ফুটবলটা যুদ্ধও বটে!
পোস্টটি ৪৯০০ বার পঠিত হয়েছেবিশ্বকাপের ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে লংরেঞ্জ শটে সমতা ফেরানোর পর শাকা করেছেন অদ্ভুত এক সেলিব্রেশন। দুই হাত আড়াআড়ি করে বুড়ো আঙ্গুল স্থির রেখে বাকি আঙ্গুল দিয়ে ডানা মেলা পাখির মত উড়ে বেড়ানোর ভঙ্গি। আলবেনিয়ার জাতীয় প্রতীক - আলবেনিয়ান ঈগলকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এই সেলিব্রেশন করেছেন জয়সূচক গোলদাতা জেরদান শাকিরিও। তিনি তো মাঠে নেমেছিলেন দু'পায়ে কসোভো আর সুইজারল্যান্ডের পতাকা আঁকা বুট নিয়েই। দুই শরণার্থী ফুটবল তারকার মধ্যে আজকের গল্পটি কেবল শাকাকে নিয়েই।
(এই লেখাটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রাণিত)
সাল ১৯৮৬। মেক্সিকোতে ম্যারাডোনা জ্বরে যখন বিশ্ব কাঁপছে, ঠিক সেসময় অ্যাজটেকা স্টেডিয়াম থেকে প্রায় সাড়ে দশ হাজার কিলোমিটার দূরে ২২ বছরের তরুণ রাগিপ ব্যস্ত মিছিলে-সমাবেশে। কসোভোর প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাগিপ আন্দোলন করেছেন কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, বেলগ্রেডের রাস্তায়। তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ কসোভোর বাসিন্দা এই প্রদীপ্ত কণ্ঠস্বরের যুবক। আন্দোলন চলাকালেই পরিচয় এলমেজ নামের স্বর্ণকেশীর সাথে। দ্রুতই মন দেয়া-নেয়া হল, একসাথে থাকার স্বপ্নটা দানা বাঁধছে, এমন সময় গ্রেফতার হলেন একদিন! দ্রুতই বিচারের আয়তায় এনে ৬ বছরের সাজাও পেলেন। আরো ৪ বন্দীর সাথে কারাগারের এক কক্ষেই থাকা রাগিপ ২৪ ঘণ্টায় আলোর মুখ দেখতেন কেবল মিনিট দশেকের জন্য। কারগারে প্রথম কয়েক মাস তাও মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, এরপরেই শুরু হল অকথ্য নির্যাতন! হার মানেননি রাগিপ।
রাগিপের সেই অসম্ভব কষ্টের দিনগুলোর কথা বলেছেন তাঁর ছেলে শাকা। গ্রানিত শাকা। সুইজারল্যান্ডের ২৬ বছর বয়সী তারকা মিডফিল্ডার।
“সেই বাবার সন্তান হিসেবে এই কষ্টের গল্পটা গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় আমাকে। বাবাকে জানতে হলে পুরো বিষয়টাই জানতে হবে, এতটাই করুণ সেই গল্প। আমি সেই গল্পটা বাবার কাছে বারবার শুনতে চাইতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, বাবা কখনোই সেই গল্পটা পুরোপুরি বলেননি। প্রতিবারই বাবা হঠাৎ চুপ হয়ে যেতেন গল্প বলতে গিয়ে। সেই নিস্তব্ধতাই সাক্ষী, তিনি কোনকিছু গোপন করতেন। হয়ত সন্তানদের কষ্ট বাড়াতে চান না বলেই সত্যিটা চেপে যেতেন।”
শাকার ভাষায়, রাগিপ ছিলেন একজন গর্বিত কসোভারিয়ান। বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রে, প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারে। আন্দোলনে নেমেছিলেন কসোভোর মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের ন্যায্য সংগ্রামে। শুধু রাগিপ নন, গ্রেফতার হয়েছিলেন রাগিপের চাচাও। তিনি দণ্ড পেয়েছিলেন ১৫ বছরের। সাড়ে তিন বছর কারাবাস যাপন আর নির্যাতনের পর ছেড়ে দেওয়া হয় রাগিপ ও তাঁর চাচাকে। শর্ত ছিল, দেশত্যাগ করতে হবে অতিসত্বর, পরিবারের বাইরে কেউ জানতে পারলেই আবার বন্দী হবার হুমকিও ছিল।
মুক্তিলাভের পর এলমেজের সাথে নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই সুইজারল্যান্ডে চলে আসেন রাগিপ। শুরু করেন নতুন জীবন। এক বছর পর সেখানেই প্রথম তোঁলো শাকার জন্ম। ১৮ মাস পর পৃথিবীর আলো দেখেন গ্রানিত শাকা। বাবাকে রোল মডেল মানা দুই ভাই মানসিক শক্তির সবটাই পেয়েছেন বাবা আর মার কাছ থেকে। ছোট্টবেলার সেই কষ্টের আগুনে পুড়েই বড় হতে শিখেছেন তারা। সুইজারল্যান্ডে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে পরিবারকে। প্রথম যেবার দাদাকে দেখার জন্য আলবেনিয়া গিয়েছিলেন দু’ভাই, সেবার দুজনের টিকিট খরচ দেবার জন্য সারাদিন চাকরিতে ব্যস্ত রাগিপ-এলমেজ দম্পতিকে কয়েক সপ্তাহ নৈশকালীন পরিষ্কারকর্মী হিসেবে শ্রম দিতে হয়েছিল। পাদপ্রদীপের আলো পেলেও তাই সাধারণের কাতারেই থাকতে চান শাকা ভাইয়েরা। বিশ্বাস করেন আনুগত্য আর শ্রদ্ধাবোধ মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় গুণ। একই সাথে মা এলমেজের আত্নত্যাগটাও স্বীকার করেন।
“আমার মায়ের মত অদ্ভুত কঠিন ব্যক্তিত্ব খুব কম দেখেছি আমি। মাত্র তিন মাসের পরিচয়ে এত কম বয়সের কোন নারী এরকম অপেক্ষা আর কষ্ট করতে পারে, মাকে না দেখলে বুঝতাম না! তাঁর প্রতি আমার অসম্ভব শ্রদ্ধা”।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বড় ভাই দাদার দেশ আলবেনিয়াকে বেছে নিলেও, গ্রানিত খেলেন সুইজারল্যান্ডের জার্সিতেই। তাঁকে দু’হাত ভরে দিয়েছে সুইজারল্যান্ড, এই দেশটার কাছে তাঁর অনেক ঋণ। খেলার মাঠে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন প্রতিদানের গল্প লিখতে। একই সাথে ভুলে যান না কসোভো-আলবেনিয়ান শেকড়টাকেও। অবশ্য সুইজ্যারল্যান্ডের বিখ্যাত বাসেল এফসিতেই ক্লাব ক্যারিয়ার গড়েছেন তোঁলো শাকা। গ্রানিত শাকা খেলছেন আর্সেনালের হয়ে।
স্ত্রী লিওনিতা লেকাজ ও মা এলমেজ শাকা
জার্মান, আলবেনিয়ান, ফরাসী ও ইংরেজি – চার ভাষাতেই কথা বলতে পারা গ্রানিত শাকা নিজের গল্পটাও বলেছেন খুব সংক্ষেপে, সাধারণের মত করেই - “আমি খুব সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষ ভালোবাসি, সাধারণ খাবার খেতে পছন্দ করি। এভাবেই বড় হয়েছি। আমার বাবা কোনদিন ভালো কিছু করলেও পিঠ চাপড়ে দেননি। মাটিতে পা রাখা শিখেছি তখন থেকেই।”
গেম রিডিং, পাস, লং রেঞ্জ শুট, সাথে ইন্টারসেপশন আর হার্ড ট্যাকল করার দক্ষতা – সবই আছে এই মিডফিল্ডারের। অভাব নেই যুদ্ধংদেহী মনোভাবেরও। পরাজয়কে দারুণ অপছন্দ করা সুইস মিডফিল্ড জেনারেলের কাছে আর নতুন কী! বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত শাকা গোল করে আলবেনিয়ান ঈগলের প্রতীক দেখাবেন – এতেই বা আর অবাক হওয়া কেন! সুইজারল্যান্ডে খেললেও হৃদয়ে তো কম নেই কসোভো আর আলবেনিয়াও!
- 0 মন্তব্য