• ক্রিকেট

ইমরুলঃ দ্য ওয়ারিয়র

পোস্টটি ৫০০৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
✔⏩ইমরুলঃ দ্য ওয়ারিয়র⏪ ইমরুলের জন্ম ১৯৮৭ সালে মেহেরপুরে। বাংলাদেশের প্রফেশনাল ক্রিকেটে তার আত্মপ্রকাশ ২০০৬ সালে। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগেই খেলে ফেলেন ১৫ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ আর ১৬টি একদিনের ম্যাচ। জাতীয় দলে তখন ওপেনার সংকটে ভুগছিল, কেউই ঠিক থিতু হতে পারছিল না, তখন অভিষেক হয় টগবগে এক তরুণের। ১৪ অক্টোবর ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড এর সাথে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ইমরুলের। অভিষেক ম্যাচ মোটেই ভাল হয়নি ইমরুলের। ৩ নাম্বার পজিশনে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১২ রান। পরবর্তী তে ওপেনার হিসেবে জাতীয় দলে খেলা শুরু করেন ইমরুল। একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তার টেস্ট অভিষেকও হয়। প্রথম টেস্টে তার পারফর্মেন্স ছিল যাচ্ছেতাই। উভয় ইনিংসে ব্যাট করে রান করেন যথাক্রম ১০ ও ৪। খারাপ করলেও ইমরুলের মধ্যে ভাল ক্রিকেটারের বৈশিষ্ট্য ছিল, ভাল করার প্রবণতা ছিল, চেষ্টা ছিল। কঠোর পরিশ্রম করতো সে। জাতীয় দলের হেভিওয়েট ক্রিকেটার নয় সে, তেমন নাম ডাক নাই, তবে ছিল উদ্যম, চেষ্টা। যখনি সুযোগ পেতেন চেষ্টার ত্রুটি রাখতেন না, সর্বোচ্চ টা দেওয়ার প্রবণতা ছিল তার মাঝে। ততটা আড়ম্বর না তিনি। স্টাইলিশও নন। খেলার ধরণও যে অনেক উঁচু মাপের তাও নয়। তবুও ইমরল এক যোদ্ধার নাম। জাতীয় দল থেকে বার বার বাদ পড়েও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে না পড়ে, আবারও ফিরে আসার ব্যাকুলতা কাজ করতো তার মধ্যে। জাতীয় দলে তিনি ছিলেন বরাবরই পরীক্ষার পাত্র। ১০ বছর ক্রিকেট খেলে ওডিয়াই খেলেছেন ৭৬ টা, টেস্ট ৩৪ টা আর টি টুয়েন্টি মাত্র ১৪ টা। তার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে খুব যে সন্তুষ্ট হবেন, সেটা বলবো না, তবুও বলবো He is a fighter. ইমরুলের ক্যারিয়ার কে দুই ভাগে বিবেচনা করা যেরে পারে, (২০০৮-১৫) ও (২০১৫-চলমান... ২০০৮ থেকে যদি ইমরুলের পারফর্মেন্স বিবেচনা করি, তাহলে বাংলাদেশের দলগত পারফর্মেন্সও বিবেচনা করতে হবে, একই সাথে অন্য প্লেয়ারদেরও। বাংলাদেশ তখন মাঝেমধ্যে এক দুটো ম্যাচ জিততো। ইমরুলও সেই সময়টাতে কালে ভদ্রে দু একটা ভাল ইনিংস উপহার দিত। ১৫ সালের আগে ইমরুলের ওডিয়াই শতক ছিল মাত্র ১টি, প্রায় ৫০ এর অধিক ম্যাচ খেলা একজন ওপেনারের সেঞ্চুরি মাত্র ১টি, ভাবা যায়! তবে ১৫ সালে বাংলাদেশ দলগত ভাবে ভাল করার পর থেকে বাংলাদেশের অনেক প্লেয়ার ভাল খেলতে শুরু করে, যার মধ্যে তামিম, মুশফিক সাকিবরা অন্যতম। দলীয় পারফর্মেন্স ভাল হওয়ায় ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সও ভাল হতে শুরু করে। ইমরুল তার ক্যারিয়ারের বেস্ট সময়টা পার করেছেন ২০১০ সালে, সেবছর সে ৩২.১১ গড়ে ৮৬৭ রান করে, সেবছরের সর্বোচ্চ রান স্কোরারের তালিকায় ৫ নাম্বারে ছিলেন। ইমরুল কায়েস তার প্রথম ওডিয়াই শতক করেন ২০১০ সালে, নিজের ১০ম ম্যাচে এসে। নিউজিল্যান্ড এর বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ড এর সাথে ১০১ রানের ইনিংস খেলেন ইমরুল। পরবর্তী শতক পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় পুরো ৫০টি ম্যাচ! নিজের ৬০তম ম্যাচে এসে ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড এর বিরুদ্ধে ১১২ রানের ইনিংস খেলে ওডিতাইতে ২য় শতক টি করেন ইমরুল। সুতরাং, বুঝাই যাচ্ছে তখন ওপেনার হিসেবে মোটেই সফল ছিলেন না কায়েস। তবুও ওপেনার খড়ায় আর দলীয় পারফর্মেন্স খারাপ হতে থাকায় টিকে যান ইমরুল। কিন্তু.. কিন্তু ১৫ সাল পরবর্তী, বাংলাদেশের দলগত পারফর্মেন্স এর গ্রাফ উন্নতি হওয়ায় এবং জাতীয় দলে আরও কয়েকজন ওপেনারের আত্মপ্রকাশ ঘটায় দল থেকে বার বার বাদ পড়তে থাকেন ইমরুল। টেস্ট দলে নিয়মিত হলেও অন্য দুটি ফরমেটে আর নিয়মিত হতে পারলেন না ইমরুল। দলে যে নিয়মিত হতে পারেন নি, তার বড় প্রমাণ, ২০১৬ সালে সে নিজের ৬০ তম ম্যাচ খেলে, আর সদ্যই শেষ হওয়া ওডিয়াই সিরিজে লাস্ট ওডিয়াই খেলে ৭৬তম ম্যাচ। অর্থাৎ এই দু বছরে মাত্র ১৬টা ম্যাচ খেলে ইমরুল। টেস্ট আর টি টুয়েন্টির ক্যারিয়ার মোটেই ভাল নয় ইমরুলের, এখন পর্যন্ত ৩৪ টেস্ট ম্যাচের ৬৬ ইনিংসে ব্যাট করে ২৬.২৩ গড়ে মাত্র ১৬৭৯ রান করেন ইমরুল। যার মধ্যে শতক ৩টি আর অর্ধশতক ৪টি। বেস্ট ১৫০ রান। হতাশাজনক পারফর্মেন্স একজন ওপেনারের জন্য। টেস্টে ক্রিকেটে ওপেন করা ১ জন ওপেনারের গড় মাত্র ২৬! এটা আধুনিক ক্রিকেটে বড্ড বেমানান। টি টুয়েন্টি তে আরো নাজুক অবস্থা, ১৪ ম্যাচের ১৩ ইনিংসে ব্যাট করে ৯.১৫ গড়ে ১১৯ রান করেন। বেস্ট ৩৬। তবে এসবই ২০০৮-২০১৫ সময়কার ইমরুলের পারফর্মের প্রভাব। এর পরের ইমরুল কেবলই পরীক্ষার পাত্র ছিলেন। আর এই পরীক্ষা দেওয়ার ফাঁকে নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল খেলে জাতীয় দলে বার বার যায়গা করেও এক ম্যাচ খারাপ করায়, আবারও বাদ পড়ে যাচ্ছেন। ইমরুলের বর্তমানে বেস্ট ফরমেট হচ্ছে ওডিয়াই, কিন্তু এবছরের শুরুতেও তার গড় ছিল ২৫ এর একটু উপরে। কিন্তু এখন.. ওডিয়াইতে ৭৬ ম্যাচ খেলে (৩২.৮৬) গড়ে ২৪৩২ রান করেন ইমরুল। এশির কাপ শুরুর আগে ইমরুল কে দলে নেওয়ার প্রেক্ষিতে অনেক লেখালেখি করেছি, মিডিয়াতেও অনেক আলোচনা হয়েছে, তবুও স্কোয়াডে যায়গা হয়নি তার। কিন্তু মরুর উত্তপ্ত তাপদাহে আমাদের ওপেনাররা খারাপ করতে থাকায় এবং তামিমের ইনজুরিতে ডাক পান কায়েস। আফগানিস্তান এর বিরুদ্ধে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রথম বারের মতো ৬ নাম্বারে খেলতে নেমেই ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে বিজয়ী করেন। ইমরুলের এই ইনিংস টি নতুন ইমরুলের জন্মদাতা। এই বারের পরীক্ষায় পাশ না করলে হয়তো এখন ইমরুলের ওডিয়াই গড় ৩২+ হত না, ওডিয়াই সেঞ্চুরি ২টা থেকে ৪টায় রূপান্তরিত হত। তাই ইমরুলের ক্যারিয়ারে ঐ ৭২ রানের ইনিংস টি টার্নিং পয়েন্ট। একই সাথে প্লাস পয়েন্ট। সেটা কেন ভাল ইনিংস হবে না, লম্বা সফর শেষে কন্ডিশনের সাথে না মানিয়ে নিয়েই, প্রথম বারের মতো কোনো দেশে খেলা এবং প্রথম বারের মতো ৬ নাম্বারে ব্যাট করে দলের বিপর্যয়ের সময় ভাল ইনিংস শুধু নয়, দলকে বিজয়ী করা। এতেই প্রমাণিত হয় He is a warrior । কিছুদিন আগে পুত্রসন্তান এর বাবা হন কায়েস। এরপর থেকে তার পারফর্মেন্স আকাশ ছোঁয়ার মতো। অলরেডি এই বছরে মাত্র ৬টি ওয়ানডে খেলে ৮৬.৪০ গড়ে ৪৩২ রান করে সর্বোচ্চ রান স্কোরারের তালিকায় বিশ্বে ৩ নাম্বারে আছেন। ৬ ম্যাচে ২টি করে শতক ও অর্ধশতক করেছেন। সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওডিয়াই সিরিজে অনেক গুলো রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন কায়েস। ৩ ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান (৩৪৯) করে তামিমের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন, আর মাত্র ১২ রান করতে পারলে বিশ্ব রেকর্ডও করতে পারতেন। তবুও তিন ম্যাচ সিরিজে ১৪৪, ৯০, ও ১১৫ রান করে বিশ্বে ২য় সর্বোচ্চ রান স্কোরার এখন ইমরুল। ইমরুল তার ক্যারিয়ারে কখনো টানা ৩ ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করতে পারেন নি। এবারই প্রথম করলেন। হাল না ছেড়ে দিয়ে, চেষ্টা করে গিয়েছেন। নিজেকে প্রমাণ করার মিশনে হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য ব্যর্থ হয়ে অনেক দিনের জন্য বঞ্চিত হয়েছেন। তবুও থেমে থাকেন নি। বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েও ক্যারিয়ার কে ভাঙ্গন গড়নের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া, ৩১ বছর বয়স্ক ইমরুলের এটাই সঠিক সময়, ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করার। যে শুরুটা পেয়েছেন, তা কনটিনিউ করার। অন্য সময় ইমরুলের ইনিংসে অনেক ভুল থাকতো, তবে এবারের সিরিজে দু একটা ছোটখাটো ভুল ছাড়াই, সে অসম্ভব ভাল খেলেছে। ওডিয়াইতে যেমন ভাল করতেছেন, আশা করবো অন্য দুটি ফরমেটেও নতুন, যোদ্ধা ইমরুল কে দেখতে পাবো। জিম্বাবুয়ে সিরিজের পারফর্ম করাকে নিজের জন্য শুরু ভেবে আগামী দিন গুলোতে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন ইমরুল, এমনটাই চাওয়া থাকবে আমাদের। শুভ কামনা ইমরুলের জন্য। আগামীর পথচলা হোক সাফল্যমণ্ডিত, সেই কামনাই করি। পরিশেষে, ক্যারিয়ার স্টেটস ও ইমরুলের কিছু অর্জন... টেস্টঃ ম্যাচ ৩৪| ইনিংস ৬৬| রান ১৬৭৯| গড় ২৬.২৩| বেস্ট ১৫০ রান| ফিফটি ৪| সেঞ্চুরি ৩ ওডিয়াইঃ ম্যাচ ৭৬| রান ২৪৩২| গড় ৩২.৮৬| ফিফটি ১৬| সেঞ্চুরি ৪| বেস্ট ১৪৪ টি টুয়েন্টিঃ ম্যাচ ১৪| ইনিংস ১৩| রান ১১৯| গড় ৯.১৫| স্টাইক রেট ৮৮.৮১| বেস্ট ৩৬ ঘরোয়া ক্রিকেটে রানঃ ম্যাচ ১০০| রান ৬১১১| গড় ৩৫| সেঞ্চুরি ১৭| ফিফটি ২৩ বেস্ট ২০০ রান ★ ওডিয়াই সেঞ্চুরি গুলোঃ ১ম টি ১০ নাম্বার ম্যাচে (১০১ রান) নিউজিল্যান্ড এর বিরুদ্ধে ২০১০ সালে ২য়টি ৬০ নাম্বার ম্যাচে (১১২ রান) ইংল্যান্ড এর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ৩য় টি ৭৪ নাম্বার ম্যাচে (১৪৪ রান *বেস্ট) জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে ৪র্থ টি ৭৬ নাম্বার ম্যাচে (১১৫ রান) জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে। ★কায়েস মোট ৪বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হোন ওডিয়াইতে। ★মুশফিকের ইনজুরিতে কায়েস এক ম্যাচে কিপিং করেন এবং ৫টি ডিসমিসালও করেন। ★টেস্ট ক্রিকেটে কায়েস মোট ৩৪ টি বলও করেন, যদিও কোনো উইকেটের দেখা পাননি। @Fb:www.facebook.com/ILoveRUR