• ফুটবল

ভাভা : পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া এক মহানায়ক

পোস্টটি ৩৭৬০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে যখন ব্রাজিল মাত্র ৪ মিনিটের মাঝেই পিছিয়ে পড়ে, তখন একজন 'ভাভা' সেন্টার সার্কেলে বল বসিয়ে পেলেকে বলেছিল, “পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা গোল শোধ করব”! আর ভাভা সেই গোল শোধ করতে সময় নিয়েছিল মাত্র ৪ মিনিট! ব্রাজিল সেই ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ৫-২ গোলে!

 

 

বলছিলাম, পর্দার আড়ালের এক নেতার কথা, এক দিশারির কথা। পুরো নাম, এদভিলদো জিজদিতো নেতো। ডাক নাম ভাভা। জন্মেছিলেন, ব্রাজিলের রিফিফিতে, ১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর। তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু ব্রাজিলের স্থানীয় ক্লাব ভাস্কো দ্য গামাতে। তিনি এমন একটা সময়ে বেড়ে উঠেছেন যখন একই সাথে কিংবদন্তি পেলে, গারিঞ্চারাও বেড়ে উঠছিলেন। ৫৮ বিশ্বকাপ কিংবা ৬২, ব্রাজিলের সেই স্বর্ণযুগের কথা উঠে আসলেই সর্বদা উচ্চারিত হয় পেলে গারিঞ্চার কথা, কিংবা জিতো নিল্টনদের কথা। কিন্ত ভাভা'র কথা স্মরণ করি কয়জন??

 

অথচ তিনি ছিলেন একজন মেন্টরের মত। কোন চাপ কে কেয়ার না করা একজন মানুষ। গারিঞ্চা একবার ভাভা'র কথা বলেছিলেন এভাবে, দলের সদস্য রা কখনো কোন ম্যাচ নিয়ে কিংবা কোন পরিস্থিতি নিয়ে চাপ ফিল করলে যে মানুষটি একগাদা সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতো, সেই মানুষটি হলো ভাভা।

 

মারাকানা ট্রাজেডির পর পুরো ব্রাজিল জাতি ছিল শোকবিদ্ধ্বস্ত। হয়তো কেবলমাত্র বিশ্বকাপ জয়ই পুরো জাতীকে নতুন করে জাগাতে পারতো। সেই শোকের মাঝেই, ব্রাজিলে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়। যারা শৈশবে দেখেছেন, একটা ম্যাচের পরাজয় কিভাবে পুরো জাতিকে স্থবির করে দেয়, তারা দেখেছেন একটা পরাজয় কিভাবে তাদের চারপাশের মানুষদের আকাশ শোকের কালো ছায়ায় ঢেকে যায়। সেই শোককেই প্রেরণা করে ব্রাজিলে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়। পেলে, গারিঞ্চা, জিতো, নিলটন, ভাভা সেই সোনালী যুগের কান্ডারী ছিলেন। যারা একটা দেশকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন, যারা দেশের ফুটবলের চেহারা পালটে দিয়েছিলেন, ফুটবল বিশ্বের মানচিত্রে শক্তিশালী এক দল হিসেবে ব্রাজিলের নাম নতুন করে চিনিয়েছিলেন।

 

১৯৫৮ বিশ্বকাপের মিশন শুরু হয় অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে, সেই ম্যাচে পেলে ও গারিঞ্চা বাদেই জয় পায় ব্রাজিল। দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও পেলে গারিঞ্চা নামেননি, সেই ম্যাচ হয়েছিল গোলশূন্য ড্র। তৃতীয় ম্যাচে দলে পরিবর্তন আনেন কোচ, ম্যাচ ছিলো শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে, সেই ম্যাচে মাঠে নামেন পেলে এবং গারিঞ্চা। বসিয়ে রাখতে পারেননি। গত দুই ম্যাচের স্ট্রাইকার মাজ্জোলার বিকল্প হিসেবে সেই ম্যাচে প্রথম মাঠে নামেন ভাভা। সেই ম্যাচে ৩ মিনিটের মাথায় বিশ্বকাপে নিজের প্রথম গোল করেন ভাভা, সেই ম্যাচেই ৭৭ মিনিটে নিজের ও দলের হয়ে দ্বিতীয় গোল করেন ভাভা। শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে নতুন ফরমেশনে এমন জয়ে উচ্ছ্বসিত ব্রাজিল, টুনার্মেন্ট জুড়েই আস্থা রাখে এই ত্রয়ীর উপরে। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২ মিনিটেই গোল করেন ভাভা। সেই ম্যাচ ব্রাজিল জিতেও যায়, কিন্তু ম্যাচটি স্মরণীয় অন্য কারণে, কেনোনা এই ম্যাচেই কিংবদন্তি পেলে পেলে পেয়েছিলেন তার প্রথম হ্যাট্রিক। 

 

ফাইনাল ম্যাচ। স্বাগতিক সুইডেনের মুখোমুখি ব্রাজিল। ফাইনালে যাওয়া মাত্রই ব্রাজিলবাসীর মনে উঁকি দেয় সেই মারাকানা ট্রাজেডির শংকা। খেলোয়াড়দের মাঝেও সেই জুজুর প্রভাব দেখা যায়। ফেভারিট সুইডেনের বিপক্ষে এমন পাহাড়সম চাপ নিয়েই কিনা ম্যাচ শুরু হতেই গোল হজম করে বসে ব্রাজিল। নিমিষেই ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের চোখেমুখে তখন নানান আশংকার ছাপ স্পস্টমুর্তি ধারণ করতে থাকে। তখন ভাভা এগিয়ে এসে বল নিয়ে, সেন্টার সার্কেলে বসিয়ে পেলেকে বলেছিলেন- তুমি তোমার স্বভাবসুলভ খেলাটা খেলতে থাকো, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা গোল শোধ করব! গারিঞ্চার দুর্দান্ত থ্রু পাস থেকে চার মিনিটের মাঝেই দারুণ এক গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান ভাভা। ৩২ মিনিটে আবারও ভাভা ম্যাজিক। আর সেই ম্যাচে পেলের জোড়া গোল এবং জাগালোর এক গোলে সুইডেনকে ব্রাজিল হারিয়েছিলো ৫-২ গোলে, আর পেয়েছিলো প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ।

 

১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হোন পেলে। ৫ গোল করা ভাভার অবদান যেনো ম্রিয়মান হয়ে গিয়েছিলো পেলের অতিমানবীয় পারফরমেন্সের আলোয়।

 

১৯৬২ সালে ফেভারিট ব্রাজিল। কিন্তু ইঞ্জুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় সকলের আশার প্রদীপ পেলের। পেলের অবর্তমানে দায়িত্বটা এসে বর্তায় গারিঞ্চার উপর, যিনি ৫৮ বিশ্বকাপে পেলের দাপটে ছিলেন পার্শ্বনায়ক। ৬২ বিশ্বকাপের আক্রমণ ভাগের মুল দায়িত্ব পড়ে গারিঞ্চা ভাভা জুটির উপর। টুনার্মেন্টে ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো ব্রাজিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টারে অন্য একটি গোল করেন ভাভা গারিঞ্চা জুটি। সেমিফাইনালেও চিলির বিপক্ষেও গোলধারা বজায় রাখেন গারিঞ্চা ভাভা জুটি। ব্রাজিল পৌছে যায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে। 

 

ফাইনাল ম্যাচ, এবারও মাত্র ১৫ মিনিটে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল। মাসোপুসত গোল করে সমতায় আনে ব্রাজিল কে। পরের গোল করেন আরমানদিলো। ৬৯ মিনিটে জিতো আর আর ৭৮ মিনিটে করা ভাভার গোলে টানা দ্বিতীয় বারের মত বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়ে ব্রাজিল।

 

১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে করেছিলেন ৫ গোল, ১৯৬২ বিশ্বকাপে করেছিলেন ৪ গোল, প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছিলেন পরপর দুটি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার গৌরব। পেলে, গারিঞ্চা কিংবা জিতো, আরমানদিলো; ভাভা সবসময় থেকে গেছেন এই প্রদীপের ছায়ায়, পর্দার আড়ালে।

 

পেলে গারিঞ্চার নাম আমরা সবাই জানি।

৫৮ কিংবা ৬২ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর ভাভাকে আমরা কয়জন জানি?? কিংবা জিতো আরমানদিলো জাগাও'কেও কি সেভাবে স্মরণ করা হয়?? হয়না। সেইসময়কার ব্রাজিল ছিলো দুর্দান্ত, অপ্রতিরোধ্য। ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম দলটির সবচেয়ে সেরা প্রজন্ম। যারা প্রত্যেকে নিজেকে চিনিয়েছেন অনন্যভাবে, কেউবা রয়েছেন সকল আলো কেড়ে নিয়ে, আবার কেউবা হয়তো পর্দার আড়ালে নিভৃতে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় অনন্য অসাধারণ ভাভাদের কথা লেখা থাকবে অনন্য উচ্চতায়, স্বর্ণাক্ষরে।