• ফুটবল

শুভ জন্মদিন, নেইমার।

পোস্টটি ১৮২৬৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সময়কাল, ২০১৬ সালের এপ্রিল-মে। পাঁঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সামনে দুইটা মেজর টুনার্মেন্ট, শতবর্ষী কোপা আমেরিকা আর অধরা স্বর্ণপদকের অলিম্পিক। ব্রাজিল, যে নামের মাঝেই লুকায়িত ফুটবলের যত সফলতার সকল বিশেষণ; অথচ সেই দলটারই কিনা নেই অলিম্পিক স্বর্ণপদক!! ২০১৬ - রিও অলিম্পিক, অধরা স্বপ্নপুরণে বুঁদ পুরো ব্রাজিলবাসী, আর সেই স্বপ্নপুরণের কান্ডারি একজনই, নেইমার, নেইমার ডা সিলভা সান্তোস জুনিয়র।

 

ক্লাব বার্সেলোনা'র নিয়মের বেড়াজালে নেইমারকে অইসময় যেকোন একটি টুনার্মেন্টকে বেছে নিতে হয়, হয় তিনি কোপা আমেরিকা খেলবেন নতুবা অলিম্পিক; দুইটি টুনার্মেন্টই খেলার ছাড়পত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় বার্সা ম্যানেজমেন্ট। নেইমার তখন বেছে নেন, অলিম্পিক কে। সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসা মানুষটা নিজের কাঁধে নিয়ে নেন দায়িত্বটা, অধরা স্বপ্ন পুরণের দায়িত্ব, পুরা ব্রাজিলবাসীর মনের কাঙ্ক্ষিত লালিত স্বপ্ন পুরণের দায়িত্ব, নিজ দেশকে একটি স্বর্ণপদক পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব।

 

দিনটা ছিলো, একই বছরের আগস্ট মাসের ৮ তারিখ। স্টেডিয়ামের কোন এক কোনায় এক দর্শক নিজের হলুদ জার্সিতে নেইমারের নাম কেটে দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন ফুটবল কুইন মার্তার নাম, ব্রাজিলের সকল পত্র-পত্রিকায় চলছে নেইমার তথা পুরা ব্রাজিল দলের সমালোচনা, টেলিভিশন-রেডিওগুলোতে সমালোচনায় পৃষ্ট করে দেয়া হচ্ছে নেইমার কে, ব্রাজিলের সাবেক লিজেন্ডরা প্রশ্ন তুলছিলেন নেইমারের দায়িত্ববোধ নিয়ে, নেইমারের সক্ষমতা নিয়ে, টুইটার টুইটম্বুর #Neymar_out হ্যাশট্যাগে; ব্রাজিল যে পরপর দুই ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে খাদের কিনারায়!! নেইমার ছিলেন নিষ্প্রভ, ছিলেন নিশ্চুপ'ও। যে দেশকে গত ৬ বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করছেন নিজে, যে দলকে টেনেছেন এক হাতে, যে দেশের জার্সি গায়ে খেলার সময় পঙ্গুত্ব বরণ করার ঝুঁকিতেও পড়েছেন, সেই নিজ দেশের মানুষই কিনা আজ সব ভুলে তার সমালোচনায়, তার নাম বাদ দিতে ব্যাস্ত!!

 

২০১২ তে লন্ডন অলিম্পিকে জুডোতে ব্রাজিলকে রিপ্রেজেন্ট করা ফেভারিট  রাফায়েলা সিলভা প্রিলিমিনারি রাউন্ডেই  ডিসকোয়ালিফাই হওয়ায় যখন সে প্রচুর ক্রিটিসাইজড হতে থাকে তখন শত শত দুয়ো ধ্বনির মাঝে তার দেশের ফুটবল টিমের এক প্লেয়ার সান্তনা কিংবা সম্ভাবনার বানি শুনিয়েছিলেন তাকে "Train to realize your dream in Rio 2016..", ঠিক চারবছর পর রিও ২০১৬ তে সেই ডিসকোয়ালিফাইড রাফায়েলা সিলভাই ব্রাজিলকে এনে দিয়েছিলেন আসরের প্রথম সোনার সাদ!!

 

একজন নেইমার তো এমনই, একজন নেইমার তো হেরে যাওয়ার পাত্র নন, নেইমার তো পিছিয়ে পড়ার পাত্র নন, জন্ম থেকে জীবনযুদ্ধে চরম চড়াই উৎরাই পার করে জয়ী হউয়া এক নায়কের নামই ত নেইমার, মনে বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করে চেস্টা করে যাওয়ার নামই ত নেইমার, তার তো চ্যালেঞ্জ ভুলে গেলে চলেনা, তার তো যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়লে চলেনা!!

 

নেইমার নামলেন, লড়লেন, জিতলেন। নিজের অসাধারণ পারফরমেন্স দিয়ে ডেনমার্ক, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস কে হারিয়ে দলকে তুললেন ফাইনালে। প্রতিপক্ষ জার্মানি। 

 

জার্মানি, ৭-১ ট্রাজেডির পর, এক জুজু'র নাম। সেই ভয়, পুরা ব্রাজিলবাসীর প্রত্যাশার চাপ, মিডিয়ার চাপ, নেইমারের শত সমালোচনার জবাব দেয়ার চাপ, নিজেকে আরো একবার প্রমাণ করার চাপ। খেলা চলছে। ২৭ মিনিটে নেইমারের অসাধারণ এক ফ্রি কিকে লিড পেলো ব্রাজিল। ৫৯ মিনিটে মেয়েরে'র গোলে সমতা আনল জার্মানি। বাকী গল্প কেবলই  পাল্টাপাল্টি আক্রমণ এর। দুই দলেরই মুহুর্মুহু আক্রমনের মাঝ দিয়ে শেষ হয় ১২০ মিনিটের খেলা। ট্রাইব্রেকারে গড়ালো ম্যাচ। দুদলেরই পরপর ৪ টি শ্যুট গোলে পরিণত হয়। ৫ নম্বরটি নিতে আসেন জার্মানির, ব্রাজিলের গোলরক্ষক উইভারটন অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দিলেন শট'টি। ৫ নম্বর শটটি নিতে আসলেন, নেইমার। পুরো মারাকানা জুড়ে পিনপতন নিরবতা, কপালে চিন্তার ভাজ, নেইমার কি পারবে শটটি গোলে পরিণত কররে, নেইমার কি পারবে পুরা ব্রাজিলে খুশির জোয়ার বয়ে দিতে, নেইমার কি পারবে অপুর্ণতা ঘোঁচাতে!! নেইমার আসলেন, খানিক বাদে অঝোর নয়নে কেঁদে ফেললেন, নিরবতা ভেংগে মারাকানা জুড়ে নেমে আসল উচ্ছাসের চিৎকার, ব্রাজিলের সকল খেলোয়াড় অধরা কে হাতে পাওয়ার উদযাপন এ মহারণ তৈরী করলেন। নেইমার যে এত বছরের অপুর্ণতা ঘোচালেন, সমালোচনা কে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে দিলেন জবাব। 

শুধু কি এটুকুই?? ২০১০ সালের পর থেকেই তো সেলেসাদের জিইয়ে রেখেছেন নেইমার। দলকে টেনেছেন নিজ হাতে। ১৩ সালে কনফেডারেশন্স কাপ জিতিয়েছেন। ১৪ বিশ্বকাপে যখন উড়ছিলেন নিজ আলোয়, তখনই মারাত্মক এক ইঞ্জুরি তে পড়ে শেষ হয়ে যায় সব আশা। ইঞ্জুরি থেকে ফিরেছেন, হলুদ জার্সিকে নিজের মত করেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

বার্সা পিএসজি'র কোয়ার্টার ফাইনালের কথা মনে আছে?? প্রথম লেগে বার্সা যখন ০-৪ গোলে হেরে ফিরল প্যারিস থেকে, বিশ্বের নামিদামী ফুটবলার যখন মক করা শুরু করল, তখন অসম্ভব কে সম্ভব করার প্রত্যায় নিয়ে নেইমার বললেন, 1% chance, 99% faith.. বাকীটা তো কেবল ইতিহাস। নেইমার তো এমনই। জীবনটা যার কাছে চ্যালেঞ্জের মত, যিনি আত্মবিশ্বাসী, যিনি পরিশ্রমী, যিনি অসম্ভব কে সম্ভব করতে জানেন, চরম চাপ নিতে জানেন। প্রতিনিয়ত যিনি পারফরমেন্স দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য এক উচ্চতায়।

 

যাত্রাটা শুরু হয়, আজ থেকে ২৬ বছর আগে। ১৯৯২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের মগি দাস ক্রুজেসে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নেইমার। নেইমাররের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটদের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া। নেইমারের বাবা নেইমার সিনিয়রের'ও ইচ্ছা ছিলো ফুটবলার হউয়ার, কিন্তু দারিদ্র্যের গ্যাঁড়াকলে সে স্বপ্ন পুরণ হয়নি তার। ভাগ্যান্বেষণে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট থেকে ১৯৯২ সালে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রজেস শহরে এসেছিলেন তিনি। ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে জুনিয়র নেইমার। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ জয়। যার প্রমাণ মেলে স্থানীয় ‘পর্তুগীজা সানটিস্টা’ ফুটবলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে। তখনই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবিশ্ব শাসন করতে আসছে আরও একজন বিস্ময়বালক। মূলত সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় সেদিনের ছোট্ট নেইমারের। নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন। পেশাদার ফুটবলের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিতি ব্রাজিলের বর্তমান স্বপ্নদ্রষ্টার। সেদিনের নেইমার আজ বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়। 

 

নেইমার তো এমনই। কতশত লাখো কোটি ভক্তের নয়নের মণি। নেইমার তো এমনই। কতশত লাখো কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা। দরিদ্র এক ঘর থেকে উঠে এসে ব্রাজিল কে ফুটবলবিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করা, নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করা নেইমার - কতশত যুবক বালকের এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা। কতশত লাখো কোটি হতাশাগ্রস্থ মানুষ স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচার নেইমারের "1% chance, 99% faith" এ, পায় সফলতা অর্জনের দীপ্তিময় সাহস। 

 

৫ ফেব্রুয়ারি, নেইমারের ২৬ তম জন্মদিন। কেবল তো ২৬!! জানি, নেইমার এগিয়ে যাবে অনেক দূর। নিজেকে নিয়ে যাবেন অনন্য অসম্ভব এক উচ্চতায়, নাম লেখাবেন কিংবদন্তিদের তালিকায়। আস্থা বিশ্বাস স্বপ্ন, নেইমারের হাতেই আসবে ব্রাজিলের ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ, নেইমারর পায়ের জাদুতেই পুরণ হবে হেক্সা জয়ের বাসনা। শুভকামনা, নেইমার।