• ফুটবল

এক্সেটার ফুটবল ক্লাব ও ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলের আত্মপ্রকাশ

পোস্টটি ১৩৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সাফল্যগাঁথায় ফুটবল বিশ্বের সেরা দল ব্রাজিল। ধ্রুপদী ফুটবল আর সাম্বার জাদুতে যুগে যুগে অসংখ্য ফুটবলার সৌন্দর্য ছড়িয়েছন ব্রাজিলের হয়ে; পেলে, গারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস, জিজিনহো, রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, কাকা'র মতো মহারথীদের আঁতুড়ঘর পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলের সাফল্যগাথার গল্প সবাই জানি, কিন্তু কবে কিভাবে এই ব্রাজিল নামক দলের পথচলা শুরু, সেই গল্প হয়তো অনেকেই জানিনা! 

 

এক্সেটার ফুটবল ক্লাব! ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একটি প্রাচীন শহর এক্সেটার। ৪৭ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরের একটি পুরাতন ক্লাব, যার নাম এক্সেটার ফুটবল ক্লাব! ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ক্লাবটি এখন ইংলিশ ফুটবলের চতুর্থ সারির লীগে খেলে থাকে! 

 

হয়তো ভাবছেন, ব্রাজিল ফুটবলের গল্প শোনাতে গিয়ে ইংল্যান্ডের অপরিচিত এক ক্লাবের গল্প কেনো টানছি! আশ্চর্য হলেও সত্যি, ব্রাজিল ফুটবলের স্বর্ণাক্ষরে লেখা ইতিহাসের শুরু গল্পের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে ১২২ বছরের পুরানো এই ক্লাবটার নাম; এক্সেটার ফুটবল ক্লাব! 

 

জুলাই, ১৯১৪! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এক্সেটার ফুটবল ক্লাব ব্রাজিলে পৌঁছায়! এর আগে ইংলিশ এফ এ আর্জেন্টিনার নাসসেন্ট ফুটবল কমিউনিটি থেকে একটি ইনভাইটেশন পায়, যেখানে তারা একটি ক্লাবকে নোমিনেট করতে বলে যারা বুয়েন্স আয়ার্স সফর করবে এবং লোকাল বেশ কয়েকটি কমিউনিটির সাথে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে! সেসময়ে ইংলিশদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে এক্সেটার'কে বেঁছে নেওয়া হয়! মাত্র ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্লাবটির জন্যে এই সফরটি অর্থ উপার্জনের ভালো মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়! ইংল্যান্ডে ততদিনে ক্লাব ফুটবল এসোসিয়েশন অর্ধ শতাব্দী পেরিয়েছে, দক্ষিণ আমেরিকায় তখনো সেভাবে কোন এসোসিয়েশন গড়ে উঠেনাই! ঐ সময়ে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা কিংবা উরুগুয়েতে ইংল্যান্ডের যেকোন দল'কে বীরের মত করে সাদরে গ্রহণ করা হতো! 

 

২২ মে, ১৯১৪! ১৫ সদস্যের স্কোয়াড সাউদাম্পটন ছেড়ে যায়, ব্রাজিলের রিও ডি জিনেইরো'তে পৌছায় ১৮ দিন পরে! এর মাঝে যাত্রাবিরতিতে সান্তোসে এক্সেটারের পুরো স্কোয়াড পুলিশের হাতে এরেস্ট হোন এক সৈকতে গোছল করার দায়ে, যে সৈকতে গোছল করা ছিলো নিষিদ্ধ! পরবর্তীতে ব্রিটিশ কুটনৈতিকদের চেস্টায় তারা মুক্ত হোন! এরপরে তারা আর্জেন্টিনায় ৮ টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন। দেশে ফেরার ঠিক আগেই আরো একটি ইনভাইটেশন পায় তারা, ব্রাজিল থেকে সাও পাওলো এবং রিও ডি জিনেইরো তে ৩ টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার নিমন্ত্রণ পায় ক্লাবটি। এক্সেটার অফিশিয়ালরা তখন ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেও অল্পসময়ের জন্যে বর্ধিত করতে পারেন। যার ফলে মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিলো এক্সেটারের কাছে! 



রিও ব্রাজিলের রাজধানী শহর হলেও, সাও পাওলো সমানভাবে ব্রাজিলে আধিপত্য রাখতো! তাই দু শহর'র চাচ্ছিলো নিজেদের খেলোয়াড়দের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচ আয়োজনের। শেষমেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, দুই শহরের খেলোয়াড় নিয়েই একটি দল গঠন করা হবে; এরপরে দুই শহরের খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়, যাকে অন্যভাবে বলা যায় ব্রাজিল জাতীয় দলেরই প্রথম আত্মপ্রকাশ! দলগঠনের এই প্রক্রিয়াকে ডাকা হয়েছিলো "সেলেসাও" নামে, পর্তুগীজ এই শব্দের অর্থ হলো "বাছাই করা"! পরবর্তীতে এই নামটিই রয়ে যায় ব্রাজিল জাতীয় দলের ডাকনাম হিসেবে! 

 

জুলাই ১২, ১৯১৪! সেলেসাওরা তাদের প্রথম ম্যাচ খেলে এক্সেটারের বিপক্ষে, রিও'র এস্তাদিও দাস লারানজেইরাসে! সেসময় লোকাল পত্রিকাগুলো এই ম্যাচ'কে ঘিরে ব্যাপক প্রচারণা চালায়, আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে! তারা এক্সেটার'কে সুপারহিরোদের দল বলে আখ্যা দিচ্ছিলো, ঠিক যেনো পুরো দেশ জুড়ে ফুটবলের বেদবাক্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ভিনগ্রহ থেকে কোন সুপারহিউম্যানদের দল এসে পাড়ি জমিয়েছে ব্রাজিলে! ধারণক্ষমতা স্বল্পসংখ্যক হলেও অন্তত ১০০০০ জন সেদিন মাঠে খেলা উপভোগ করেছিলো! 

 

সেদিনের সেই ম্যাচে সেলেসাওদের জয় এসেছিলো ২-০ গোলে! ম্যাচ শেষে দর্শকেরা কাঁধে করে খেলোয়াড়দের নিয়ে মিছিল করেছিলেন! ব্রাজিলের প্রথম সুপারস্টার খ্যাত আর্থুর ফ্রিডেনরিক সেদিন ফাউলের স্বীকার হয়ে দুটি দাঁত হারিয়েছিলেন! 

 

সেদিন ফুটবল নামক জিনিসটা ব্রাজিলিয়ানদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে গিয়েছিলো, যেখান থেকে সারা দেশব্যাপী ফুটবল ছড়িয়ে পড়ে! ফুটবল হয়ে যায় ব্রাজিলিয়ানদের প্রধান খেলা! উক্ত ম্যাচের কয়েকবছরের মাঝেই ফুটবল ব্রাজিলিয়ানদের অস্তিত্বে মিশে যায়, মিশে যায় ধর্মে! ব্রাজিল, সাম্বা, ফুটবল যেনো একে অন্যের নামান্তর হয়ে যায়! ফুটবল হয়ে উঠে সার্বজনীন এক খেলা! 

 

এক্সেটার ইংল্যান্ডে ফেরার পরে উক্ত দলের প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড়ই কোন না কোনভাবে বিশ্বযুদ্ধের থাবায় আক্রান্ত হোন। ডিক পাইম, যিনি সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন, যিনি কিনা ১৯২৩ সালে এফ এক কাপ জিতেছিলেন বোল্টোনের হয়ে!

 

এইত কিছু বছর আগে, ২০১৪ তে দক্ষিণ আমেরিকা সফরের ১০০ বছর পুর্তি উপলক্ষে এক্সেটার ফুটবল ক্লাব ব্রাজিলে ফ্লুমিনেন্স অনুর্ধ্ব ২৩ দলের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন! ১৯১৪ সালের সেই ম্যাচের বল, যা কিনা ফ্লুমিনেন্সের জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিলো, তা দিয়ে উক্ত ম্যাচের কিক অফ করা হয়!

 

এক্সেটার তাদের সেসময়কার স্মৃতি রোমন্থনে শতবর্ষ পুর্তিতে ব্রাজিল সফরে গিয়েছিলো, ব্রাজিলের ইতিহাসের সুন্দর অংশ, যা কিনা চিরন্তন, চির অম্লান এবং সেলেসাওদের জন্যে প্রতিকী হয়েই থাকবে! সেদিন আত্মপ্রকাশ পাওয়া ব্রাজিল এখন অব্দি অনুষ্ঠিত হওয়া প্রত্যেক বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে, ৫ টি বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছে, পৌছে গেছে সফলতার চরম শিখরে! যদিও এক্সেটার কখনো লীগের তৃতীয় ডিভিশনের উপরে যেতেই পারেনাই! কিন্তু তাদের সম্প্রতি সবচেয়ে আনন্দঘন সাফল্য ধরা হয়, ২০১৬'র জানুয়ারিতে এফ এ কাপের তৃতীয় রাউন্ডে লিভারপুলের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করা ম্যাচটিকে! 



কিন্তু তাতে কি ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম দলটির স্বর্ণাক্ষরে লেখা ইতিহাসের সাথেই উচ্চারিত হবে এক্সেটার ফুটবল ক্লাবের নাম, যাদের বিপক্ষেই কিনা আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো আজকের ব্রাজিলের!