাঠে দেখা যেতো। লুঙ্গি-টি শার্ট। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কাঁচা-পাকা। চুলের অবস্থাও তাই। ভোলা দা এরপর হাওয়া হয়ে যেতেন কিছুক্ষণের জন্য।

খানিক বাদে তিনি নামবেন, পায়ে বুট, গায়ে জার্সি, হাতের গ্লাভস ঠিক করছেন। ক্লিন-শেভড, চুলে সাদার অস্তিত্ব নেই। মাছ ব্যবসায়ী ভোলা দা বিরামপুরের সবচেয়ে বড় নির্ভরতার নাম তখন। একটা আস্ত গোলবার কী অবলীলায় পাহারা দিতেন তিনি! আর খেলা টাইব্রেকারে গেলে তো কথায় নেই! টাইব্রেকার হতো সবসময় ঈদগাহর দিকের প্রান্তে। যাওয়ার আগে তিনি কথা বলছেন, হয়তো কোনও বন্ধুর সঙ্গে। ‘কয়টা, দুইটা? আচ্ছা।’

বিপক্ষ দলের একজন শট নিতে আসছেন, ভোলা দা, সেই গোলবারের নীচে দাঁড়িয়ে ইশারা করছেন, ‘এইটা!’ শটটা ঠেকিয়ে দিলেন এরপর। বিরামপুর উল্লাসে মাতলো, আমার মুগ্ধতা বাড়লো আরেকবার।


৩.
ফুটবল আমাদের কাছে ছিল মৌসুমী খেলা। ঘোর বর্ষা, যখন ক্রিকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ার উপায় নেই, চোর-পুলিশ বা ‘কতো দিনের লুকোচুরি কতো ঘরের কোণে’ যখন স্মৃতি, তখন বাধ্য হয়ে আমরা ফুটবলে লাথি মারতাম। ভাইয়া একবার একটা বল কিনে আনলো, আমার এখন পর্যন্ত একমাত্র ফুটবল! সে বলটাও মাঠের পাশের কাঁটা ফুটে ফেটে গেল দিন কয়েকের মাঝেই!

সেই খেলাতেও, ছোট মাঠের ফুটবলেও আমি গোলকিপার। আর কেউ জানতো না, আমি আসলে তখন ভোলা দা। প্রথম হাতে আঘাত পেলাম ওই গোলকিপিং করতে গিয়েই। পেনাল্টি, ছোট মাঠ বলে খুব কাছ থেকে শট। এক ভাই সেটা করলেন রীতিমতো পায়ের জোরে, ঠেকালাম বটে, তবে হাত ধরে ককিয়ে উঠলাম। আমি ভোলা দা হলাম কিছুক্ষণের জন্য। তবে পার্থক্য হলো, ভোলা দা পেনাল্টি ঠেকিয়ে দুইহাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন, সবাই গিয়ে তাকে কাঁধে তোলে। আর আমি শট ঠেকিয়ে ভোঁ দৌড় হাত চেপে, কোথায় যাব, কেন যাব, কিচ্ছু জানি না!

ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও ব্রাজিলের ভক্ত বনে গিয়েছিলাম। আরও অনেক কিছুর মতো, তার মতো আমারও প্রিয় ফুটবলার ছিলেন রোনালদো। আমাদের কাছে ফুটবল মানেই তখন ব্রাজিল, আমাদের কাছে স্ট্রাইকার মানেই রোনালদো। একবার তো দুইজন মিলে টি-শার্ট কেটে ব্রাজিলের পতাকা বানানোর ফন্দিও করেছিলাম। মা একটা ধমক দিয়ে টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সে টাকায় বানানো পতাকাটা এখনও আছে মায়ের আলমিরায়। সেবার ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আর তার আগে আমি ঘুমকাতুরে শিশু, ফ্রান্সের সঙ্গে রাত জেগে ফাইনাল দেখার সামর্থ্য নেই।


৪.
সব মিলিয়ে আমি ফ-তে ফুটবল মার্কা দর্শক। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ দেখি শুধু, গত বিশ্বকাপে সেটাও দেখেছি বেছে বেছে। আর বছরে দেখি একটা ম্যাচ, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। সেটা ২০০৬ সাল থেকে। ওই যে আর্সেনাল-বার্সেলোনা ফাইনাল, লেম্যান লাল কার্ড পেলেন। ব্রাজিল মুগ্ধতা আছে আমার, আর বার্সার রোনালদিনহো আছে। বার্সা বোধহয় আমার শেষ সমর্থন পেয়েছিল সেবারই! আমি তখনও নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের সমর্থক হইনি। কোন ক্লাবের সমর্থক কেউ জিজ্ঞাসা করলে, আমি তখনও বলতাম, আবাহনী!

এই চার বছরের চক্রর একটা ব্যত্যয় ঘটে। ইউরো এলে। আমি ইউরোর ম্যাচ দেখি, ইতালির খেলা দেখি।

ছোট থেকে গল্প শুনেছি, রবার্তো বাজ্জিওর। ১৯৯৪ সালের ফাইনালে টাইব্রেকারে তার শটটা কিভাবে গোলবারকে ফাঁকি মেরে অনেক ওপর দিয়ে গিয়েছিল, আমার আর্জেন্টিনা সমর্থক বড় ভাই সেটাই শোনাতেন। তার সেই মিস ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল, সেটাই তার আফসোসের কারণ ছিল না শুধুই হয়তো। হয়তো বাজ্জিওর সেই কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলের ভক্ত ছিলেন আমার ভাই!

আমার প্রথম দেখা ইতালির ভক্ত এলিশিউস দা। বিজন কাকার দোকানের কর্মচারী ছিলেন তিনি, এখন নিজেরই একটা দোকান আছে। বিজন কাকার দোকানে আমি ২০০২ সালের ফাইনালটা দেখেছিলাম। শুধু ফাইনাল কেন, ব্রাজিলের সব ম্যাচই তার দোকানে বসে দেখা। সেই এলিশিউস দা সেবার বড্ড কষ্ট পেলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ইতালির সেই বিতর্কিত ম্যাচে আজ্জুরিদের ইচ্ছে করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে বলেই মত ছিল তার। তার খোলা চোখেও ধরা পড়েছিল ব্যাপারটা। জিজি বুফন তখন সদ্য জুভেন্টাসে যোগ দেওয়া তারকা, সেটা জেনেছি আরও পরে।

এলিশিউস দা, যাকে আমরা ডাকতাম এলসি দা বলে, তার সঙ্গে অনেকদিন দেখা নেই। এর মাঝে কয়েকটা ইউরো চলে গেছে, জুভেন্টাস ম্যাচ পাতানোর দায়ে দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গেছে, ইতালি বিশ্বকাপ জিতেছে। এককালের ব্রাজিল ঘাতক জিদানের ফ্রি-কিকটা কিভাবে ঠেকিয়ে দিলেন সেই গোলকিপার! জুভেন্টাস ফিরে এসেছে, সিরি আ জিতেছে, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছে, ইতালিও খেলেছে ইউরোর ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল। আর ধীরে ধীরে, সেই বুফন হয়ে উঠেছেন ইতালির সমার্থক।

আর বুফন হয়ে উঠেছেন আমার প্রিয় ফুটবলার।  এই প্রিয় ব্যাপারটার আসলে সংজ্ঞা কী? কতোদূরে কোথাও খেলছেন, মাথার চুলটা ব্যান্ডে আটকিয়ে রাখছেন, শট ঠেকিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে সান্ত্বনা বা অভিনন্দন দিচ্ছেন, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, উল্লাসে মাতছেন! অথচ, এ কাজগুলো প্রিয় কেউ করলে কেমন মনে হয়, যেন আমিও আছি! ঠিক সেখানেই! অদ্ভুত ব্যাপার। বুফনকে ঘিরে ইতালি হয়ে উঠেছে প্রিয় দল, বুফনকে ঘিরে জুভেন্টাসের দিকে গেছে বাড়তি নজর! বুফন আমার কাছে তখন ভোলা দা। অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু!

২০১২ ইউরোর সেমিফাইনাল। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধের কঠিন এক হিসাব আমার সামনে। আমি সব ভুলে থাকি। হিজিবিজি আঁকি, এশিয়া কাপে বাংলাদেশের হাসি কান্নার শরিক হই, হুমায়ূন আহমেদকে বিদায় জানাই। আর ইউরো দেখি। মধ্যরাতে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমার বুফন টাইব্রেকারে শট ঠেকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে আমারই ভোলা দাকে মনে করিয়ে দেন, অথবা ভুলিয়ে দেন। পিরলো জাদু দেখান, জিদানকে মনে করিয়ে দেন, অথবা ভুলিয়ে দেন। জার্মানীকে তাদের মতো করে হারায় ইতালি। স্পেনে গিয়ে আটকে যায়। আমার ডেস্কটপের ওয়ালপেপারে বুফন আসেন, তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা বল, যেটা পরে গোল হবে। আমার ফোনে ওয়ালপেপার হিসেবে একজন ফুটবলারই থাকেন। ওই জিজি। 

চার বছরে কতো কিছু ঘটে যায়। একটা আস্ত বিশ্বকাপ পর্যন্ত চলে যায়। ইউরো আসে আরেকটা। আরেকটা টাইব্রেকার, এবার জার্মানী। লম্বা শুট-আউট। অসাধারণ সেভ, দুর্দান্ত লাইন প্রেডিকশনের পরও ইতালি হারে। ইউরো থেকে বুফন বিদায় নেন। আরেকটা ইউরো চার বছর পর, ততোদিনে কি আর তিনি খেলবেন! আমি প্যাভিলিয়নের ইতালি ভক্ত ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে জীবন বোঝান। অথচ তার আবেগটা আমার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা!


৫.
বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আসে। আর্জেন্টিনা খেলবে কি খেলবে না, রীতিমতো যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব একটা। আমি এক বন্ধুকে সান্ত্বনা দিই, ‘হয়ে যাবে!’ এ ডামাডোলেই প্লে-অফের খাঁড়ায় পড়ে যায় ইতালি। সুইডেন। আমি শুধু খবরই রাখি, কবে খেলা, কী হলো! দেখা হয় না। আমি যে ফ-তে ফুটবল মার্কা দর্শক!

সেই ভাই আমাকে একটা ফুটবল গ্রুপে অ্যাড করেছিলেন। বাংলাদেশ ইতালি ভক্তদের এক গ্রুপ। দ্বিতীয় লেগের আগে একটা পোস্ট দেখি সেখানে। একজন ডাক্তারি পড়ছেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাইভা আছে সকালে। এর মাঝেই রাতে খেলা, বিশ্বকাপ খেলার প্রশ্ন সেখানে! তারা পরিবারসুদ্ধু ইতালি ভক্ত, পড়ে গেছেন দোটানায়। ফুটবল, বিশ্বকাপ, নাকি নিজের ক্যারিয়ার! আমি আমার আবেগকে আরেকবার ঠুনকো ভাবি। তবে খেলা দেখার সাহস করতে পারি না। বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল, আর ইউরো থাকলে সেটা তো দেখিই, এর বাইরে দেখে কিইবা হবে!

পরীক্ষা-টরিক্ষা আমারও ছিল। আমি সেটা ভুলে, ইতালিকে ভুলে, বুফনকে ভুলে ঘুমিয়ে পড়ি।

 

৬.
ঘুম ভেঙ্গে প্যাভিলিয়নের খবরে চোখ যায় আগে। বুফনের ছবি ভেসে ওঠে। আমি সামলিয়ে নেই। সেই ভাই, যাকে আমি দা বলে ডাকি, তাকে আবার নক করি। দা আমাকে জীবন বোঝান।

সারাদিনে কতো ছবি ভেসে বেড়ায়। শুধুই কান্না। শুধুই আবেগ। সে আবেগে ভর করে আমার ঠুনকো আবেগ ঝাঁকি খায়। ভোলা দা অনেক আগেই খেলা ছেড়েছেন। আমি তাকে ফেলে এসেছি। জিয়ানলুইজি বুফন আজ একটা ক্যারিয়ার শেষ করে ফেললেন। আমার দর্শক ক্যারিয়ারের একটা অংশেরও কি ইতি ঘটলো?

আচ্ছা, দর্শকের ক্যারিয়ার বলতে কিছু আছে? অভিষেক, অবসর। শুরু, শেষ। বা বিদায়?