• ফুটবল

”ড্রাগ মাফিয়ার বন্দুকের নলা থেকে বেঁচে ফিরে প্রিমিয়ার লীগের আসরে : রিচার্লিসনের গল্প"

পোস্টটি ৬৫৪৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রিচার্লিসন। এইত কিছুদিন আগে ওয়াটফোর্ড থেকে ৫০ মিলিয়নে এভারটনে যোগ দিলেন ব্রাজিলিয়ান এই উইংগার। কেমন ছিলো রিচার্লিসনের এই যাত্রা, পথচলা,  শৈশবকাল, চলুন একঝলক চোখ বুলে নেই।

 

রিচার্লিসনের জন্ম ব্রাজিলের শহর নোভা ভেনিসিয়ায়। দরিদ্র বাবা-মা'র ৫ সন্তানের সবচেয়ে বড় ছিলেন তিনি। বাবা পাথরের খনিতে পাথরের বোঝা বহন করতেন, আর মা পথে ঘাটে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা-মা'র কাছে সর্বদাই পেতেন জীবনে সংগ্রাম করে বাঁচার টোটকা, পেতেন সকল বাধা কে দূরে ঠেলে কিভাবে জীবনে পথ চলতে হয় সেই প্রেরণা। রিচার্লিসন জীবনের সংগ্রাম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ফুটবল কে সেই ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা থেকেই তাকে ফুটবল টানতো অনেক বেশি। শহরের যেখানেই ফুটবল ম্যাচ হত, একাই ছুটতেন সেখানে খেলা দেখার জন্যে। আর বাসায় এসে বাবার কাছে আবদার করতো টেলিভিশন কিনে দেওয়ার জন্যে যেনো সে সারাক্ষণ ফুটবল ম্যাচ দেখতে পারে। দরিদ্র বাবা-মা'র পক্ষে এই আবদার পুরণ ছিলো বেশ কঠিন। রিচার্লিসন তাই সুযোগ পেলেই প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে স্পোর্টস চ্যানেল দেখতো, আর সবাইকে বলে বেড়াতো একদিন আমি ওখানে খেলব। ফুটবল দেখার এই নেশা থেকে তাকে ফুটবল খেলার নেশা পাইয়ে বসে। দিন রাত সারাক্ষণ ফুটবল নিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতো ছোট্ট রিচার্লিসন। বাবা মা'ও কখনো বাঁধা দেননি রিচার্লিসনের এই ফুটবলের নেশায়। তবে তাদের চিন্তা ছিলো অন্য এক জায়গায়।

 

নোভা ভেনিসিয়া, ব্রাজিলের দক্ষিণের এই শহর ছিলো মাফিয়া এবং ড্রাগ ডিলারদের আতুরঘর। এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ গরীব হউয়ায়, তাদেরকে এই পথে আনা অনেক সহজ ছিল ড্রাগ ডিলারদের। এখানে ছোট থেকে বড়, সিংহভাগই ছিলো নেশাদ্রব্য বিক্রেতা। খুব কম সময়ে অনেক বেশি টাকা আয়ের এই অবৈধ পথ ছিলো এই শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য।  বাবা মা সর্বদাই রিচার্লিসন কে আগলে রাখতো, তাকে বুঝানোর চেস্টা করতো সে যেনো কখনও এই পথে না যায়। রিচার্লিসনের বন্ধু রা সবসময় তাকে ড্রাগ বিক্রির এই পথে আনার চেস্টা করত। কিন্তু রিচার্লিসন কখনোই এ পথে পা বাড়ায়নি। 

 

শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভালো ফুটবল খেলে ভালোই নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে রিচার্লিসনের। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ বছর বয়সে সে নাম লেখায় লোকাল ফুটবল ক্লাব রিয়েল নরওয়েস্টে। 

 

এরই মাঝে ঘটে ভয়ংকরী এক ঘটনা, যা অনেকটা সিনেমার মত, যা রিচার্লিসন তার নিজের দ্বিতীয় জন্ম হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। রিচার্লিসনের বয়স তখন ১৪। ফুটবল খেলে এক সন্ধ্যায় ফিরছেন বাসায়। ঠিক সেই সময় শহরের এক গ্যাংস্টার এবং ড্রাগ ডিলার তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার মাথায় পিস্তল তাঁক করে। কোন কিছু না বুঝে রিচার্লিসন ঘাবড়ে যায়। সেই গ্যাংস্টার রিচার্লিসনকে তার ড্রাগ চুরু করে কোথায় রেখেছে জানতে চেয়ে গুলি করার হুমকি দেখাতে থাকে। পরে রিচার্লিসনের কথা শুনে বুঝতে পারে যে সে আসলে ভুল মানুষের মাথায় পিস্তল তাঁক করেছে। মানুষটি রিচার্লিসন কে  তখন ছেড়ে দেয়। আর রিচার্লিসন দৌড়ে চলে যায়। রিচার্লিসন অনেকবার ক্যামেরার সামনে বলেছে, এই ঘটনা তার জীবনের সবচেয়ে খারাপতম ঘটনা, যেখানে এক সেকেন্ডের মাঝেই তার সব শেষ হয়ে যেতে পারতো।

 

রিচার্লিসনের যখন ১৬, তখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় মিরাকেল ঘটে যায়। স্থানীয় এক টুনার্মেন্টের ফাইনালে অংশ নেওয়ার সময় রিচার্লিসন'র খেলার ধরণ মনে ধরে যায় ফাইনালে দাওয়াতপ্রাপ্ত এক অতিথির, নাম রেনাটো ভেলাস্কো, যিনি কিনা একজন বড় ব্যাবসায়ী। ম্যাচ শেষে তিনি রিচার্লিসন কে এক জোড়া দামী জুতো উপহার দেন আর বলেন তিনি রিচার্লিসন কে সাহায্য করতে চান। তিনি রিচার্লিসন কে বিশ্বাস করান, ওর প্রতিভা সম্পর্কে, ওর ফুটবলে অনেক দূরে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে।  

 

রেনাটোর সাহায্যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ব্রাজিলের সেকেন্ড টায়ারের দল আমেরিকা মিনেইরো তে যোগ দেন রিচার্লিসন। একবছর পরেই নাম লিখান ফ্লুমিনেন্সে। ফ্লুমিনেন্সে নিজের খেলার উন্নতি ঘটাতে থাকেন এই উইংগার। এরই মাঝে একরাতে রিচার্লিসনের কাছে এক অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসে, রিসিভ করেই কানে ভেসে আসে "সেলেসাও জার্সিতে খেলবে??"।  রিচার্লিসন যেনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ওর সাথে কথা বলছিলো তৎকালীন ব্রাজিল অ-২০ দলের কোচ। নিয়মিত ভালো খেলার ফল স্বরুপ ডাক আসতে থাকে ইউরোপ থেকে। ২০১৭ সালে ওয়াটফোর্ড বস মার্কো সিলভার নিজস্ব প্রচেস্টায় ইংলিশ প্রিমিয়ারলীগের এই ক্লাবটিতে নাম লিখান রিচার্লিসন। ২০১৮ সালে ওয়াটফোর্ড ছেড়ে মার্কো সিলভা যখন এভারটনে যোগ দিলেন, একই সাথে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভিড়ালেন নিজের প্রিয় ছাত্র রিচার্লিসন কে। 

 

রিচার্লিসন দা আন্দ্রাদে। নিঃসন্দেহে এই মুহুর্তে ব্রাজিলের একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়।  অথচ ভাব যায়, একটা সময় কতটা দরিদ্রতা আর ভয়ংকর এক পরিবেশের মাঝে দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এই খেলোয়াড়!  নিজের উপরে আস্থা রেখে জীবনে লড়াই করে গেলে সফলতা যেনো আপনা আপনি ধরা দেয়, রিচার্লিসন তার প্রকৃষ্ট উদাহরন।