শোনো হুংকারে!
পোস্টটি ১০৩৩৭ বার পঠিত হয়েছেঅসাধারন! অবিশ্বাস্য!
অতি ব্যবহারে শব্দগুলো হয়তো অনেক ক্লিশে শোনাবে। কিন্তু এই ম্যাচকে নিয়ে লিখতে হলে প্রথমে মাথায় আসে এই দু’টি শব্দই। অনেকদিন মনে রাখার মত কিছু মুহূর্ত। অনেকদিন বলার মত কিছু মুহূর্ত। ভবিষ্যতের আত্মবিশ্বাসের যোগান হবার মত কিছু মুহূর্ত।
কতটুক সেটা? ৪০ ওভারের টি-২০ ম্যাচে?
কি ছিলো না এই ম্যাচে! দূর্দান্ত শুরু করেও মাঝপথে শ্রীলংকান ব্যাটসম্যান কুশাল পেরেরা এবং থিসারা পেরেরার কাছে লাগাম হারিয়ে ফেলা, অনুমিত ছোট স্কোরকে পাহাড়সম হতে দেখা তাদেরই হাতে। ব্যাটিং এও প্রথমে ধুঁকেছে বাংলাদেশ দল। শুরুতেই লিটনের উইকেটে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যাওয়া, তার কিছু পরই ওয়ানডাউনের মত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে আসা সাব্বিরের বিদায় কিছুটা চিন্তার ভাজই ফেলেছিলো টাইগার সমর্থকদের কপালে। শেষদিকে ক্রমাগত উইকেট হারিয়েও পাহাড়সম চাপকে ঠেলে আসা জয়, শেষ ওভারে দুই শিবির থেকেই উত্তেজনার ছড়িয়ে যাওয়া দুই দেশেরই সমর্থকদের মাঝে। কি ছিলো না এই ম্যাচে? অবিশ্বাস্য এই জয়। অবিশ্বাস্য!
আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ! গত লেখাতেই লিখেছিলাম, মুশফিক-রিয়াদের একজন (রিয়াদ) শাপমোচন করেছেন বেশ কয়েকবার, বাকি ছিলো অন্যজনের (মুশফিক), যা তিনিও করেছেন গত জয়ে প্রধান ভূমিকা রেখে। রিয়াদ নিজে কি ভাবেননি তাঁরটুকু? তিনি কি ভেবেছিলেন পাপমোচন হয়নি তাঁরও? নাহ, এভাবে লিখলে পাপ হবে আমার। রিয়াদেরা সৈনিক। তাঁরা প্রতি ম্যাচেই জিততে নামেন। তাঁরা দলের জন্যই খেলেন, নিজের জন্য নয়। যখন শেষদিকের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়, তিনি থাকেন। যখন ঝড় তুলতে হয়, তিনি থাকেন। পাদপ্রদীপের আলোয় থাকেন কমই, কিন্তু তিনি থাকেন।
আজ তাঁর সম্পুর্ন ক্যারিয়ারের সমস্ত আলোই কি টেনে নেননি তিনি নিজের উপর? মাত্র ১৮ বলে ৪৩ রানের অপরাজিত দূর্দান্ত ইনিংস, সংখ্যাগুলোও বোঝাতে অক্ষম ইনিংসটির মাহাত্ম্য। শেষদিকে তিনি চাননি ২০১২ সালের পুনরাবৃত্তি হোক, তিনি চাননি নন-স্ট্রাইকে থেকেই দেখে যাবেন দলের পরাজয়। মরিয়া হয়ে চাইছিলেন উদানার মুখোমুখি হতে। স্পষ্ট দ্বিতীয় বাউন্সারেও আম্পায়ারের নো-বল না ডাকা, একসময় মনেই হচ্ছিলো বাংলাদেশ প্রতিবাদ করে মাঠ থেকে উঠে আসবে। এই ম্যাচেই রিয়াদের হাত থেকে অধিনায়কত্ব ফিরে পাওয়া সাকিবের মুখের ভাষাও পড়া যাচ্ছিলো পরিষ্কার “উঠে আসেন, রিয়াদ ভাই”। মাঠে তখন ধুন্দুমার উত্তেজনা দুই শিবিরে। বাকি ছিলো ৪টি বল, ১২ টি রান। কঠিন সমীকরন। তার মধ্যেও কিভাবে এত চাপ সামলালেন তিনি? এক বল বাকি থাকতেই দূর্দান্ত ফ্লিকে আসা ছয়! মুষ্ঠিবদ্ধ লাফিয়ে উঠা উল্লাস!
অবিশ্বাস্য এই ম্যাচ! স্মরনীয় এই ম্যাচ! প্রতিদিন বলার মত এই ম্যাচ!
জয়ের দিনে লিখতে ইচ্ছা করছে না, তবে কিছু লিখবো ভেবে রেখেছিলাম প্রথম ইনিংস শেষেই। ব্যক্তিগতভাবে, আমি সাকিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তবে কাল শিবিরে ফেরার পরই পরিচিত এক মহলে বলেছিলাম, এ এক মধুর সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শ্রীলংকা ম্যাচের জন্য অবশ্যই রিয়াদের কিছু পরিকল্পনা থাকবে। সাকিব যাচ্ছেন হুট করে। তবে দুইজনই অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং স্মার্ট ক্রিকেটার হওয়ায় সামলিয়ে নিবেন, যেটা নিয়েছেনও দুইজন মিলে। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের হাত থেকে ব্যাটন নিবেন তিনি সেটাই স্বাভাবিক। এমনিতে দলের জন্য ব্যাট হাতে এবং বল হাতে সাকিবের কোন বিকল্প নেই। দলের সেরা খেলোয়াড়ের ফিরে আসার দিনে পুরো দলের বিশ্বাসও ফিরে আসে এরকম মুহুর্তে। তবে একজন বোলার নিয়ে তাঁকে ১ ওভারও বল করতে না দেওয়াটা দৃষ্টিকটু দেখায়, বাহ্যত বাংলাদেশ তখন ১০ জনেরই দল। নিজেও ফিরে আসার দিন প্রমান করেছেন আবারো তাঁর বল হাতে সামর্থ্য! তাঁর হাতেই আসে প্রথম উইকেট, আঁটোসাটো বল করে প্রথমেই বাধা দেন শ্রীলংকার ব্যাটিং গিয়ারে। অথচ তিনি নিজেও পরে আর বল হাতে নেননি। যাঁকে বল দেওয়া হয়নি, এবং তিনি, দুইজনই বাঁহাতি স্পিনার। উইকেটে তখন দুইজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। এই কারনেই যে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে উইকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকলে বাঁহাতি স্পিনারের বল করা যাবে না, তত্ত্বটা বড্ড বেমানান এই যুগে। শুধু ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য বাঁহাতি স্পিনার, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য ডানহাতি স্পিনার, এতটা লাটসাহেবীপনা বাংলাদেশ কেন, বিশ্বজয়ী কোন দলকেও মানায় না।
যাক, শেষ মুহুর্তে যেহেতু জয়ীদের শিবিরেই থাকছি, এই ব্যাপারে আর কথা বাড়াবো না। আজ রাত গৌরবের! আর রাত বিজয়োল্লাসের! আজ রাত আমাদের!
বাংলাদেশের প্রাক্তন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নিজ দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বেশ একটু রেশারেশি এই দুই শিবিরে, যার পূর্নতা পায় তার কিছুদিন পরই হয়ে যাওয়া ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের হাতে বিপর্যস্ত হয়েও বাংলাদেশকে হারিয়ে শ্রীলংকার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়। নিদাহাস ট্রফি শুরুর সময়ও তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভালো খেললেও ফাইনাল খেলবে ভারত – শ্রীলংকা। আজ তারা নিজ দেশের ফাইনালেই দর্শক! ভাগ্যের কি খেল!
কোবরা, বা নাগিন ড্যান্স। একেবারেই ব্যক্তিগত একটি উদযাপন। বাংলাদেশি স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু আগেও উইকেট পেলে এই উদযাপন করেছেন। বিপিএলে নিয়মিত দেখা গিয়েছে। শ্রীলংকা শিবিরের এটিকে ধরে বসাটা দেখাটা ছিলো বিরক্তিকর। যেকারনে বাংলাদেশ হারলে শ্রীলংকা দলকে এই নাচ দিতে দেখা যায়, ফলশ্রুতিতে পরের ম্যাচ জিতে মুশফিকও ফিরিয়ে দেন তাদেরকে এই মুহুর্তটি। আজ দেখলাম প্রতিটি উইকেটে ভরা গ্যালারীর এই উদযাপন। নাগিনের জবাবে বাসুরীয়া উদযাপন। নিছক একটি উদযাপনকে নিজেদের গায়ে টেনে নেওয়ার অর্থ কি? অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো তারা নিছক একটি উদযাপনকে। দিনশেষে, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়ই। মোক্ষম জবাব! আমরা যদি আজ পরাজিত শিবিরে থাকতাম, কি দেখতে হতো বিদ্যচোখেই দেখতে পাচ্ছি। হেরে যাওয়ায় কিছুটা হলেও দেখেছে শ্রীলংকা শিবির। তার কিছু আগেই মাঠে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহে এই উদযাপন নিশ্চয়ই আরো আগুন ধরিয়েছে তাদের গায়ে!
এই প্রসংগও থাক বরং। এরকম আনন্দের দিনে ছোটখাটো এসব মুহুর্ত মনে রাখতে নেই। আজ আনন্দের রাত। আজ উদযাপনের রাত। হাথুরুসিনহারই মাটিতে তারই দলকে দর্শক বানিয়ে দেওয়া কিছুটা হলেও কি ত্রিদেশীয় সিরিজের ক্ষতে প্রলাপ দেয়নি?
দর্শকমহলের অনেকের কাছেই টুর্নামেন্ট শুরুতে ‘টি-২০ তে বাতিল মাল’ হিসেবে বিবেচিত তামিমের আরো একটিবার নিজেকে প্রমান করা। নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে চেনানো মুশফিকুর রহিম। সাকিবের ফেরা। রিয়াদের অতিমানবীয়, দূর্দান্ত জবাব! প্রাপ্তির খাতায় থেকে যাচ্ছে অনেককিছুই! ভারত, প্রস্তুত থাকুক, আমরা ফিরছি।
আজ রাতে অনেকের ঘুম হবে চমতকার! সেই খাতায় নিশ্চিতভাবেই থেকে যাবে মুশফিক-রিয়াদের নাম।
দেশজুড়ে চলুক তবে নাগিন ড্যান্স!
- 0 মন্তব্য