চিহ্লা মং মারী: এক ফুটবল যোদ্ধা
পোস্টটি ৩২১৫ বার পঠিত হয়েছেচন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতাল। তার পাশেই ছোট্ট একটি মাঠ। এই মাঠেই ফুটবল খেলার শুরু বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ফুটবলারের। তিনি হলেন চিহ্লা মং চৌধুরী মারী। রাঙামাটির চন্দ্রঘোনায় জন্ম নেয়া এই কৃতি ফুটবলার মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন অবিভক্ত পাকিস্তান ফুটবল দলের জন্য। পাহাড় আর নদী ঘেরা চন্দ্রঘোনার মাঠে তিনি ফুটবল ছাড়াও খেলতেন ভলিবল, ব্যাডমিন্টন এবং অ্যাথলেটিকস। সব খেলাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন মারী। তবে মায়ের প্রেরণাতে এক সময় ফুটবলেই মনযোগ দেন পার্বত্য অঞ্চলের এই ফুটবলার। তাঁর বাঁ পায়ের ফুটবল ভেলকিতে নিজের নাম লেখান ইতিহসের পাতায়। তাঁকে বলা হয়ে থাকে ‘বাঁ পায়ের শিল্পী’!
চিহ্লা মং চৌধুরী মারী ছিলেন বোমাং রাজার বংশধর। তবে তাঁর বাবা থয়সাউ চৌধুরী খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার জন্য মারীর বাবাকে রাজ পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে মারী ছিলেন সবার ছোট। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিয়মিত ফুটবল খেলতেন মারী। তাঁর স্কুল জীবনের শুরু বরিশালের ব্যাপটিস্ট মিশন বয়েজ স্কুলে। এই বিদ্যালয় থেকেই ১৯৫৩ সালে এসএসসি পাশ করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৬ জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। তিন বছর পর একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন চিহ্লা মং চৌধুরী মারী। ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজের হয়ে খেলার সময় স্যার এএফ রহমান শিল্ড ও গভর্নরস কাপ জেতার গৌরব অর্জন করেন তিনি।
ইন্টারনেট ঘেটে খুব বেশি ছবি পাওয়া যায় না তাঁর। এই একটা ছবিই সম্বল!
পেশাদার ফুটবলে চিহ্লা মং চৌধুরী মারীর পথচলা শুরু ১৯৫১ সালে। চট্টগ্রাম লীগের ফিরিঙ্গি বাজার ক্লাবের হয়ে খেলেন নিজের প্রথম মৌসুমে। ১৯৫২ তে খেলেন চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের জার্সি গায়ে। সেই সময়েই তাঁর খেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ফলে পরের বছরেই মারী সুযোগ পান পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে দলে খেলার জন্য। এরপর চিহ্লা মং চৌধুরীর ফুটবলের গল্পটা ছিল রুপকথার মত। ক্যারিয়ারে রেলওয়ে ছাড়াও তিনি খেলেছেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আজাদ আজাদ স্পোর্টিং, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা মোহামোডেন স্পোর্টিং ও আইপিআইডিসির হয়ে।
ঘরোয়া ফুটবল ছাড়াও জাতীয় দলের হয়েও দুর্দান্ত নৈপূণ্য দেখিয়েছেন চিহ্লা মং চৌধুরী মারী। পাকিস্তান ফুটবল দলের হয়ে খেলেছেন ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৪ সালে ম্যানিলায় এশিয়ান গেমসে সর্ব কনিষ্ঠ হিসেবে পাকিস্তান দলে ডাক পান তিনি। তিনি জাতীয় দলের হয়ে শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, চীন, জাপানের টোকিওতে ও ভারতের কলকাতায় খেলেছেন। তাছাড়া তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত ত্রয়ী কবির-আশরাফ-মারী। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে মারীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান সাদা দল ফাইনালে ২-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে রানার্সআপ হয়। তবে সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠে তাঁর হাতেই।
চিহ্লা মং চৌধুরী বেশিরভাগ সময় খেলতেন ফরোয়ার্ড হিসেবে। তাছাড়া লেফট ইন পজিশনেও খেলতেন তিনি। তাঁর ড্রিব্লিং, বল রিসিভিং আর বাঁ পায়ের দুরন্ত শট দেখতে সে সময় ঢাকার মাঠে হাজার হাজার দর্শকের সমাগম ঘটত। তিনি নিজে গোল দিতেন এবং অন্যকে দিয়েও করাতেন। বল পায়ে তাঁর ড্রিব্লিং ছিল বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মত সাবলীল। তাঁর খেলার মধ্যে ছিল এক যাদুকরী মাধুর্য। খেলার মাঠে মারী ছিলেন সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র ও মার্জিত ফুটবলার। আর তাই তো খেলার মাঠে তাঁর দর্শকের কমতি পড়ত না কখনো। নিজের আপন বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁকে আদর্শ মানতেন বাংলাদেশের অসংখ্য তারকা ফুটবলার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু কিংবা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ফুটবল কিংবদন্তিদের সাথে চিহ্লা মং মারী (নিচের সারির বাম থেকে দ্বিতীয়জন)
ফুটবল ছাড়াও অন্য খেলাতেও নিজের ছাপ রেখে গেছেন চিহ্লা মং চৌধুরী। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান জাতীয় অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় হাইজাম্পে স্বর্ণ এবং ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রুপা জিতেছিলেন তিনি। তাছাড়া ১৯৫৪-৫৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন পাকিস্তান জাতীয় ভলিবল দলেও। তবে এসব অর্জনের মাঝেও ফুটবলার মারী ছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার বলা হয়ে থাকে। ১৯৫৮ সালে এশিয়াডে খেলার সময় পায়ে ব্যথা পান মারী। সেই ব্যথার ফলে জাতীয় দল থেকে দূরে সরে যান। তবে ঘরোয়া লিগে খেলা চালিয়ে আরো কিছুদিন। সবশেষ ১৯৬৯ সালে বুট জোড়া তুলে রেখে ফুটবলকে বিদায় জানান রাঙামাটির এই কৃতি ফুটবলার। ফুটবল ছাড়ার পর কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন এই বাঁ পায়ের জাদুকর। তিনি দীর্ঘদিন ইউপিআইডিসি, বিজি প্রেস এবং টিসিবি’র মত ক্লাবের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন।
ফুটবলার মারীর আরো একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়ে আগরতলায় ১ নং সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেন এই বীর। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রীয় পদক পান বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি এই বীর যোদ্ধা। ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ হতে সেরা ফুটবলার হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয় চিহ্লা মং চৌধুরী মারীকে।
২০১২ সালের ৯ মে ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মারী। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন স্কিন সিরোসিস ও আলঝেইমার রোগে। আলঝেইমার রোগের ফলে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে রোগী। এই দুরারোগ্য রোগ চিহ্লা মং চৌধুরীর ফুটবল স্মৃতি হয়ত মুছে দিচ্ছিলো একটু একটু করে। তবে ফুটবল মাঠে তিনি যা কীর্তি গড়েছেন, তা কখনোই মুছে যাবে না। এই পাহাড়ি যোদ্ধার ফুটবল গল্প স্মৃতিপটে জমে থাকবে আজীবন!
- 0 মন্তব্য