• ক্রিকেট

ভরা হাট ভেঙে গেল...।

পোস্টটি ১০৪৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

চোখগুলোতে তখনো অবিশ্বাস।একটি-দুইটি চোখ নয়,এক হাজার ছেলের দুই হাজার চোখ তখনো বিস্ফারিত হয়ে চেয়ে আছে প্রজেক্টরের সাদা স্ক্রিনে।শহীদুল্লাহ হলের মাঠে আজ সবাই জড়ো হয়েছিল বাংলাদেশের জয় দেখতে।হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিল জয় ,উদযাপনের মঞ্চ ছিল প্রস্তুত।ম্যাচের শেষ বলের ঠিক আগের বলেও প্রতিপক্ষের উইকেট পতনের উল্লাসে যে প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়েছিল মাত্র এক মুহূর্তের ব্যবধানে সেখানে নেমে এল কবরস্থানের নিস্তব্ধতা।

মন তখন ভাবছিল,চোখ বোধহয় ভুল দেখছে।এখুনি কোন এক জাদুকর এসে সময়কে দু’মিনিট পিছিয়ে দেবে, শেষ বলটা আবার মাঠে গড়াবে।শুধু এই প্রাঙ্গণ নয় বাংলাদেশের সব পর্দার সামনে বসে থাকা দর্শক ও রেডিওতে মনোযোগী সব শ্রোতা বোধহয় একই কথা ভাবছিলেন।এত কাছে ছিল ট্রফিটা তবু ছোঁয়া গেল না! স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় পুড়তে হলো আবার।

ম্যাচটা প্রায় হাতের বাইরেই চলে যাচ্ছিল।অফ ফর্মে থাকা সাব্বির ভোজবাজির মত নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে দিলেন।তবু স্কোরবোর্ডে লড়াই করার পুঁজি হচ্ছিলো না।অলরাউন্ডার মিরাজ বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ ওভারে বুক চিতিয়ে উনিশ রান তুললেন।স্কোরবোর্ডে জমা হলো মোট ১৬৬ রান।চোখ বন্ধ করে জেতার মত না হলেও এই রান নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে টিকে থাকা যায়।

সত্যি সত্যিই লড়াইটা শেষ বল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল বাংলাদেশ।একসময় মনে হচ্ছিলো ভারত বোধহয় সহজেই জিতে যাবে।পাওয়ার-প্লেতে তাদের শুরুটাও হয়ে ছিল ঝড়ো।তিন ওভারেই রোহিত-ধাওয়ান জুটি তুলে ফেলল বত্রিশ রান।এই বত্রিশেই কাটা পড়লেন ধাওয়ান ও রায়না।খেলা তখনো ভারতের দিকে ঝুঁকে আছে।তবে আস্তে আস্তে চিত্রটা পাল্টাতে লাগল।টাইগার বোলাররা রানের স্রোতে বাঁধ দিতে লাগলেন।

এই বাঁধ নির্মাণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন রুবেল।নিজের প্রথম তিন ওভারে মাত্র বারো রান দিয়ে তুলে নিলেন একটি উইকেট।গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসতে থাকা আস্কিং রেটের শেকল ভাঙার চেষ্টায় মিসটাইমিং এ ক্যাচ দিলেন রোহিত।ভারত শিবিরে তখন ধীরে ধীরে আশংকার মেঘ ছড়াচ্ছে।

ভারতের ইনিংসের সতেরতম ওভার শেষে তাদের সামনে সমীকরণ দাঁড়ালো  বাকি আঠারো বলে পঁয়ত্রিশ রান দরকার জেতার জন্যে।টাইগার অধিনায়ক সাকিব বোলিং এ ডাকলেন মুস্তাফিজুর রহমানকে।আগের করা নিজের তিন ওভারে একটিও কাটার দেন নি তিনি।কিন্তু মহাগুরুত্বপূর্ণ এই ওভারেই নিজের মায়াবী কাটারের পসরা খুলে বসলেন কাটার-মাস্টার।ফলাফলে ওভারের প্রথম চারটি বলই ডট!পঞ্চম বলে গেল একটি লেগবাই ও শেষ বলে আঊট হলেন মনীশ পান্ডে।আঠারো বলে পঁয়ত্রিশ রানের অতিক্রমযোগ্য লক্ষ্য হঠাতই ভারতের সামনে বারো বলে চৌত্রিশ রানের হিমালয় হয়ে দাঁড়ালো।

উনিশতম ওভার করতে এলেন রুবেল হোসেন।তখন পর্যন্ত ম্যাচের সেরা বোলার ছিলেন তিনি।আশা ছিল এই ওভারেই তিনি ভারতের সামনের হিমালয়প্রমাণ লক্ষ্যটাকে আরো বাড়িয়ে জয়-পরাজয়ের মীমাংসা করে দেবেন,কারণ শেষ ওভার যে করতে আসবেন পার্টটাইমার সৌম্য!সমস্ত ভরসা তখন রুবেলের উপরই।কিন্তু স্নায়ুচাপের কাছে হার মানলেন রুবেল।প্রথম বলেই লো ফুলটসে ছক্কা খেলেন।পরের বলে চার,তৃতীয় বলে আবার ছক্কা।মোট বাইশ রান দিয়ে বসলেন রুবেল।ভারত ইনিংসের শেষ ওভার শুরু করল বারো রানের সমীকরণ নিয়ে।

বিশ্বের সেরা বোলারও যেখানে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের শেষ ওভারে মাত্র বারো রান ডিফেন্ড করার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না সেখানে সৌম্য তো পার্টটাইম সিমার।তবুও একের পর এক নিঁখুত ফুললেংথ  ডেলিভারি দিয়ে আশার বেলুনটা ফাঁপিয়ে তুললেন তিনি।ওভারের পঞ্চম বলে ক্যাচে পরিণত করলেন বিজয় শঙ্করকে।প্রথম পাঁচ বলে সব মিলিয়ে দিলেন মাত্র সাত রান।শেষ বলে ভারতের চাই পাঁচ রান।খেলাটা তখন শুধু মাঠে হচ্ছিলো না,বোলার এবং স্ট্রাইকে থাকা দীনেশ কার্তিকের মনস্তাত্তিক লড়াইও চলছিল,কার স্নায়ু কতটা শক্ত সেই লড়াই চলছিল।এই লড়াইয়ে হারলেন সৌম্য,হারল বাংলাদেশ।ওয়াইড ফুললেংথ ডেলিভারিকে চোখের পলকে বুলেট গতির এক লফটেড ড্রাইভে গ্যালারিতে পাঠালেন কার্তিক।

এই ম্যাচটা আমরা হেরেছি তবে চাপ সামলে ফাইনালে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করার মন্ত্রটাও শিখে নিয়েছি।দু’বছর আগে ব্যাঙ্গালোরে ভারতের কাছে এক রানে হারার ক্ষত মুছিয়ে এই নিদাহাস ট্রফিতেই দুটো ম্যাচে রান তাড়া করে করে শেষ ওভারে জিতেছি।এই ফাইনাল নিয়ে চারটা ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে আমরা হারলাম।হয়ত এই ফাইনালগুলো হারার ক্ষত সামনের কোনো আইসিসি ট্রফিতেই মুছে যাবে কারণ চাপ সামলাবার মন্ত্রগুলো আমরা শিখে নিচ্ছি।

সামনের সেই অজানা ফাইনালের শেষেও হয়ত প্রজেক্টরের সাদা স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকবে শহীদুল্লাহ হলের দু’হাজার চোখ।তবে সেদিন চোখগুলোতে অবিশ্বাস ও দুঃখ থাকবে না,থাকবে জয়ের উল্লাস ও আজকের এই ক্ষত মুছে যাবার আনন্দাশ্রু।