• ক্রিকেট

আমি কিংবদন্তিদের কথা বলছি!

পোস্টটি ৪০৪৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৪১ বছরের ক্রিকেট ইতিহাস! সেই ইতিহাসের ক্ষণে ক্ষণে ঘটেছে অনন্য সব নজির। ব্যথা, চোটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কখনো সেই ভাঙ্গা বুড়ো আঙ্গুল নিয়ে, কখনো বা মাথায় ব্যান্ডেজ, কখনো বা ভাঙ্গা পা নিয়েই কিছু মানুষ নেমে গেছেন দলের টানে, দেশের প্রয়োজনে। সেই রূপকথার গল্প ২২ গজের পিচে লিখে আসা কিংবদন্তিদের সম্মানে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য!

 

* বার্ট সাটক্লিফ – জোহানেসবার্গ ১৯৫৩ (প্রতিপক্ষ – দক্ষিণ আফ্রিকা)

জোহানেসবার্গের সবুজ পিচে দুই পেসার অ্যাডলক আর আয়রনসাইডের ভয়াবহ বোলিংয়ে দাঁড়াতেই পারছিলো তখনো পর্যন্ত টেস্টে জয়হীন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরা। তাঁদের দ্রুতগতির বাউন্সারে ৯ রানেই দুই ওপেনারকে হারায় কিউইরা। ব্যাট করতে আসেন বার্ট সাটক্লিফ। অ্যাডলকের প্রথম দুই বল তাও খেলেছিলেন কোনোমতে, তৃতীয় বলেই গা বাঁচানো হুক করতে গিয়ে মিস করেন সাটক্লিফ। বল আঘাত হানে মাথার একপাশে। সেই আঘাতে কানের লতির অর্ধেকটা নাই হয়ে গিয়েছিলো এই ব্যাটসম্যানের, তৈরি হয়েছিলো গর্ত। হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে। অবশ্য একই অবস্থা হয়েছিলো বাকিদেরও। প্রোটিয়া বোলিং তোপে ৮১ রানেই ৬ উইকেট হাওয়া হয়ে যাওয়া অবস্থায় ফের ব্যাট করতে নামেন ব্যান্ডেজ বাঁধা সাটক্লিফ। এরপর রীতিমত চড়াও হন বোলারদের উপরে। চার-ছক্কার বৃষ্টিতে দৃষ্টিনন্দন এক ইনিংসের উপহার দেন। তবুও থামছিলো না উইকেটের পতন। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওভারটন যখন বাড়ি ফিরে যান, তখন স্কোর মাত্র ১৫৪। তখন ক্রিজে আসলেন স্পিরিটের আরেক নজির গড়া বব ব্লেয়ার। মাত্র দুদিন আগেই নিউজিল্যান্ডের তাঙ্গিওয়াই রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ব্লেয়ারের বাগদত্তা নেরিসা লাভ। লাভকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সঙ্গ দিলেন মারমুখো সাটক্লিফকে। দুজনে মিলে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনার হিউ টেফিল্ডের এক ওভারে নিলেন ২৫ রান, যেই রেকর্ড অক্ষত ছিলো প্রায় পাঁচ দশকের কাছাকাছি সময় ধরে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্লেয়ার আউট হবার আগে মাত্র ১০ মিনিটের জুটিতে যোগ করেছিলেন ৩৩ রান, সাটক্লিফ অপরাজিত ছিলেন ৮০ রানে। নামের পাশে ছিলো ৪ চার আর ৭ ছক্কা। ম্যাচটি দক্ষিণ আফ্রিকা ১৩২ রানে জিতলেও সাটক্লিফ আর ব্লেয়ার অমর হয়ে গিয়েছিলেন সাহস আর ত্যাগের অদ্ভুত মিলনে!

 

96748.2

 

* কলিন কাউড্রে – লর্ডস ১৯৬৩ (প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাময় টেস্ট ম্যাচের একটি ছিলো সেটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩০১ রানের জবাবে ইংল্যান্ড করেছিলো ২৯৭। দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রেড ট্রুম্যানের বলে খেই হারায় ক্যারিবিয়রা। ২২৯ রানেই অলআউট হয় তাঁরা। ট্রুম্যান দুই ইনিংস মিলে নেন ১১ উইকেট। ২৩৪ রানের লক্ষ্যে ৩১ রানে ৩ উইকেট হারায় ইংলিশরা। সেসময় হাল ধরা কলিন কাউড্রেকে আঘাত হানে ওয়েস হলের এক বিদ্যুৎ গতির বাউন্সার। এত জোরে সেই শব্দ হয়েছিলো তা নাকি শুনতে পেয়েছিলেন গ্যালারিতে থাকা সবাই। সেই আঘাতে হাত ভেঙ্গে যায় কাউড্রের।

তারপরও ব্যারিংটন আর ব্রায়ানের জোড়া ফিফটিতে জয়ের দিকেই এগুচ্ছিলো ইংলিশরা, তখুনি ক্যারিবিয়ান পেসারদের দারুণ বোলিং উত্তেজনা ফিরিয়ে আনে ম্যাচে। টানা উইকেট হারাতে থাকা ইংলিশদের তখন শেষ ওভারে দরকার ৮ রান, হাতে মাত্র দুই উইকেট। শ্যাকেলটন রান আউট হলেন সেই ওভারেই, দরকার ২ বলে ৬ রান। সবাইকে অবাক করে প্লাস্টার মোড়া হাত নিয়ে ক্রিজে আসলেন কাউড্রে। যদিও ব্যাট করতে হয়নি। শেষ দু’বলে ডেভিড অ্যালেন ঝুঁকি না নেওয়ায় ম্যাচ শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে। দারুণ উত্তেজনাময় ম্যাচে অনন্য হয়ে থাকেন কাউড্রে।

 

cl_image01

 

* ম্যালকম মার্শাল – হেডিংলি ১৯৮৪ বনাম ইংল্যান্ড

ক্রিকেট ইতিহাসের ভয়ংকরতম বোলারদের একজন। ছিলেন আশির দশকের সেই বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান পেসার চতুষ্টয়ের একজন। হেডিংলি টেস্টের প্রথম দিনই যখন বুড়ো আঙ্গুলের দু’জায়গায় চিড় ধরলো, ইংলিশরা বোধহয় ভাগ্যদেবীর দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁদের করা ২৭০ রানের জবাবে ল্যারি গোমেজ আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের ৮০ রানের জুটিতে লিড নিয়েছিলো ক্যারিবিয়রা। নবম উইকেটে জোয়েল গার্নার যখন আউট হলেন, তখন গোমেজ অপরাজিত আছেন ৯৬ রানে। সবাই যখন প্যাভিলিয়নের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, তখনই রীতিমত হাসিমুখে বেরিয়ে আসলেন মার্শাল। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় এক হাতে ব্যাট করেই গোমেজকে সঙ্গ দিলেন সেঞ্চুরির পথে। ইংলিশ ফিল্ডার আর মার্শালের মধ্যে হাসি বিনিময় হচ্ছিলো বারবারই। কিন্তু খুব দ্রুতই সেই হাসি মিলিয়ে গিয়েছিলো। বল করতে নেমে জোয়েল গার্নারের সাথে নতুন বলে আগুন ঝরালেন ভাঙ্গা হাতেই! ৫৩ রানের বিনিময়ে নিলেন ৭ উইকেট, ১৫৯ রানেই শেষ ইংলিশদের প্রতিরোধ। ২ উইকেট খরচায় জয় নিশ্চিত করে ক্যারিবিয়রা।

 

223741

 

* অনিল কুম্বলে – অ্যান্টিগা ২০০২ (প্রতিপক্ষ – ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

মারভিন ডিলনের আচমকা বাউন্সার আঘাত হানে কুম্বলের মুখে, সাথে সাথেই গড়াতে থাকে রক্ত। খানিকটা শুশ্রূষা নিয়েই ব্যাটিং চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। আউট হবার পর জানতে পারেন, চোয়ালের হাড় ভেঙ্গেছে তাঁর। সিরিজে আর খেলা হচ্ছে না স্পিনারের। পরের ফ্লাইটে করেই দেশে ফিরে আসার কথা ছিলো, কিন্তু কুম্বলে স্থাপন করলেন অনন্য এক নজির। ব্যান্ডেজ করা মুখে বল করলেন ১৪ ওভার। প্রায় প্রতি ওভারেই নতুন করে ব্যান্ডেজ ঠিক করতে হচ্ছিলো। সেই অবস্থাতেই নিলেন ব্রায়ান লারার উইকেট।   

 

247719

 

* গ্যারি কারস্টেন – লাহোর ২০০৪ (প্রতিপক্ষ – পাকিস্তান)

লাহোর টেস্টে ভালোই খেলছিলেন কারস্টেন। হঠাৎ গতিদানব শোয়েব আখতারের এক আগুনের গোলায় পুল শট করতে গিয়ে মিস করেন কারস্টেন। বল এসে আঘাত হানে মুখে। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়া রক্তাক্ত কারস্টেন কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারেন, নাকটা ভেঙ্গেই গেছে তাঁর।

প্রথম ইনিংসে লিড নেয় পাকিস্তান। আবার ব্যাট করতে নেমে ১৪৯ রানে যখন ৪ উইকেট, তখন ক্রিজে আসেন কারস্টেন। সেলাই আর আঘাতের দাগে মুখটাই ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিলো না। সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন তিনি, পাকিস্তান ম্যাচ জেতে সহজেই। কিন্তু কারস্টেনের সেই হার না মানা ৪৬ রানের ইনিংস জায়গা পায় ক্রিকেট কিংবদন্তিতে!

 

3362334449_6f2e89c2b8

 

* গ্রায়েম স্মিথ – সিডনি ২০০৯ (প্রতিপক্ষ - অস্ট্রেলিয়া) 

দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেশ ছড়ানো সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ৪১৪ রানের প্রায় অসম্ভব লক্ষ্য তাড়া করে ম্যাচ জেতে প্রোটিয়ারা। দ্বিতীয় টেস্টে ডেল স্টেইনের বলে-ব্যাটে সিরিজ নিশ্চিত হয় আফ্রিকার। কিন্তু সিডনি টেস্টেও কমেনি একটুও আগুন। অস্ট্রেলিয়ার ৩৯৪ রানের জবাবে গ্রায়েম স্মিথের ব্যাটে ভর করে দারুণ সূচনা করেছিলো প্রোটিয়া বাহিনী, কিন্তু ৩০ বলে ৩০ রান করে উড়তে থাকা স্মিথকে থামতে হয় মিচেল জনসনের বজ্র-আগুনে। প্রচণ্ড গতিতে আঘাত হানা বলের বাঁ হাতের কব্জিতে ভেঙ্গে যায়। স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য হন অধিনায়ক, ৩২৭ রানে থামে স্মিথের দল। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৭ রান করে ৩৭৬ রানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে অজিরা। কিন্তু চতুর্থ ইনিংসের রাজাখ্যাত স্মিথের অনুপস্থিতিতে ড্রয়ের জন্যই খেলতে থাকে প্রোটিয়ারা। দারুণ প্রতিরোধের পরও নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে স্টেইন যখন সাজঘরে ফিরছেন, তখন সান্ত্বনার জয়ে উল্লাসে মত্ত অস্ট্রেলিয়া। সেই মুহূর্তেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট! কনুইতে ইঞ্জেকশন আর ব্যথানাশক খেয়ে প্লাস্টার করা হাতেই নেমে আসেন স্মিথ। নয় ওভারের মত বাকি ছিলো তখনো। এক হাঁতে প্রতিরোধের অবিশ্বাস্য গল্প লেখা স্মিথ আর এনটিনির ব্যাটে ড্রয়ের খুব কাছাকাছি ছিলো ম্যাচ। মাত্র ১০ বল বাকি থাকতে জনসনের আরেক বজ্রগতির বলে স্মিথের উইকেট ভাঙলেও ১৭ বলের সেই ইনিংস অংশ হয়ে যায় ক্রিকেটীয় রূপকথার।

 

05smithonehand

 

* ইয়ান বেল – ব্রিস্টল ২০১০ (প্রতিপক্ষ – বাংলাদেশ)

শুধু তামিম না, এরকম প্রতিরোধের অন্য একটি গল্পে আছে বাংলাদেশের নামও। এই তালিকার একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচের ঘটনাও বটে! বাংলাদেশের করা ২৩৬ রানের জবাবে নিয়মিত উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে ইংল্যান্ড। ২২৭ রানে যখন নবম উইকেটের পতন হয়, তখন ফিল্ডিংয়ের সময় আঘাত পেয়ে পা ভাঙ্গা ইয়ান বেল ১১ নম্বরে ব্যাট করতে আসেন। ক্রিজের স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা জোনাথন ট্রট তখন লড়ছেন ৯০ রান নিয়ে। শেষ ওভারে দরকার ১০ রান। প্রথম দু’বলে জোড়া রান নিয়ে লক্ষ্যটা ৪ বলে ৬-এ নামিয়ে এনেছিলেন ট্রট। কিন্তু তৃতীয় বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলে ইংল্যান্ড ম্যাচটা হেরে বসে ৫ রানে! একটিও বল না খেললেও বেল মাঠে ছিলেন দলের জন্যই!

 

119219

 

* তামিম ইকবাল – দুবাই ২০১৮ (প্রতিপক্ষ – শ্রীলংকা)

দুই উইকেট নেই প্রথম ওভারেই। নিজের খেলা তৃতীয় বলে মুখোমুখি হয়েছিলেন লাকমলের। সাধারণ দর্শন বলটিকে পুল করতে গিয়ে মিস করেন বাংলাদেশি ওপেনার। আঘাত পান বাঁহাতের কব্জিতে। সাথেসাথেই মাঠ ছেড়ে যান তামিম। প্লাস্টার মোড়ানো হাতটা ঝুলছিল স্লিংয়ে। এশিয়া কাপ শেষ, খবরটা মিলেছে খেলার মাঝেই। ৯ম ব্যাটসম্যান হিসেবে মুস্তাফিজুর রহমান আউট হলেন, অথচ মুশফিকুর রহিম প্যাভিলিয়নের দিকে যাচ্ছেন না! কারণ, তামিম নামছেন ব্যাটিংয়ে! একটা বলও খেলেছেন এক হাতেই। সেই উইকেটে আরও ৩২ রান তুলেছেন মুশফিক, সাথে বাংলাদেশ জিতেছে ১৩৭ রানে। তবে ৪ বলে ২ রানে অপরাজিত থাকা তামিম ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে পড়েছেন অপরাজিত হয়েই!

 

DnNpqGAU0AEj9xY