• ক্রিকেট

মিরাজের আরজি

পোস্টটি ৪৫৬৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মেহেদী হাসান মিরাজ। এক টগবগে তরুণের নাম। অসম্ভব কিছু করার প্রবণতা যার মধ্যে প্রবল ভাবে কাজ করে। উদ্যমী, দারুণ সাহসী এক ক্রিকেট যোদ্ধার নাম মেহেদী হাসান মিরাজ। বয়স মাত্র ২১, কিন্তু এখনই তার প্রশংসা হচ্ছে সারা ক্রিকেট দুনিয়াময় । এই বয়সে তার যা অর্জন তা নিয়ে লিখলেও ছোটখাটো উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললুম বোধহয়।  আচ্ছা হোক না একটু বাড়াবাড়ি, কিছু বিষয়ে বাড়াবাড়ি জোড় করেও থামানো যায় না। আর মিরাজ তো প্লেয়ারই এমন, যে তাকে নিয়ে  বাড়াবাড়ি করাটা দোষের কিছু নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে এই বয়সে অনেক ক্রিকেটারের ডেবুই হয়না। আর মিরাজ ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন তারকাখ্যাতি। আচ্ছা মিরাজ ও তার সফলতা নিয়ে অন্য সময় বলা যাবে। আজ বরং একটা অন্য বিষয় নিয়ে বলি।

আচ্ছা জাতীয় দলে মিরাজ ঠিক কি হিসেবে খেলেন? সব ফরমেট বাদই দিলাম, ওয়ানডেতে মিরাজের ভূমিকাটা ঠিক কি? বোলার? অলরাউন্ডার?  ব্যাটসম্যান যে না সে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যদি বোলার হিসেবে তাকে দলে নিয়ে থাকে তবে কিছু বলার নাই। না,  একেবারে না বললে বড্ড বেমানান লাগবে। আচ্ছা জাতীয় দলে ঢুকার আগে মিরাজ যখন U-19 দলের হয়ে খেলতো বা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতো, তখন সে ঠিক কি হিসেবে খেলতো, সেটা কি জানেন? আমিই বলছি, একজন জেনুইন অলরাউন্ডার (লাইক সাকিব আল হাসান) এর মতোই খেলতো মিরাজ। কিন্তু অলরাউন্ডার মিরাজ থেকে জাতীয় দলে ঢুকে হঠাৎ বোলার মিরাজের আবির্ভাব টা আমি ব্যক্তিগত ভাবে ঠিক মেনে নিতে পারছি না। ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ব্যাটে বলে ঝলক দেখিয়েই তো মিরাজ প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছিল, আর সেই পারফর্ম বিবেচনায় মিরাজ জাতীয় দলেও নিজের যায়গা করে নিয়েছিল। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের পারফর্মের পর ক্রিকেট প্রেমীরা ভেবেছিল ব্যাটসম্যান হিসেবেই হয়তো মিরাজ জাতীয় দলে ঢুকছে, কিন্তু না,, অভিষেক টেস্ট সিরিজে ক্যারিশমেটিক বোলিং পারফর্ম দিয়ে ইংল্যান্ড কে ধরাশায়ী করার পর মিরাজ হয়ে গেলেন পুরোদম্ভর এক বোলার। 

আচ্ছা যদি অলরাউন্ডার হিসেবে মিরাজ জাতীয় দলে খেলে থাকে তাহলে কি তার ব্যাটিং পজিশন ৮ হওয়ার কথা? সে কি ৮ নাম্বার পজিশনে ব্যাট করার মতো ব্যাটসম্যান? এটিই আজকের বিষয়...

এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে মিরাজ ১৮ ম্যাচের ৩৪ ইনিংসে ব্যাট করে রান করেছেন ৫৪৩ (বল ফেস করেছে ১০৭২টি) গড় ১৯.৩৯। সর্বোচ্চ ৬৮*। সেঞ্চুরি না থাকলেও (যেই পজিশনে ব্যাট করে সেখানে সেঞ্চুরি করার মতো যোগ্য সাথি যেমন থাকে না, তেমনি উইকেটে ধরে খেলার মতো অবস্থাও থাকে না।) হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে ২ টি। যার একটি ভারতের মাটিতে, ভারতের বিশ্বসেরা বোলিংয়ের বিপক্ষে। তখন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম লিজেন্ডারি অলরাউন্ডার, ভারতের ১ম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক  সাবেক ক্রিকেটার কপিল দেব কমেন্টারি করতে গিয়ে বার বার বলছিলেন এই ক্রিকেটার ভবিষ্যতে তার ব্যাটিং দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করবে। তার খেলার ধরণ অসাধারণ। ব্যাটে দারুণ স্ট্রোক রয়েছে তার। ব্যাটিংয়ে শর্ট বাছাই কিংবা ধৈর্য ধরে ব্যাটিং করার যে কৌশল, সবই তার মধ্যে বিদ্যমান। ততোদিনে বোলার মিরাজের পরিচয় জেনে নিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেট।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মিরাজ ২৪ ম্যাচের ১৫ টিতে ব্যাটিং করে ২৫৪ রান করে। ফিফটি করেছেন ১টি। গড় আন্ডার ২০। 

টি টুয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালেও ১৩ ম্যাচের ১১ ইনিংসে ব্যাট ৯৮ রান করেছে মিরাজ। তার এই ব্যাটিং ক্যারিয়ার দেখে আপনাদের মনে হতেই পারে, মিরাজ কি আদৌ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার উপযুক্ত? কিংবা ব্যাটসম্যান মিরাজকে লেখারই বা তেমন কি আছে? কিন্তু, ব্যাটসম্যান মিরাজের ফার্স্ট ক্লাস আর লিস্ট এ ক্রিকেটের স্ট্যাট দেখলে অবশ্য ভুল ভাঙ্গবে আপনার। অবশ্য জাতীয় দলে ঢুকার পূর্বের মিরাজ সম্পর্কে ধারণা থাকলেও আপনি ভিন্ন মত পোষণ করবেন এই ইয়াং স্টারের ব্যাপারে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৩১ ম্যাচে তার রান ১০৮২ ,'আর লিস্ট এ' ক্রিকেটে ৬৩ ম্যাচের ৫০ টিতে ব্যাট করে ৯৭২ রান করেছে সে। গড়ও ঈর্ষন্বীয়, ৫২। আচ্ছা ওয়ানডেতে ৮ নাম্বার পজিশন টা কি ব্যাটিং এর জন্য? এই পজিশনে সাধারণত খেলে থাকে বোলাররাই। আর যদি কোনো দল ব্যাটসম্যান খেলিয়েও থাকে, তবে ব্যাটে পাওয়ার আছে, হার্ড হিটিং করতে পারে এমন ব্যাটসম্যানদের দিয়েই খেলিয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে মিরাজ কি হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান ? উত্তর হবে না। তবে হ্যা, তার ব্যাটে স্ট্রোকের কমতি নেই, দারুণ শর্ট রয়েছে তার হাতে। ব্যাটিংয়ে যথেষ্ট ক্লাস আছে তার। ব্যাটিংটা সে ভালই করে ফেলে, এটা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ সে পুরোধম্ভর ব্যাটসম্যানই। সদ্য সমাপ্ত বিপিএলে সে কিছু ম্যাচে ওপেনও করেছে, এবং সাফল্যও পেয়েছে। ইভেন আসরে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান দের মধ্যে সে-ই প্রথম অর্ধশতক করে। অর্থাৎ, টি টুয়েন্টিতেও যে প্লেস পেলে ব্যাটসম্যান মিরাজের পারফর্ম করার সামর্থ্য আছে সেটা সে প্রমাণ করেছে। এবার আসি, গত এশিয়া কাপের ফাইনাল নিয়ে। এশিয়া কাপের শুরুতেই তামিম ইনজুরিতে পরে যাওয়ায় পুরো টুর্নামেন্টে ওপেনিংয়ে চরম ব্যর্থ ছিল বাংলাদেশ দল। কোনো ম্যাচেই ওপেনিংয়ে ভাল শুরু তো দূরে থাক, দাঁড়াতেই পারেনি আমাদের ওপেনাররা, কেউই ঠিক ধাতস্থ হতে পারেনি। পরে সাকিবের ইনজুরি তে পড়ায়, এবং ফাইনাল মিস করায় তো বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং শক্তিই ক্ষীণ হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, কাপ্তান, বড় ভাই মাশরাফি ফাইনালের আগে বললেন যে ফাইনালে চমক থাকবে ব্যাটিং লাইনআপে। আমরা ক্রিকেট প্রেমীরা ভেবেছিলাম ম্যাশ হয়তো নিজেই ওপেন করতে নেমে যেতে পারেন, কারণ দলের বিপর্যয়ে ম্যাশ উপরের দিকে অনেক সময় ব্যাটিং করে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অতীতে অনেকবার। কিন্তু ম্যাচ শুরু হওয়ার পর বাস্তবিকই আমরা চমকে যাই, যখন দেখি লিটনের সাথে ওপেন করতে নেমেছেন মিরাজ! এবং ব্যাটসম্যান মিরাজ যে কতটা ব্যাটিং তকমা ডিজার্ভ করে তা সেদিন যারা তার খেলা দেখেছেন তারা বলতে পারবেন। যে ওপেনিং পজিশন ছিল পুরো টুর্নামেন্টে চরম ব্যর্থ, সেই ওপেনিংয়ে লিটন - মিরাজ জুটি ১০০+ রান করে পুরো চমকে দেয়। প্রথম বারের মতো ওপেনিংয়ে খেলতে নামা, যে কিনা আগে ব্যাট করতো নিয়মিত ৮-৯ পজিশনে, সে হঠাৎ খেলতে নামলো ওপেনিংয়ে, তাও এশিয়া কাপের ফাইনালের মতো মঞ্চে! শুধু কি তাই! ভারতের মতো বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে! যদিও ৩০+ রান করেছিল মিরাজ কিন্তু তার অ্যাপ্রোচ ছিল প্রশংসনীয়। সে নিজে খেলেছে এবং লিটন কে দারুণ সঙ্গ দিয়েছে, একই সাথে দলকে খেলায় রেখেছে পুরোটা সময়, যতক্ষণ ব্যাটিংয়ে ছিল। আর এটাই তার ব্যাটিংয়ে বড় গুণ। কিছুদিন আগে দেশের মাটিতে মুশফিক টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করলো। মুশি যখন ডাবল সেঞ্চুরির দ্বারপ্রান্তে, তখন তার সাথে অন্যপ্রান্তে ব্যাটিং করছিল মেহেদী মিরাজ। মিরাজের অসম্ভব দৃঢ়চেতা সঙ্গই মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি করতে অনেকটা সহায়তা করেছিল। এমনটা মুশফিকের ভাষ্য। তার মতে মিরাজের সাথে ব্যাটিং করা সব সময় আনন্দের। সে নিজে যেমন খেলে একই সাথে তার অন্যপ্রান্তে খেলা সঙ্গীকেও ভাল খেলতে যথেষ্ট সহায়তা করে। একই কথা বলেছিল পরের টেস্টে সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। রিয়াদ ভাইও যখন সেঞ্চুরি করেন তখন তার সাথে ব্যাটিং করছিল মিরাজ। সেঞ্চুরির পর মাহমুদুল্লাহ যতটা না উদযাপন করেছে, তার চেয়ে বোধহয় মিরাজ একটু বেশিই করেছিল। সে যতক্ষণ ব্যাটিং করে,তার সাথে খেলা ব্যাটসম্যানও ভাল খেলতে অনুপ্রাণিত হয়। মিরাজ এমনই, যোগ্য সঙ্গী পেলে সে যেমন নিজে ভাল খেলে ঠিক তেমনি সঙ্গীকেও ভাল খেলতে সাহায্য করে। ২১ বছর বয়স্ক মিরাজ ব্যাটসম্যান হিসেবে হার্ড হিটার নয়। তার হাতে হয়তো রীচ পাওয়ার নেই। কিন্তু টেকনিক্যালি যে শার্প এবং অসম্ভব মেধাবী একজন ব্যাটসম্যান, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। ক্লাসিক শর্ট তার ব্যাটে নিত্যদিন দেখি আর ভাবি, এই প্লেয়ার কি করে ৮-৯ এ ব্যাট করে। সেখানে কি করে সে ভাল করবে? না থাকে ওভার, না থাকে ভাল ইনিংস খেলার সিচুয়েশন কিংবা না পায় সে সে ব্যাট করার মতো যোগ্য সঙ্গী? আর না সে হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান যে বলে বলেই ব্যাট ঘুরিয়ে নিজের প্রতিভার সাক্ষর রাখবে। তাই বলে কি তার ব্যাটে স্ট্রোকের কমতি আছে এমনটা বলতে পারবেন? নাকি তার ব্যাটসম্যান সত্ত্বাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে পারবেন? সব মিলিয়ে বলতে চাই, মিরাজের ব্যাটিং করার পজিশন ৮-৯ না। এই পজিশনে ব্যাট করতে থাকলে তার প্রতিভা কে ধূলিসাৎ করা হবে। ক্যারিয়ার নষ্ট হবে ঐ পজিশনে ব্যাট করলে, বিশ্ব হারাবে একজন ক্লাসিক্যাল ব্যাটসম্যান কে, যে আগামী তে বিশ্ব মাতাবে তার ব্যাটিং শৈলী দিয়ে। মিরাজকে দমিয়ে রাখা হবে, যদি তার ব্যাটিং পজিশন প্রমোশন দেওয়া না হয়। লংকান লিজেন্ড জয়বর্ধনে বা উইন্ডিজ ব্যাটিং লিজেন্ড শিব নারায়ণ চন্দ্ররপল, যারা ব্যাটিং কে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, মিরাজেরও তাদের মতো হতে সহায়তা কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টককেই করতে হবে। সুতরাং বোলার মিরাজের আবির্ভাবে ব্যাটসম্যান মিরাজ সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে দিতে দেবেন না। আমার ব্যক্তিগত মত হলো ওডিয়াইতে মিরাজ কে পাঁচ অথবা ছয়ে খেলানো হোক। সে তার সামর্থ্যের সব টুকু দিয়ে চেষ্টা করে ভাল করার। কিন্তু সামর্থ্য থাকলেও যোগ্যতা প্রমাণের জন্য উপযুক্ত প্লেস পাচ্ছে না সে। তাকে সেই সুযোগ টা করে দিতে হবে। অসম্ভব পরিশ্রমী এবং উদ্যমী এই মিরাজের মধ্যে একজন ক্লাস ব্যাটসম্যান এর সব গুণাগুণই রয়েছে। এখন সেসব রিভিলের সুযোগ টা তৈরি করে দিতে বিসিবি টিম ম্যানেজমেন্ট কেই। [বি.দ্র: ক্যারিয়ার স্ট্যাট গুলো ১৯-০২-২০১৯ পর্যন্ত তার ক্যারিয়ার বিবেচনায় দেওয়া]