• ফুটবল

একটি গোল্ডেন গোল, একটি স্বর্ণালী ট্রফি!

পোস্টটি ৩০৯৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

জানুয়ারী, ২০০৩।

 

গল্পটা অজানা নয়, তবে সেটা পুরোনো হয় না যেন!

 

সেবারই প্রথম বাংলাদেশের মাঠে বসেছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। এর আগে বাংলাদেশের সেরা অর্জন ছিল রানার্স-আপ হওয়া। তাই ঘরের মাঠে নিজেদের দর্শকের সামনে ভাল কিছু করে দেখানোর তাগিদ ছিল প্রতিটি খেলোয়াড়ের মধ্যেই। বাংলাদেশ দলে আশি কিংবা নব্বই দশকের মত তারকার ছড়াছড়ি ছিল না, তবে কোচ জর্জ কোটান বেশ ভারসাম্যপূর্ণ্য একটি দল গড়েছিলেন। সেই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ম্যাচকে অনেকেই মনে করেন এদেশের ইতিহাসের সেরা দুই ম্যাচ।

সেমিফাইনাল আর একটি গোল্ডেন গোল!

 

১৮ জানুয়ারী, ২০০৩। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দল ভারত। সেবার টুর্নামেন্টটা আবশ্য ভাল যায়নি তাদের; চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে হেরে নিজেদের গ্রুপে রানার্সআপ হয়েছিল তারা। তবে সাফের এর আগের চার আসরের মধ্যে তিনবার চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে তো আর জয়ের নিশ্চয়তা দেওয়ার সাহস ছিল না কারও! সে ম্যাচটা ছিল বরং ফাইনালের আগে আরেক ফাইনাল।

কোটানের প্রিয় ৫-৩-২ ফর্মেশনেই খেলতে নামে বাংলাদেশ। শুরু থেকেই বাংলাদেশ ‘পাস অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে খেলতে থাকে। দুই উইংব্যাক হাসান-আল-মামুন এবং পারভেজ বাবু ক্রমাগত ওভারল্যাপ করে উঠে আক্রমনে সহায়তা দিতে লাগলেন। পরিকল্পনা খুব দ্রুতই কাজে লাগাতে শুরু করলো বাংলাদেশ। ম্যাচের কেবল পাঁচ মিনিট। এগিয়ে যেতে পারত তখনই। তবে কাঞ্চনের হেড গোললাইন থেকে অসাধারণ এক সেভে ফিরিয়ে দেন ভারতের গোলকিপার ক্লাইম্যাক্স লরেন্স। বাংলাদেশের দলের অনেকেই এখনো বিশ্বাস করেন, গোললাইন প্রযুক্তি থাকলে সেটি গোলই পেত বাংলাদেশ। ম্যাচে এগিয়ে যাওয়ার এমন সুযোগ মিসের পরও নিয়মিত বিরতিতেই আক্রমণ চালিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের রক্ষণভাগের সামনে আটকে যাচ্ছিল আরমান-মুন্নাদের সব প্রচেষ্টাই। বাংলাদেশের অ্যাটাকিং ফুটবলের ফাঁকে কাউন্টার অ্যাটাকে বেশ কয়েকবার সুযোগ পেয়েছিল ভারতও। তবে দুইবারই পল আঞ্চেরির শট ফিরিয়ে দেন গোলপোস্টের নিচে থাকা আমিনুল; প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশুন্য অবস্থাতেই।

টুর্নামেন্টের আগের ম্যাচগুলোতে দ্বিতীয়ার্ধে ট্যাকটিকস বদলে ৫-৩-২ ফর্মেশনে চলে যেত বাংলাদেশ। মানে হলো, হাসান-আল-মামুন ও পারভেজ বাবু তখন ডিফেন্সিভ মিডের পজিশনে খেলতেন আর মূল খেলাটা তৈরি হতো মিডফিল্ডার মুন্না ও আরমানের মাধ্যমে। তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে ভারতের বল নিজেদের পায়ে রাখার চেষ্টা দেখে এই ম্যাচে ভিন্ন কৌশল নিলেন কোচ। কাজেই ডিফেন্সিভ না হয়ে বরং অ্যাটাকে গেলেন তিনি।  লেফটব্যাক পারভেজ বাবুকে উঠিয়ে ভুটানের বিপক্ষে জোড়া গোল করা স্ট্রাইকার ফরহাদকে নামালেন। বাংলাদেশের রক্ষণভাগ কিছুটা দূর্বল হয়ে গেল, আর সেই সুযোগে বাঁ দিক দিয়ে ভারতের ডি চুনহা-বিশ্বাসরা বাংলাদেশের রক্ষণ ভেদ করে ঢুকে পড়লেন বেশ কয়েকবার। তবে বাংলাদেশের তিন সেন্টারব্যাকের সামনে প্রতিপক্ষের সব আক্রমণই আটকে যায়। অবশেষে বাংলাদেশের কোচের নেওয়া সাহসী ঝুঁকিটাই কাজে দেয়। ৭৭ মিনিটে কর্নার পেলো বাংলাদেশ। আরমানের মাপা শট সেকেন্ড পোস্টে, সেখান থেকে লাফিয়ে উঠে হেড করলেন কাঞ্চন। ক্লাইম্যাক্স লরেন্স এবার আর গোলপোস্ট থেকে বল ফেরাতে পারেন নি।

বাংলাদেশকে উঁকি দিচ্ছে ফাইনাল। সে উত্তেজনাতেই কিনা হটাৎ অগোছালো হয়ে গেল সব, যে সুযোগটা কাজে লাগালো ভারত। কাঞ্চনের গোলের চার মিনিট পর বাংলাদেশ ডি-বক্সের কিছুটা বাইরে বল পান ভারতের আলভিটো ডি চুনহা। ডি-বক্সের সামনে একাই দাঁড়ানো আলভিটোকে ট্যাকল করতে কিছুটা গড়িমসি করলেন ডিফেন্ডার। গোলরক্ষক আমিনুলও ছিলেন গোলপোস্ট থেকে কিছুটা বাইরে। আচমকা শট নিলেন আলভিটো। আমিনুলের মাথার উপর দিয়ে বল জালে। খেলায় সমতা। টুর্নামেন্টে সেই প্রথম বাংলাদেশের জালে বল। টানা ৩৫১ মিনিট নিজের পোস্ট অক্ষত রাখলেও মুহূর্তের ভুলে গোল খেয়ে বসলেন আমিনুল। তার মিনিট কয়েক পর আবার বিপদে পড়লো বাংলাদেশ। তবে গোলপোস্টের খুব কাছ থেকে ভারতের স্ট্রাইকার বিজয়নের শট ক্রসবারের উপর দিয়ে যায়, ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যায় বাংলাদেশ।

ফুলটাইমে ১-১। এবার অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের পালা। তখন গোল্ডেন গোলের নিয়ম, প্রথমে যারা গোল করবে তারাই জিতবে ম্যাচ!

অতিরিক্ত সময়ে গ্যালারির উত্তেজনা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। একটি গোলেই বদলে যেতে পারে সব। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই আলফাজের বদলে মাঠে নামেন উজ্জ্বল। এর পাঁচ মিনিট পর অভিজ্ঞ হাসান আল-মামুনের জায়গায় নামানো হলো টিটুকে। দুই দলই নিজেদের রক্ষণ সামলে আক্রমণে উঠার চেষ্টায় ব্যস্ত।

 

তবে গোলের জন্য অপেক্ষার প্রহর বেশি হতে দেননি বাংলাদেশের মিডফিল্ডার মতিউর মুন্না। অতিরিক্ত সময়ের কেবল ৮ মিনিটেই মাঝমাঠে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে মতিউর মুন্নার ভোঁ দৌড়, এরপর কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে প্রায় বিশ মিটার দূর থেকে আচমকা জোরালো লং-রেঞ্জ শট। পুরো ভারতীয় দলকে হতবাক করে বল গিয়ে পড়লো ভারতীয় গোলপোস্টের জালে। গোল্ডেন গোল!

 

‘গোল্ডেন গোল’ নামটির সার্থক উদাহরণ ছিল মতিউর মুন্নার গোলটি। এদেশের ফুটবলের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের পেছনে এই গোলটির ভূমিকা ছিল স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। গ্যালারিতে তখন উৎসবের জোয়ার, অনেকচেষ্টার পর অবেশেষে সাফ ফুটবলে ভারত বধ। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোলটিই এল মুন্নার পা থেকে।

 

স্বপ্নের ফাইনাল, স্বর্ণালী ট্রফি!

 

২০ জানুয়ারী, ২০০৩।

 

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তখনকার শেরাটন হোটেলেই ছিল বাংলাদেশ ফুটবল দল। ফাইনাল ম্যাচ খেলতে যাওয়ার আগে হোটেলেই শেষ টিম মিটিংটা সেরে নিয়েছিলেন কোচ জর্জ কোটান। প্রতিপক্ষ মালদ্বীপের বিপক্ষে নিজেদের স্ট্র্যাটেজি আর ট্যাকটিকস আরো একবার মনে করিয়ে দিলেন কোচ। “সবার মধ্যেই দেখিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা ছিল। ঘরের মাঠে শিরোপাটা কেউ হাতছাড়া করতে চায়নি। সবাই নিজেদের শেষ টুর্নামেন্ট মনে করেই খেলতে নেমেছিলাম সেবার। আর কোচ জর্জ কোটান একটা পরিবারের মত আগলে রেখেছিলেন আমাদের”, এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন কাঞ্চন।

 

বাংলাদেশ দল আর প্রিয় শিষ্যদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কান্নায়ও ভেঙে পড়েছিলেন কোটান। বাংলাদেশকে নিজের দ্বিতীয় মাতৃভূমি মনে করতেন এই হাঙ্গেরিয়ান। তাই বাংলাদেশের প্রতি তার আবেগটাও ছিল অন্যরকম। জর্জ কোটানের মত সব ফুটবলাররাই দেশকে একটি শিরোপা এনে দিতে মরিয়া ছিলেন। টিম হোটেলের আবেগঘন মুহূর্ত কাটিয়ে সন্ধ্যায় মাঠে নেমেছিলেন আমিনুল, আলফাজরা।

 

তবে এই ম্যাচে নিয়মিত অধিনায়ক রজনী খেলতে পারেননি টুর্নামেন্টের দুই ম্যাচে হলুদ কার্ড পাওয়ায়। অন্যদিকে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন গোলকিপার আমিনুল হক। রজনীকান্ত বর্মনের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড দেয়া হয় অভিজ্ঞ রাইটব্যাক হাসান আল-মামুনকে। আর রজনীর বদলে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলতে নামেন ফিরোজ মাহমুদ টিটু। সাদা-নীল জার্সির বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সেদিন কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। খেলার ১২ মিনিটেই স্বাগতিক দর্শকদের আনন্দে ভেসে যাওয়ার সুযোগ করে দেন বাংলাদেশের স্ট্রাইকার রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। বাম প্রান্ত থেকে এক মিডফিল্ডার বল বাড়িয়ে দিলেন ডি-বক্সের মধ্যে; সেখান থেকে ওয়ান টাচ শটে জাল ভেদ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে দেন তিনি। গোল পাওয়ার পর আরো অ্যাট্যাকিং খেলতে থাকে কাঞ্চনরা। তবে প্রথমার্ধে আর কোনো গোলের দেখা মিলেনি।

 

দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের চিরায়ত নিয়মে লিড ধরে রাখার লক্ষ্যে কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে খেলতে থাকে বাংলাদেশ। আর এই সুযোগে আক্রমণে আসতে থাকে মালদ্বীপ, সেটার ফলও পেয়ে গেল খুব দ্রুত। ডান প্রান্ত থেকে আসা ক্রসে আলতো করে পা ছোয়ালেন আলি উমার, গোল! সমতায় ফিরল মালদ্বীপ। এই গোলের পর ম্যাচ জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো বাংলাদেশ। আবারো ফর্মেশন বদলান কোচ, ডিফেন্সিভ থেকে অফেন্সিভ ফুটবল খেলতে শুরু করে মুন্না-জয়-আরমানরা। কিন্তু বাংলাদেশের স্ট্রাইকারদের শট আর মালদ্বীপের জালের দেখা পায়নি। সেমিফাইনালের মতো এবারও ১-১ গোলে শেষ নির্ধারিত সময়ের খেলা।

 

অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটে সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও আরেকটু হলেই আরেকটি গোল্ডেন গোল করে ফেলেছিলেন মতিউর মুন্না। কিন্তু তার নেওয়া শট এবার বারপোস্টে লেগে ফিরে আসে। দুই মিনিট পর আরেকটি সুযোগ পান মুন্না, কিন্তু বদলি খেলোয়াড় ফরহাদের ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।

 

বাংলাদেশের হয়ে প্রথম দুই শটেই জালে বল জড়ান নজরুল ও ফরহাদ। মালদ্বীপের আহমেদের নেওয়া প্রথম শটটা আমিনুল ঠেকাতে পারেন নি। দ্বিতীয় শট নিতে আসেন আশরাফ লুতফি। নিজের বাঁ দিকে শট নিলেন। তার নেওয়া শটটি ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরিয়ে দেন আমিনুল!

 

এরপর হাসান আল-মামুন ও মাহমুদুল হাসান কোনো ভুল করেন নি। দলের হয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ পেনাল্টি শটে গোল করেন তারা। তবে মালদ্বীপও পরের দুই শটে ভুল না করায় খেলা গড়ায় পঞ্চম শটে। ভাগ্যনির্ধারণী সেই পঞ্চম পেনাল্টি নিতে আসেন সুজন; শেষ শটে বাংলাদেশ গোল করতে পারলেই চ্যাম্পিয়ন। পুরো স্টেডিয়ামে তখন শুনশান নীরবতা। সঙ্গে চলছে প্রার্থনা।

 

সুজন প্রস্তুত। শট নিলেন ডান দিকে। কিন্তু গোলরক্ষক ঝাঁপ দিলেন উল্টো দিকে।

 

বল জালে। বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে উঠলো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। ততোক্ষণে জার্সি খুলে ভোঁ দৌড় শুরু করেছেন সুজন। চল্লিশ হাজারের বেশি দর্শক তখন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ধ্বনিতে কাপিয়ে তুলেছে পুরো স্টেডিয়াম। দেশের ফুটবল যেন ফিরে গেল সেই সোনালী দিনগুলোতে।

 

দীর্ঘ অপেক্ষার পরে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপখ্যাত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অবশেষে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় উঠলো বাংলাদেশের নাম। নিজের দ্বিতীয় মাতৃভূমি মনে করা বাংলাদেশকে একটি ‘স্বর্ণালী ট্রফি’ উপহার দিলেন কোচ জর্জ কোটান। আর আলফাজ, আমিনুল, কাঞ্চন, জয়, হাসান-আল-মামুনরা নিজেদের নামটা স্মরণীয় করে রাখলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের পাতায়! সঙ্গে ইতিহাসে ঢুকলেন মতিউর মুন্না, যার ‘গোল্ডেন গোল’ ঠিক করে দিয়েছিল সেই ‘স্বর্ণালী ট্রফি’র গতিপথটা!