• ফুটবল

হোসে মরিনহো যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন চেলসিকে

পোস্টটি ২৫০০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০০৩-০৪ সিজন। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেকেন্ড রাউন্ডের ম্যাচ চলছে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। এওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে পোর্তোর বিপক্ষে এগিয়ে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ম্যাচ শেষ হওয়ার ঠিক ৩০ সেকেন্ড আগে বক্সের বেশ বাইরে ফ্রি-কিক পেল পোর্তো। স্তব্ধ হয়ে গেল ‘থিয়েটার অফ ড্রিমস’। হাওয়ায় ভেসে আসা বল ঠিকমত গ্রিপ করতে পারলেন না ইউনাইটেডের আমেরিকান কিপার টিম হাওয়ার্ড। লুজ বলটা চলে এল ফ্রান্সিসকো কস্তিনহার পায়ে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বলটা জালে পাঠিয়ে দিতেই কোচ মরিনহো টাচলাইন ধরে দিলেন এক দৌড়। ওই পাগুলে দৌড়ই ইংলিশ ফুটবলে এক নতুন মহাতারকার আগমনী বার্তার প্রতীক হয়ে রইল।

একই সময়ে চেলসিতে শুরু হয়েছে এক নতুন যুগ। শুরুটা করেছেন এক রাশান বিলিয়নিয়ার- রোমান আব্রামোভিচ। চেলসির এই নতুন মালিক দেদারসে টাকা ঢালতে শুরু করলেন তারকা খেলোয়াড়দের পিছনে। কোচ ক্লদিও রানিয়েরি প্রথম সিজনে (২০০৩-০৪) তেমন একটা খারাপও করেননি। অপরাজিত আর্সেনালের পিছনে থেকে লিগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করল তার দল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মোনাকোর কাছে হেরে বিদায় নিল সেমিফাইনাল থেকে। কিন্তু উচ্চাভিলাষী আব্রামোভিচের চাই ট্রফি। রানিয়েরি বিদায় নিলেন, আসলেন মরিনহো। প্রথম প্রেস কনফারেন্সেই দম্ভভরে ঘোষণা দিলেন, ‘You may call me arrogant, but I’m the Special One’.

মরিনহো প্রথমে শক্তিশালী ডিফেন্সিভ ইউনিট গড়ে তোলার লক্ষ্যে মনোযোগী হলেন। রেনে থেকে কিনলেন গোলকিপার পিটার চেককে। আগে থেকেই দলে ছিলেন জন টেরি, তার সাথে যোগ দিলেন পোর্তোর রিকার্দো কারভালহো। পাউলো ফেরেইরা আর উইলিয়াম গ্যালাস দুই ফ্ল্যাংক পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত হলেন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে রইলেন ক্লদ ম্যাকেলেলে। দুই ইংলিশ মিডফিল্ডার ফ্র্যাংক লাম্পার্ড এবং জো কোলকে সেন্ট্রাল মিড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হল। রাইট উইং-এ রাখা হল আগের সিজনেই দলে আসা ড্যামিয়েন ডাফকে। লেফট উইঙ্গার হিসেবে পিএসভি থেকে উড়িয়ে আনা হল আরিয়ান রোবেনকে। এবার দরকার একজন স্ট্রাইকার। ক্লাব রেকর্ড ভেঙ্গে মার্সেই থেকে চেলসিতে এলেন দিদিয়ের দ্রগবা। প্রতিটি পজিশনে অপোনেন্টকে টেক্কা দেয়ার মত দল তৈরি হয়ে গেল। ইতিহাস তৈরির গল্পের শুরুটা এভাবেই।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তখন রীতিমত অপ্রতিরোধ্য আর্সেন ওয়েঙ্গার। আগের সিজনেই আর্সেনালকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। আরও আছেন ইউনাইটেড কিংবদন্তি স্যার এলেক্স ফার্গুসন। লিভারপুলও বসে থাকবে কেন? বার্সা-রিয়ালকে পিছনে ফেলে ভ্যালেন্সিয়াকে লা লিগা জিতানো কোচ রাফায়েল বেনিতেজকে এনফিল্ড হটসিটে বসিয়ে দিল তারা। এইসব ট্যাকটিক্যাল মাস্টারমাইন্ডকে মোকাবেলা করতে নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন মরিনহো। ইংলিশ ফুটবলে তখন ৪-৪-২ ফর্মেশনের জয়জয়কার। এই ফর্মেশনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মরিনহো নিয়ে এলেন ৪-৩-৩। কি লাভ হলো তাতে? ৪-৪-২ কিংবা ৪-২-৪ ফর্মেশনে মূলত দুইজন খেলোয়াড় মিডফিল্ড সামলানোর দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। উইঙ্গার কিংবা ফুলব্যাকরা উঠানামা করে তাদের কভার দিয়ে থাকেন। ওদিকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে মিডফিল্ডে থাকেন তিনজন, ফলে একজন মিডফিল্ডার প্রায়শই ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান। এই ভাগ্যবান লোকটি যদি হন ম্যাকেলেলে, তখন তিনি পুরো গেমটা কন্ট্রোল করার মত স্পেস পেয়ে যান। আর যদি লাম্পার্ড কিংবা জো কোল ফাঁকা থাকেন, তখন সামনে এগিয়ে গোলমুখে সুযোগ সৃষ্টিতে তৎপর হন।

গোলপোস্টে পিটার চেক ছিলেন অনবদ্য। অসাধারণ রিফ্লেক্স আর ডাইভ তাকে বিশ্বসেরাদের কাতারে নিয়ে যায়। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে টেরি ‘স্টপার’ আর কারভালহো তার ‘কভার’ হিসেবে কাজ করতেন। টেরি ছিলেন একজন লিডার। এরিয়াল ডুয়েলে ছিলেন ‘বাই ডিফল্ট’ উইনার, সেই সাথে নিষ্ঠুরভাবে চার্জ করতেন এটাকারদের। দুই প্রান্ত থেকে ডি-বক্সের দিকে আসা ক্রসগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন দুই ফুলব্যাক গ্যালাস এবং ফেরেইরা। চেলসির এই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অভেদ্য করতে দায়িত্ব পেলেন ‘এংকরম্যান’ ক্লদ ম্যাকেলেলে। পাস ইন্টারসেপশন আর কড়া ট্যাকল করে চেলসির ব্যাক ফোর-কে যেমন সুরক্ষা দিয়েছিলেন, তেমনি ডিফেন্স আর মিডফিল্ডের মাঝে মেলবন্ধনের কাজটিও করেছেন ঠিকঠাক। একই রোলে থাকা সমকালীন রয় কিন আর প্যাট্রিক ভিয়েরারা যেখানে বক্স টু বক্স মুভমেন্টে মাঠ মাতাচ্ছেন, সেখানে ফাইনাল থার্ডে যাওয়াটা রীতিমত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ম্যাকেলেলের জন্য।

দুই উইঙ্গার রোবেন আর ডাফকে প্রায়ই উইং সুইচ করতে হত, যাতে তারা কাট-ইন করে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত স্পেস পেতে পারেন। এর ফলে তাদের রেখে যাওয়া খালি স্থানে ওভারল্যাপ করে উঠে আসতেন ফুলব্যাকরা, বক্সের মধ্যে ক্রস ফেলতেন দ্রগবাকে লক্ষ্য করে। দ্রগবাকে নিয়ে আলাদা করে না বললেই নয়। বার্সেলোনা আর ইন্টার মিলানের হয়ে নাম্বার নাইনের সংজ্ঞাটা নতুনভাবে লিখেছিলেন ব্রাজিলিয়ান রোনালদো, সেই ফর্মুলা অনুসরণ করে প্রিমিয়ার লিগকে কমপ্লিট স্ট্রাইকারের নমুনা শেখালেন দ্রগবা। দ্রগবার অফ দ্যা বল মুভমেন্ট ছিল অসাধারণ, সেই সাথে তার পেস আর স্ট্রেংথ এর জোরে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু দ্রগবাকে মার্ক করার জন্যই দু’জন ডিফেন্ডারের দরকার হত। মূলত এই কারণেই মরিনহো মিডফিল্ডে একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় রাখার সাহস পেয়েছিলেন।

ক্রুইফের বার্সেলোনা টিকি-টাকা দিয়ে নব্বই-এর দশকে স্পেন এবং ইউরোপ শাসন করার পরে পজেশন-বেসড ফুটবল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূলত কম-বেশি সব কোচই এই কৌশল অবলম্বন করতে থাকেন। কিন্তু মরিনহো এই কৌশলের ধার দিয়েও গেলেন না। তার দল পজেশন ধরে রাখার চেয়ে প্রতিপক্ষকে ডিসপজেস করে দ্রুতগতিতে এটাক করার দিকেই মনোযোগ দিল। বল রিকভারি করার দায়িত্বটা ছিল ম্যাকেলেলের ওপর, আর তার পাস থেকে লাম্পার্ড-কোলরা বলটা ড্রাইভ করে নিয়ে আসতেন প্রতিপক্ষের সীমানায়। এরপরই স্পটলাইটে আসতেন দুই উইংগার রোবেন এবং ডাফ, ঝড়ের বেগে দুই ফ্ল্যাংক ইউজ করে ঢুকে পড়তেন অপোনেন্টের ডি-বক্সে। চাতক পাখির মত সেখানে অপেক্ষায় থাকতেন দ্রগবা, বলের গন্ধ পেলেই ছোঁ মারতেন শিকারি বাজের ক্ষীপ্রতায়।

মরিনহোর ট্যাকটিকস কতটুকু সফল হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তৎকালীন রেকর্ড ৯৫ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় চেলসি, পুরো সিজনে মাত্র একটি ম্যাচ হারে। লিগে মাত্র পনেরটি গোল হজম করে, যে রেকর্ডটা এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। মরিনহো চেলসিতে ছিলেন মাত্র তিন সিজন, তাতেই জিতে নেন ছয়টি ট্রফি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল- তার আমলেই প্রিমিয়ার লিগের এলিট ক্লাব হিসেবে উঠে আসে চেলসির নাম।

চেলসির এই সাফল্য পুরোটাই ট্যাকটিক্যাল- এটা ভাবলে ভুল হবে। মরিনহোর উইনিং মেন্টালিটি আর সর্বগ্রাসী পার্সোনালিটিরিও বড় অবদান ছিল এর পেছনে। কোচিং স্টাফ থেকে মেডিক্যাল স্টাফ- সবাইকেই দাপটের সাথে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দলের ওপর তার প্রভাব কতটা বেশি ছিল, সেটা বোঝা যায় পরবর্তীতে জন টেরির মন্তব্যে, ‘হোসের জন্য আমি কফিনে করে মাঠ ছাড়তেও রাজি ছিলাম’। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে আব্রামোভিচের সাথে মতের অমিলের জেরে চেলসি থেকে বিদায় নেন মরিনহো। তার এই বিদায় সবচেয়ে বেশি আঘাত করে দিদিয়ের দ্রগবাকে। তার মতে, ‘আমার মনে হচ্ছিল সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এমনকি আমি চেলসি ছাড়ারও চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলাম’।

মরিনহোর একটা ফুটবল দর্শন আছে। সে দর্শন হয়তো খুব বেশি জনপ্রিয় নয়, কিন্তু এটাই ওয়েস্ট লন্ডনের ক্লাবটিকে উইনিং ট্র্যাকে তুলে এনেছিল। ব্যক্তি মরিনহোও খুব একটা জনপ্রিয় নন। লিভারপুল সাপোর্টারদের সামনে গিয়ে তাদের বিদ্রূপ করেছিলেন, লিগ শিরোপা জেতার পর মেডালটি ছুঁড়ে মেরেছিলেন দর্শকসারিতে। মরিনহো তার এই শর্টস্পেলে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের এক কিংবদন্তি কোচ ব্রায়ান ক্লফকে। ফাউলমাউথের জন্য তার সময়ে বেশ অজনপ্রিয় ছিলেন এই ইংলিশ কোচ, এমনকি স্বয়ং মোহাম্মদ আলীও তার মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন যখন তার কথা মনে করা হয়, তখন চোখের পর্দায় ভেসে উঠে নটিংহ্যাম ফরেস্টকে ইউরোপিয়ান কাপ জিতানোর পর ট্রফি হাতে ক্লফের হাসিমুখ। হয়তো আরও অনেক বসন্ত কেটে যাওয়ার পর ফুটবলরসিকরা যখন মরিনহোর কথা স্মরণ করবে, তখন তাদের কাছে সব তিক্ত স্মৃতি মলিন হয়ে শুধু একটা স্মৃতিই জ্বলজ্বল করবে- ডাগআউটে দাঁড়িয়ে অস্থির মুখে নোটপ্যাডে আঁকিবুঁকি করছেন এক পর্তুগিজ ভদ্রলোক।mourinho